ছোট্টবেলায় বি.টি.ভিতে টিপু সুলতানের ধারাবাহিক সিরিয়ালের খুব ভক্ত ছিলাম, কবে প্রত্যাশিত সোমবার আসবে, সেই অপেক্ষা করতাম। টিপু সুলতানের তলোয়ার যে কতগুলো কিনেছি তার ইয়াত্তা নেই।
সেই থেকে ভারত বিশেষ করে মহিশুরের প্রতি সামান্য ঝোক ছিলো। তবে বাংলাদেশের সাথে নানা বৈষম্য করায় ভারতের প্রতি ছিলো বিতৃষ্ণা।
যাক তবুও আম্মার চিকিৎসার সুবাদে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হলো ভারতের ব্যংগালুরুতে।
একটা অপ্রাসংগিক কিন্তু জরুরি কথা বলে রাখি। আমাদের দেশের ডাক্তার মশাইদের অপচিকিৎসা আর টাকা কামানোর ধান্দায় প্রতারিত লোকজন আজ অতিষ্ট হয়ে বিদেশ বিশেষ করে ভারত যাচ্ছেন। এতো সুন্দর সার্ভিস এবং সততা, আমি দেখে অভিভুত। রোগ না থাকার পরেও আমার দেশের এক নামকরা ডাক্তার আম্মাকে ব্রেইন স্ট্রোকের কথা বলে রিং বসানোর জন্য খুবই পীড়াপীড়ি করছিলেন। তার ডিমান্ড ছিলো দুই লাখ টাকা। আর আমাদের একটু পর পর ভয় দিচ্ছিলেন। আমরাও বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। শেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম দেশের বাইরে নিয়ে যাবো।
সেই হিসেবে খুবই দ্রুততার সাথে ভারতে ভিসা করা এবং যাওয়া। সেখানে ডাক্তার আমাদের রিপোর্ট দেখে আবার কয়েকটি টেস্ট করতে দিলেন। তারপর আমাকে বললেন দেখো তুমি শিক্ষিত ছেলে, এই দুই রিপোর্টের কোনো পার্থক্য পাও কি? আমি তার সহযোগিতায় রিপোর্ট দেখে বুঝলাম সবই এক। তারপর ডাক্তার বললেন, আমিতো রিং পড়ানোর কোনো মেজর কারণ দেখি না। তিনি স্ট্রোক করেন নাই। ব্লাড প্রেসারের কারণে সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছিলেন। যাও দেশে চলে যাও।
আমার চোখে মুখে অবিশ্বাসের চিহ্ন দেখে বললেন তুমি চাইলে অন্য হাসপাতালের ডাক্তার দেখাতে পারো, তিনিও একই কথা বলবেন। আমি তাই করলাম। সেখানেও একই কথা।
তখন খুব কষ্ট লাগলো। দেশের মানুষকে কতটাই না ঠকানো হচ্ছে? আমার আশেপাশে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় ৯৯% রোগীর একই কমপ্লিন। খুব অসহায় লাগলো। আমার লেখা যদি কোনো ডাক্তার পড়েন; প্লিজ কস্ট নিবেন না। তবে মানুষের মনের ব্যাথাটা একবার অনুভব করুন। একটি লোক বাঁচার জন্য আপনার কাছে জমি বিক্রি করে নিজের জীবনটা তুলে দেন; আর আপনি সামান্য টাকার লোভে তাকে অপচিকিৎসা করছেন। অনেক সময় মুল্যবান একটি জীবন চলেও যায়। তাহলে ডাকাত আর আপনার মধ্যে পার্থক্য কী রইলো?
আর হাসপাতালের অনেক গেস্ট হাউজ, মাত্র ১৫০ রুপি থেকে ৮০০ রুপির মধ্যেই থাকা যায়। এতো ভালো সার্ভিস দেখলে আমাদের দেশের সরকারি/প্রাইভেট হাসপাতাল আর ক্লিনিকের জন্য ঘৃনা তৈরি হয়।
যাক, মাত্র ২৫,০০০ রুপি খরচ হওয়ার আনন্দের চেয়ে আম্মার কোনো রোগ নেই এই কথাই আমাদের মনে বেশি আনন্দ দিচ্ছিলো। এবার আম্মা বললেন, চলো মহিশুর যাই। ব্যাস যে ভাবনা সে কাজ। আমি দুপুরেই গাড়ি ঠিক করলাম। বেলা ১টায় আমরা রওয়ানা দিলাম মহিশুরের উদ্দেশে। বিশাল হাইওয়ের দুই পাশে দৈত্যকার পাথরের পাহাড়গুলো দেখলেই বোঝা যায় এই রাস্তাগুলো পাথরের পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি চলছে, এই উপরে উঠে যাচ্ছি পাহাড়ের উপর, মনে হচ্ছে আকাশ বুঝি আর একটু উপরে। আবার যখন নিচে নামছি, বুকের মাঝে হালকা চাপ অনুভব করছি। এ এক আলাদা থ্রিল। মাইলের পর মাইল কোনো গাড়ি নাই। এক অচিন স্বপ্নের দেশে যাচ্ছি আমরা। রাস্তার মাঝে আমি ড্রাইভারকে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললাম পেটে কিছু দিতে হবে। তিনি কিছুক্ষণ পর একটি হাইওয়ে রেস্তোঁরায় দাঁড়ালেন। ছোট খাটো পার্কের মতো রেস্তোঁরার কিচেন আর রুম দেখলেই বুঝবেন স্যাটেলাইট টি.ভিতে যে ভারত দেখেন সেটা শুধুই সিনেমা। বাস্তবের জীবন ওদের খুবই মর্মান্তিক। দিল্লি যাওয়ার পথেও সেটা দেখলাম। যাক কোনোমতে খাবার ওর্ডার দিলাম। ফ্রাইড রাইস আর মাছ। দক্ষিণ ভারতে ২৪ ঘণ্টা থালী/ভেজিটেবল খেতে খেতে অস্থির আমরা তিনজনই অস্থির। এরা খায় বিভিন্ন ধরনের টক, বড় ছোলার ঝোল, আলু ফুলকপি (আলু গোবী)আলুর দম। তাও খাওয়া যেত কিন্তু সব তরকারীতে কারি পাতার বিশ্রী স্বাদ আর সহ্য হয় না।(হুম গোশত ছিলো, কিন্তু আল্লাহর নাম ছাড়া জবাই করা তাই খাই নাই।)
যাক অনেক কস্টে খেলাম। খাওয়া শেষে আবার রওয়ানা হলাম মহিশুরের উদ্দেশে।
মহিশুর শহরে প্রবেশ করে মনটা হারিয়ে গেলো সেই অতীত স্মৃতিতে। মুসলিম শাসক হায়দার আলী খানের ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, রাজা হয়েও বিলাসিতা পরিহার, টিপু সুলতান আর তার ভাইকে কড়া শাসন, রুটিন লাইফে অভ্যস্ত করানো এসব যেনো চোখের সামনে ভাসছিলো। দিব্য চোখে দেখতে পেলাম এখানেরই কোনো এক মাঠে গাজী খান প্রশিক্ষণ দিচ্ছে টিপুকে। আরো অনেক কিছু। হারিয়ে গেলাম সেই শান্তির দিনগুলোতে। টিপু আর বাদশাহ আলমগীরের মতো এতো ন্যায় শাসক বুঝি ভারত উপমহাদেশ আর পাবে না। হিন্দু মুসলিমের মধ্যে এতো মিল টিপুর যুগেই ছিলো। আর ইংরেজ কুচক্রীরা ভারতের মুসলিমদের উৎখাত করতে একটার পর একটা চক্রান্ত, কুট কৌশল করে যাচ্ছে, টিপুকে তারা একদিনও শান্তিতে থাকতে দেয় নাই। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো চুক্তিভঙ্গকারী মারাঠীরা।
কল্পনা যখন কাবেরী নদীর তীরে খেলা করছিলো, ড্রাইভার বললেন, স্যার, এটা কাবেরী নদী, পাশেই টিপুর পানির জেলখানা। এখানে তিনি ওয়াদা খেলাফকারী মারাঠী আর কুচক্রী ইংরেজদের বেধে রাখতেন। নামটা শুনে একটু আগ্রহ লাগলো। আমরা নামলাম, জায়গাটা খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা নাই। ভিতরে প্রবেশ করতেই স্বেচ্ছায় একজন মুরুব্বি ধরণের লোক এখানের ব্যাপারে বলতে শুরু করলেন। ২০-৩০ ফুট লম্বা আর ১২-১৫ ফুট চওড়া, একতলা কারাগার ভবনটি রোড লেভেল থেকেও নিচে। মুরুব্বি লোকটি বললেন এখানে জোয়ারের সময় কাবেরী নদীর পানি আসতো আর আসামিদের গলা পর্যন্ত ডুবে থাকতো। এটাই ছিলো শাস্তি। টিপুর অসাধারণ জ্ঞানের তারিফ করতে হয়। সেখানে একটি কামান ছিলো। বুঝলাম এটি পরে সংযোজন করা হয়েছে।
এরপরে গেলাম মহিশুরের বাঘ টিপুর লাশ যেখানে পড়েছিলো, আর হাতে ধরা ছিলো সেই তরবারী। মৃত্যুর পরেও হাতে তলোয়ার দেখে বোঝা যায়, শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে দেখলাম ইয়া বড় সাইজের ঘোড়া, এদের কাছে আমাদের দেশের গুলিস্থানের ঘোড়াগুলোকে ছাগল/ভেড়া জাতীয় মনে হবে।
এরপর আমরা গেলাম টিপুর কবরে, সেখানে টিপুর কবরের পাশেই আছে হায়দার আলী এবং টিপুর মায়ের কবর। আশে পাশে রয়েছে টিপুর অন্যান্য আত্মীয়ের কবর। ভারতের একটা বিষয় আমার খুব নজরে পড়েছে, তা হলো কবর পুজা। শিরকের দেশ ভারতে মুসলিমরা হিন্দুদের মতো অনেকটা শিরকে জড়িয়ে পড়েছে। সওয়াবের নিয়তে হিন্দু-মুসলিম ভক্তবৃন্দ টিপু, হায়দার আলী আর স্ত্রীর কবরে বোতলের পর বোতল আতর ঢেলে দিচ্ছে, ফুল দিচ্ছে, কেউ কেউ আবার অতি উৎসাহে সেই ফুল খাচ্ছে। তাদের এই অজ্ঞতায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার আম্মা কাউকে কাউকে নিষেধ করছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
এরপর আমাদের গন্তব্য টিপুর গ্রীষ্মকালীন অবকাশযাপন কেন্দ্র। ভারতের আর দশটি রাজার মতো কোনো বিলাসী অবকাশ যাপন কেন্দ্র নয় এটি। কতটা সাধারণ জীবন যাপন করতেন মহীশুরের এই বাঘ তা না দেখলে বোঝা যাবে না।
তার এই সাদাসিধে জীবন দেখে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো। আমার বোন আমাকে বললো ভাইয়া, এর থেকেতো আমাদের গ্রামের বাড়ি আরো সুন্দর। আমি বললাম, আপু সৎ আর ন্যায় পরায়ণ শাসকরা এমনি জীবন যাপন করে। এই অবকাশযাপন কেন্দ্রটি এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এখানে গেলে টিপুর ছবি, তার সন্তানদের ছবি, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, কামানের গোলা, বিভিন্ন অস্ত্র দেখতে পাবেন।
এরপর গেলাম সেই প্রতিক্ষিত টিপুর রাজপ্রাসাদ।
টিপুর রাজধানী শ্রীরংগপত্তনের মুল আকর্ষণ টিপু প্যালেসের গেটে গিয়ে মনের মধ্যে আমার এক অদ্ভুত শিহরণ কাজ করছিলো, আমার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি টিপুর পোষা বাঘগুলো এসে হালুম বলে ডাক দেয়। আম্মার খুব খুশি লাগছিলো। তিনি বার বার তাড়া দিচ্ছিলেন ভেতরে যাবার জন্য।
টিকিট কেটে ভিতরে যেতেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দেখলাম দেয়ালের প্রতিটা দেয়াল আর দরজায় হিন্দু দেব দেবির মুর্তি আঁকা। কাঠের দরজা খোদাই করে মুর্তি বানানো। বুঝতে আর বাকী রইলো না, ন্যায় শাসক টিপুকে হিন্দু রাজা প্রমাণের একটি বাজে চেষ্টা ভারত কর্তৃপক্ষের। যেন ফরেনার ট্যুরিস্ট এসে বুঝতে পারে টিপু আসলে একজন পথভ্রষ্ট।
টিপুর প্রতি জুলুমের এই বাজে দৃশ্য দেখে খুব মর্মাহত হলাম। তারপরেও হেটে হেটে দেখলাম মেরুন প্রলেপ দেয়া গম্বুজ বিশিষ্ট স্বপ্নের রাজপ্রাসাদটিকে।
আমি যেনো দেখছিলাম টিপুর সে ছেলেবেলা। তার বান্ধবী এবং স্ত্রী রুকাইয়া বানুর সাথে প্রাসাদের উঠানে খেলা করা। কোনো এক জানালা ধরে বসে আছে টিপুর মা। অপেক্ষা প্রাণপ্রিয় স্বামী কখন যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসে। ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে যখন সুর্য যাচ্ছিলো, তখন আমরা এসে দাঁড়ালাম প্রাসাদের শেষ বারান্দায়। বিশাল প্রাসাদের মেরুন রঙা গম্বুজগুলো সুর্যের আলোয় চকচক করে ঘোষণা দিচ্ছিলো এটি বাঘের রাজপ্রাসাদ। যে বাঘ অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে নি। ভারতের শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন টিপু সুলতান। যাকে বাঘের মতো ভয় পেতো ইংরেজ আর অত্যাচারী চুক্তিভংগকারী মারাঠীরা।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা আর টিপু সুলতান প্রায় একই বয়সে দেশের ক্ষমতা পান। কিন্তু দুজনের মধ্যে ছিলো বিস্তর ফারাক। সিরাজ যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে এসে ধরা পড়েছিলেন আর প্রাণ হারিয়েছিলেন। কিন্তু টিপু সুলতান যুদ্ধের ময়দানে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়েছিলেন স্বাধীনতার দুশমনদের সাথে। আর মৃত্যু হয়েছিলো বীরের বেশে।
তার একটা উক্তি আজ বিশ্ববিখ্যাত “ইদুর আর শিয়ালের মত হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে বাঘের মতো দুদিন বেঁচে থাকাই সম্মানের।”
আচ্ছা, এবার নাটকীয়তা বাদ দেই।
বিশাল এই প্রাসাদ তৈরি শুরু করেছিলেন টিপুর পিতা হায়দার আলী, আর তা নির্মাণ শেষ করেন টিপু সুলতান ১৭৯১ সালে।
মজবুত সেগুন কাঠের পিলারগুলো ঘরের সিলিং ধরে রেখেছে। খাজকাটা কাঠের পিলারগুলো পুরো প্রাসাদের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেছে। থামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে এর বেইস এবং উপর। এমনভাবে ফুলের নকশা কাটা, মনে হবে যেন ফুটন্ত ফুল। আর ফ্যাকাশে হলুদ অথবা সোনালী রঙের ফুলের নক্সা হলেও পুরো পিলারের রঙ মেরুন। আর পিলারগুলো দাঁড়িয়ে আছে পাথরের উপর। দেখেই বোঝা যাবে একদল নিখুত কারিগর মনের মাধুরী মিশিয়ে বানিয়েছে প্রাসাদটি।
প্রাসাদের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে ২য় তলার সেন্ট্রাল হল রুম। ৪টি আলাদা সিঁড়ি দিয়েই সেখানে যাওয়া যায়। আর বারান্দার একটি অংশ হাল্কা সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে।
অসাধারণ এই প্যালেসটি দেখলে খুবই সুন্দর লাগে, বিশেষ করে সন্ধ্যায় যখন পুরো প্যালেসটি আলোক সজ্জা করা হয়।
ভারতের এই বাঘের প্রাসাদটি আজো টিপু সুলতানের সাহসিকতা প্রকাশ করে যাচ্ছে।
মহিশুরের এই বাঘের ডেরা ঘুরে দেখতে আমন্ত্রণ রইলো।
ঢাকা ট্যুরিস্ট ক্লাবের পক্ষ থেকে যাওয়া হবে এই প্রাসাদ দেখতে, আগ্রহীগণ যোগাযোগ করতে পারেন।
মাত্র ৩০,০০০ টাকায় ঘুরে আসুন কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, আজমীর, রাজস্থান, মহিশুর। দেখে আসুন আরো অনেক কিছু।
যোগাযোগ করতেঃ ০১৯৭১১০০৭১১, ০১৬১২৩৬০৩৪৮, অথবা আমাদের ইনবক্স করুন ফেসবুক বা আমাদের ওয়েব সাইটে।