Skip to content

মাল্টিটাস্কিং : মস্তিষ্কের নীরব হুমকি

Multytasking

ঊর্মিলা চক্রবর্তী
মনস্থির করলেন আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখবেন। যখন কাজটি কেবল শুরু করেছেন বা করতে যাচ্ছেন মনে হলো সেই সাথে একটা গান শুনলে মন্দ হয় না। এরই মাঝে কিছু ফোন কল রিসিভ করলেন। সঙ্গত কারণে নিজেও কিছু ফোন করলেন। একটু পরেই মনে হলো ফেসবুকটা ওপেন রেখেও কাজটি করা যায়। এভাবে একই সাথে একাধিক কাজে মন দিতে পারার জন্য নিজেকে উত্তরাধুনিক যুগের মানুষ বলে গর্ববোধ করছেন বটে, কিন্তু গভীর মনযোগের সাথে মূল কাজটি অর্থাত্ প্রবন্ধ লেখার কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে আপনি কিছুটা হলেও ব্যর্থ হচ্ছেন। গুগলের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মানুষ যত তথ্য আদান-প্রদান করেছে বিগত পাঁচ বছরে তার থেকে বেশি পরিমাণ তথ্য আদান-প্রদান করেছে। মিডিয়া আর টেকনোলজির এই রাজত্বকালে মাল্টিটাস্কিং যেন অনেকটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মাল্টিটাস্কিং-এর এই ভাইরাল সংক্রমণের পেছনে কারণ হিসাবে সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ও বহুল প্রচারকে চিহ্নিত করা যায়। আজ থেকে এক দশক পূর্বেও আমাদের দেশে মাল্টিটাস্কিং এর বিষয়টি এতোটা সরগরম ছিল না। সামাজিক গণমাধ্যমসমূহ, ই-মেইল, ফেসবুক, ফোন কল আমাদের নাকের ডগা দিয়ে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সময়কে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশনের একটি প্রোগ্রাম দেখতে দেখতে ফেসবুকিং, কাজের মধ্যে আই-ফোনে গান শোনা আর এরই ফাঁকে ই-মেইল চেকিং, একই সাথে চ্যাটবক্সে পরিচিত, অল্প পরিচিত কিংবা সম্পূর্ণ অপরিচিত একাধিক ‘ফ্রেন্ড’ এর মেসেজের উত্তর-প্রতিউত্তর চালিয়ে যাওয়া; রান্না করতে করতে ফোনালাপ আর এরই মাঝে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয়, অল্প প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় ছবি আপলোডিং প্রভৃতি বহুবিধ কাজ আমরা এই শতকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণার্থে যুগপত্ কাজ করতে এক রকম বাধ্য হচ্ছি।

মাল্টিটাস্কিং বাহ্যত সময় বাঁচাতে বা সময়ের যথোচিত্ ব্যবহার করতে আমাদের সাহায্য করছে বলে মনে হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বিশ্লেষকগণ। স্নায়ুবিজ্ঞানী ডেনিয়েল জে. লেভিটিন মানব-মস্তিষ্কে মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বলেন, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদী মাল্টিটাস্কিং এর ফলে মস্তিষ্কে ঐ কাজগুলোর প্রতি রাসায়নিক আসক্তির একটি চক্র তৈরি হয়, যেখানে যুগপত্ আসা বিভিন্ন কাজ এর যাচাইকার্য সম্পন্ন করার জন্য মস্তিষ্ক এগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন সংকেত হিসেবে গ্রহণ করলেও এদের ফোকাসকে লঘু করে তোলে। অর্থাত্, এক সাথে একাধিক কাজের সংকেতগুলোকে মস্তিষ্কে প্রেরণ করা সম্ভব হলেও মস্তিষ্ক তার নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ঐ সংকেতগুলোর তাত্পর্যকে লঘু করে গ্রহণ করে, ফলে এগুলোর স্থায়িত্ব এবং গতি দু’টোই কম হয়। লেভিটিন বলেন, আমাদের মস্তিষ্কে বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরন এবং তাদের মধ্যবর্তী বহু ট্রিলিয়ন আন্ত-নিউরন সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি সেকেন্ডে মানুষের মস্তিষ্ক কেবলমাত্র একটি বিশেষ কাজই করতে পারে। তাই, একই সময়ে একাধিক কাজ করা বলতে আমরা যা বুঝি আসলে তা হলো পূর্ববর্তী কাজকে বন্ধ রেখে পরবর্তী কাজ করা, তারপর সেটাকে বন্ধ রেখে অপর একটি কাজ করা অথবা পূর্ববর্তী কাজে মনযোগ ফিরিয়ে আনা। এভাবে অতিদ্রুত চিন্তা ও কাজের বিষয় পরিবর্তনের কারণে আমাদের মস্তিষ্ককে বিরামহীনভাবে চক্রায়ণ, বিপরীত চক্রায়ণ এবং পুনঃচক্রায়ণ ক্রমে কাজ করতে হয়। ফলে বেশকিছু দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাকে আমাদের আপন করে নিতে হয়, যেমন:

অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের মধ্যে বিরক্তি এবং ক্লান্তির উপসর্গ দেখা দেয়; কাজের প্রতি একাগ্রতা বা নিবিষ্টতা বাধাগ্রস্ত হয়; ক্রমশ মাথা ব্যথা, হতাশা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়; পরিচিত মানুষের নাম আর চেহারা মনে করার ক্ষমতা হ্রাস পায়; প্রায়শই কাজের সময়সূচি মনে রাখতে পারা যায় না; ইত্যাদি। বলতে গেলে এখন আমাদের ২৪ ঘণ্টায় ৭২ ঘণ্টার কাজ করতে হয়। এমন অবস্থায় কিছু কৌশল অবলম্বন করে আমরা মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের মস্তিষ্ককে রক্ষা করতে পারি। যেমন: যখন তখন এলোমেলোভাবে ই-মেইল বা ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক না করে প্রতি চার/পাঁচ ঘণ্টা পর পর নিয়মানুসারে চেক করা যেতে পারে। ফেসবুকে চ্যাটিং করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। ফলে, চ্যাটিং গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করার পরে করলে কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় না। অতি জরুরি নয় এমন ফোন কলগুলো দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে করার জন্য ঠিক করে রাখলে শুধু ফোনে খবরা-খবর নেয়ার কাজটির জন্য অন্য কাজগুলোর ক্রম নষ্ট হয় না।

গবেষক ল্যারি কিম বলেন, মাল্টিটাস্কিং আমাদের আইকিউ কমিয়ে দেয়। আপনার হাতের কাজটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফেসবুক বন্ধ রাখুন, শুধু নির্দিষ্ট সময়ে ই-মেইল চেক করার জন্য মনে মনে শপথ করুন এবং মনের চিন্তাগুলোকে ইন্টারনেটের তথ্যভাণ্ডার থেকে সাময়িকভাবে দূরে রাখুন, এবার দেখুন দিনের সবগুলো কাজ সঠিকভাবে করেও মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আপনার মস্তিষ্ককে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।

লেখক :প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ
নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ
সৌজন্যে : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *