জাহান নাবীল
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি সাহারার বুকে এক মরূদ্যানের নাম ‘মাজাব’। আলজেরিয়ার রাজধানী শহর আলজিয়ার্স থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দক্ষিণে, এই মাজাবেই আছে পাঁচটি প্রাচীন দেয়ালঘেরা নগরী-‘ঘারদাইয়া’, ‘মালিকা’, ‘বনি ইসগুয়েন’, ‘বউ নউরা’ ও ‘আল আত্তাউফ’। একত্রে বলা হয় ‘পেন্টাপোলিস’। পেন্টাপোলিসের, অর্থাৎ পাঁচটি নগরের মিলিত আয়তন প্রায় ১০ কিলোমিটার। ‘মোজাবাইট’ জাতি এই নগরগুলোর পত্তন করে ১১ শতকে। এই মোজাবাইটদের বসত ছিল আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমের মাগরেব অঞ্চলে। সেখানে তাদের রাজধানী ছিল তাহের্ত-এ। ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তাহের্ত শহরে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বলা চলে, একেবারে ভস্মীভূত হয়ে যায় গোটা শহর। তখন তারা তাহের্ত থেকে চলে আসে মাজাব উপত্যকার এই মরূদ্যানে। একে একে গড়ে তোলে ছবির মতো সাজানো পাঁচটি দেয়ালঘেরা শহর।
এই পেন্টাপোলিসের রাজধানী হলো ‘ঘারদাইয়া’। তবে এটা সবচেয়ে পুরনো শহর নয়। মোজাবাইটরা মাজাবে এসে প্রথম স্থাপন করে ‘আল-আত্তাউফ’ শহরটি। তবে নির্মাণশৈলীতে সবচেয়ে অদ্ভুত শহর ‘বনি ইসগুয়েন’। মাজাবের অধিবাসীদের কাছে এটি বিশেষ পবিত্র শহর। এমনকি এই কিছুদিন আগেও শহরটিতে যাওয়া-আসার ব্যাপারেও ছিল বেশ কড়া আইনকানুন। অন্ধকার হয়ে গেলে অন্য শহরের কেউ এই শহরে ঢুকতেই পারত না। রাতে শহরটির প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হতো। এখন এসব আইনকানুন অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে। তবে এখনো এই শহরেই প্রাচীন রীতিনীতির কড়াকড়ি সবচেয়ে বেশি।
শহরগুলো রীতিমতো সুরক্ষিত। একেকটা যেন ছোটখাটো দুর্গ। কাঠামোও আর পাঁচ-দশটি শহরের মতো নয়। প্রতিটি শহর বানানো হয়েছে কোনো একটা টিলার গায়ে। টিলার ঠিক মাঝখানে, সবচেয়ে উঁচুতে, প্রতিটি শহরেই একটি করে মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদগুলোকে কেন্দ্র করেই শহরগুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। মসজিদগুলোকে ঘিরে চারপাশে বৃত্তাকারে বানানো হয়েছে বসতবাড়ি। আর এই বসতবাড়িগুলো দেখতেও বেশ অদ্ভুত। যেন একেকটা প্যাস্টেল রঙের বাক্স।
শহরগুলোর কেন্দ্রে যে মসজিদগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু স্রেফ নামাজ পড়ার জন্যই নয়; বরং শহরের কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। দুর্গের মতো শহরগুলোর মধ্যে এই মসজিদগুলো যেন আরেক দুর্গ। যুদ্ধের সময় এই মসজিদগুলোতেই শহরের মানুষ ঘাঁটি গাড়ত। এসব মসজিদ যেমন শহরগুলোর অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় শস্যাগার হিসেবেও। আর মসজিদের সুউচ্চ মিনারগুলো ব্যবহৃত হতো ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে।
মসজিদের চারপাশের বাড়িগুলোতে শহরের অধিবাসীরা বসবাস করে। এই বাড়িগুলোও বিশেষ কৌশলে একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে বানানো। ফলে সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ বেশ ভালো। একই সঙ্গে পরিবারগুলোর সামাজিক গোপনীয়তা রক্ষারও বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আর সব বাড়ির সুবিধা-অসুবিধাও সমান। কাজেই বাড়ির ভাগাভাগি নিয়ে মনোমালিন্য বা বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। বাড়িগুলোতে চলাচলের জন্য রয়েছে পায়ে চলার সরু পথ।
এই শহরগুলোর প্রাচীন রীতিনীতির অনেকাংশে বদল ঘটলেও, এই পেন্টাপোলিসের মানুষ তাদের প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে একেবারে সরে আসেনি। সাহারা মরুভূমির মাজাব উপত্যকার মরূদ্যানের এই পাঁচ শহরের মানুষ এখনো তাদের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানিয়েই জীবন যাপন করে থাকে। ১৯৮২ সালে ইউনেসকো যে পেন্টাপোলিসকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি দিয়েছে, তা তো আর এমনি এমনি নয়! সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ