ফখরুল আবেদীন
আমার স্ত্রীর অনেক দিনের ইচ্ছা ভারতের ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেড়াতে যাবে, আমিও একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। কত দিনের স্বপ্ন হিন্দি ছবি সিলসিলার অমিতাভ বচ্চন আর রেখার মতো আমি আর আমার বউ কাশ্মীরের টিউলিপের বাগানে দৌড়ে বেড়াচ্ছি। পটভূমিতে বাজবে মিউজিক। আহ্ জীবন।
১০ দিন ধরে ভারতের ভিসার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিছুতেই সাক্ষাৎকারের ডেট পাচ্ছি না। শুনলাম একসঙ্গে অনেক মানুষ চেষ্টা করছে। তাই তারিখ পেতে দেরি হচ্ছে। আসলে আরও আগে থেকেই চেষ্টা করা দরকার ছিল।
বিপদেই আছি, দুই মাস আগে থাকতেই বউ-বাচ্চাকে কথা দিয়েছি এই ঈদুল আজহার ছুটিতে দেশের বাইরে নিয়ে যাব। একাজ-ওকাজের ঝামেলায় বেড়ানোর কাজ আর বেশি এগোয়নি। ভেবেছি এখনো ২০-২৫ দিন আছে, একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে, এটা কোনো ব্যাপার হলো?
ব্যাপারটা যে এত কঠিন হয়ে যাবে, সেটা কে বুঝেছে? শেষে উপায়ান্তর না দেখে তিন-চার দিন আগে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম,
‘ভিসা ছাড়া কোন কোন দেশে যাওয়া যায়, কেউ কি জানেন?
বড় বিপদে আছি রে ভাই!
ওগো শুনছ, আমি কিন্তু চেষ্টা করেই যাচ্ছি…।’
উত্তরে এমন সব দেশের নাম এল, তার অধিকাংশের নামও শুনিনি এই জীবনে। মালাউই, সেশেল, মন্টসের্রাট, নাউরু, পালাউ, সামোয়া, টুভালু, ভানুয়াটু—এইগুলো কোন দেশ? কীভাবে যায়?
ফোন দিলাম গাইড টুরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান মনসুরকে। যদি দেশের মধ্যে কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।
নিরাশ করলেন হাসান মনসুর। সঙ্গে খানিকটা পরামর্শও দিয়ে দিলেন। তাঁর মতে, ‘এ ধরনের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য যে জিনিসটা বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে অনেক আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ। এই বিষয়ে আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। প্রায়ই দেখা যায় যে ছুটি শুরু হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে লোকজন এসে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করে, যখন আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি না।’
এদিকে দেখি বন্ধু রোকসানা জেরিনকে। নিজে একটি নামকরা বিদেশি স্কুলে চাকরি করেন আর স্বামী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও দিব্যি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জানতে চাইলাম কীভাবে পারেন তাঁরা। রোকসানা জানালেন, ‘বছরের শুরুতেই স্কুলের ছুটির তালিকা নিয়ে বসি, দেখি শুক্র ও শনিবারের সঙ্গে বৃহস্পতি বা রোববার কোনো সরকারি ছুটি পড়েছে কি না। ব্যস, দেশের মধ্যে ছোটখাটো বেড়ানোর পরিকল্পনা করে ফেলি বছরের শুরুতেই। আর বাচ্চার স্কুলের ছুটি দেখে দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনাও করি।’
বেড়ানোর জন্য ইচ্ছাটা থাকা সবচেয়ে জরুরি। এরপর পরিকল্পনা। সেই দিন আর নেই যে হুট করে বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথাও চলে গেলেন! এই যে কক্সবাজারে শত শত হোটেল, তাও তো বড় ছুটিতে কোথাও থাকার জায়গা পাওয়া যায় না। আগে থেকে বুকিং করে গেলে নিশ্চিন্ত। আজকাল দেশের হোটেলগুলোতে দুই-তিন মাস আগে থেকেও বুকিং দেওয়া যায়।
থাকার জায়গা ঠিক করে নেমে পড়তে হবে গাড়ির ব্যবস্থা করতে। নিজের গাড়ি হলে তো হলোই আর না হলেও সমস্যা নেই, বাস-ট্রেন আর ভাড়ার গাড়ি তো আছেই।
অনেকে দলবেঁধে বেড়াতে যান। এটা ভালো। সবাই মিলে হইহুল্লোড় করে বেড়ানো যায়…তবে এখানে একটা ভেজালও আছে। সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারটা জরুরি। ভুল সঙ্গী হলে আমার দশা হবে। বছর দশেক আগে দলবেঁধে গেলাম সুন্দরবন বেড়াতে। আমরা খাইদাই, ঘুরিফিরি আর লঞ্চে বসে সুন্দরবন দেখি। খুবই শান্তিময় জীবন। এমনই এক সকালে লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে বনের পাখি আর হরিণ দেখছি। পাশে এসে দাঁড়ালেন এক ভ্রমণসঙ্গী। বলে ফেললেন, ‘বুঝলেন ভাইজান, সুন্দরবনের বাঘগুলা মাইরা ফেলা দরকার।’
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, কোনো রকমে জিজ্ঞেস করলাম, এর কারণ কী?
‘বাঘ না থাকলে সুন্দরবনে হরিণের চাষ করা যাইত।’
আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, ‘ভাই, প্লিজ আপনি যান এখান থেকে।’
একবার আমার তিন সহকর্মী তাঁদের পরিবার নিয়ে গেলেন ভারত ঘুরতে। কত যে তাঁদের পরিকল্পনা—দিল্লির লালকেল্লা, জয়পুরের আমের ফোর্ট আর আগ্রার তাজমহলটা দেখতেই হবে। ঠিকমতো কলকাতাও পৌঁছে গেলেন। সমস্যা হলো তাঁদের গ্রুপের জনসংখ্যা। বাচ্চা-কাচ্চাসহ ১৩ জন। তিন-চার দিন কলকাতার রাস্তায় জুতা ক্ষয় করেও একসঙ্গে ১৩ জনের দিল্লি যাওয়ার ট্রেনের টিকিট জোগাড় করতে পারলেন না। আর প্লেনের টিকিট তো অনেক খরচের ব্যাপার। কী আর করা, পুরো ১০ দিন কলকাতার নিউমার্কেটের শাড়ি-জুতার দোকান ঘুরে দেশে ফিরে এলেন। তাই দলবেঁধে ঘুরতে যেতে হলেও কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। মানসিকতার মিল আছে, এমন লোকজন নিয়েই গ্রুপ করা উচিত। খেয়াল রাখতে হবে যেন গ্রুপ এত বড় না হয়, যে সবার সব সামাল দিতে গিয়ে বেড়ানোটাই মাটি হয়ে যায়। যদি বড় গ্রুপ নিয়ে যেতেই হয়, সে ক্ষেত্রে কোনো টুর অপারেটরকে দায়িত্ব দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ঘুরতে যাওয়ার জন্য তিনটি বিষয় প্রয়োজন—ইচ্ছা, ছুটি আর টাকা। ধরুন ইচ্ছা আছে ছুটি আছে, কিন্তু টাকা নেই। আপনার বেড়ানো হবে। টাকারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আবার ইচ্ছা আছে, টাকা আছে, কিন্তু ছুটি নেই; একটু কষ্ট হলেও ছুটি ব্যবস্থা করে আপনার বেড়ানো হবে। কিন্তু যদি ধরেন আপনার ছুটি আছে, টাকা আছে, কিন্তু ইচ্ছা নেই; তাহলে কিন্তু আপনার বেড়ানো হবে না। ইচ্ছাটাই হলো সবচেয়ে বড় ব্যাপার।
নিজের মনের মধ্যে বেড়ানোর ইচ্ছাটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে, কারণ বাংলাদেশে এখন বেড়ানোকে আর বিলাসিতা বলে বেশির ভাগ মানুষই মনে করে না। ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও এই ব্যাপারটা মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের কাছে বিলাসিতার একটা বিষয় ছিল। এখন আর সেটা নেই।
এ ব্যাপারে হাসান মনসুর বলেন, গত দুই দশকে দেশে বড় পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক পরিবর্তনটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ছোট হয়ে গেছে। ফলে পারিবারিকভাবে বেড়াতে যাওয়া এখন সম্ভব এবং অনেক পরিবারই তা-ই করে থাকে।
অন্যদিকে, রোকসানা জেরিনের মতে, ‘যান্ত্রিক জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে আর মন প্রফুল্ল রাখতে চাই একটু ব্রেক। এই ব্রেকটুকুই অন্য দিনগুলোতে কাজের শক্তি আর সৃষ্টিশীল কাজের প্রেরণা দেয়।’
আমি এত কিছু বুঝি না, শুধু এইটুকু বুঝি যে হাজারো কাজের চাপে আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাই। স্ত্রী-সন্তানের কাছে দূরের মানুষ হয়ে যেতে থাকি। এই দুই-চার দিনের ঘোরাঘুরি আমাকে আমার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। আমি নতুন করে খেয়াল করি যে আমার মেয়েটা আরও একটু বড় হয়ে গেছে, আর আমার স্ত্রী এখনো আমার হাত শক্ত করেই ধরে হাঁটে, সেই আগে যেভাবে হাঁটত। সূত্র : প্রথম আলো