Skip to content

মিসরের দ্বিতীয় সুয়েজ খাল

আতাউর রহমান কাবুল
সুয়েজ খাল মিসরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত একটি কৃত্রিম সামুদ্রিক খাল। কৃত্রিমভাবে কাটা এই খাল ভূমধ্যসাগরকে লোহিত সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ১৮৫৯ সালের ২৫ এপ্রিল শুরু হয়ে ১৮৬৯ সালের নভেম্বরে শেষ হয় এর নির্মাণকাজ। সুয়েজ খাল চালু হওয়ার আগে জলপথে ইউরোপ থেকে এশিয়া যেতে-আসতে হলে পুরো আফ্রিকা ঘুরতে হতো। এখন উত্তরে ইউরোপ থেকে দক্ষিণে এশিয়া, উভয় প্রান্তে জলপথে পণ্য পরিবহনে জাহাজগুলোকে আর পুরো আফ্রিকা মহাদেশ হয়ে ঘুরে আসতে হয় না। এ খালের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মিসর, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে একাধিকবার রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। ১৯৫৬ সালে ইচ্ছাকৃতভাবে ৪০টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে সুয়েজ খালে নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয় মিসর। পরে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এ সংকটের সমাধানে পৌঁছে দেশ চারটি।

Suej-Channel

সুয়েজ খালের ব্যাপ্তি ভূমধ্যসাগরের পোর্ট আবু সাঈদ থেকে লোহিত সাগরের সুয়েজ (আল-সুওয়েজ) পর্যন্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ফরাসি কূটনীতিক ও প্রকৌশলী ফার্দিনান্দ দে লেসেপ্স ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরকে যুক্ত করে একটি খাল খননের ব্যাপারে মিসরীয় প্রতিনিধি সাইদ পাশাকে রাজি করাতে সক্ষম হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে তৈরি হয় সুয়েজ খাল। ১৮৬৯ সালে খুলে দেওয়ার পর পরই বিশ্ববাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার শুরু করে সুয়েজ খাল। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সাগরপথে যোগাযোগের একটি সহজ ও দ্রুততম পথ এটি। বিশ্বের সমুদ্রপথে বাণিজ্যের প্রায় ৭ শতাংশ সুয়েজ খালের মধ্য দিয়েই সম্পাদন হয়ে থাকে। মূলত মিসরের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস এই খাল।

শুরুতে সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কিলোমিটার, গভীরতা ছিল আট মিটার। কিছু সংস্কার ও সম্প্রসারণের পর বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ১৯৩.৩ কিলোমিটার, গভীরতা ২৪ মিটার এবং সর্বনিম্ন সরু স্থানে প্রস্থ ২০৫ মিটার। এর মধ্যে উত্তর প্রবেশ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ২২ কিলোমিটার, মূল খালের দৈর্ঘ্য ১৬২.২৫ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ প্রবেশ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার।

সুয়েজ খালের মালিকানা ও পরিচালনা মিসরের সুয়েজ ক্যানেল অথরিটির ওপর ন্যস্ত। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী, সুয়েজ খাল শান্তি অথবা যুদ্ধ-সব সময়ই যেকোনো দেশের পতাকাবাহী বাণিজ্যিক বা যুদ্ধজাহাজের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

দ্বিতীয় সুয়েজ খাল

পুরনো সুয়েজ খালের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাহাজ নিয়ে অপেক্ষা করতে হতো। তাই গত বছরের আগস্টে ৯০০ কোটি ডলারের নতুন সুয়েজ প্রকল্পের সূচনা করেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। ধারণা করা হয়েছিল, খালে নতুন করে রাস্তা তৈরিতে সময় লাগবে তিন বছর। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যে ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ আরো একটি খাল খনন শেষ।

৬ আগস্ট মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি এই খালটির উদ্বোধন করেন। বন্দরনগরী ইসমাইলিয়ায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়াঁ ওলাঁদ।

১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সুয়েজ খালের সঙ্গে ৩৭ কিলোমিটারের নতুন অংশটি কাজ করবে মূলত বাইপাস হিসেবে, যাকে বলা হচ্ছে ‘দ্বিতীয় লেন’। এ ছাড়া খালটিকে আরো গভীর এবং প্রশস্ত করা হয়েছে। নতুন এই খাল পুরনো সুয়েজ খালেরই বর্ধিত অংশ হিসেবে কাজ করবে। নতুন রাস্তাটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৯০০ কোটি ইউএস ডলার। শেয়ার বিক্রি করে এই অর্থ তোলা হয়। আর প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয় স্থানীয় কম্পানিগুলোকে।

ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি

বহুল আলোচিত দ্বিতীয় সুয়েজ খাল দিয়ে প্রথমবারের মতো মালবাহী জাহাজ অতিক্রম করেছে। মিসর সরকার মনে করছে, নতুন এই সুয়েজ খালের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ জাহাজ আনাগোনা করে, নতুন খাল খুলে দেওয়ার কারণে তার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হবে। পুরনো সুয়েজ খাল থেকে নৌ চলাচল এবং পর্যটন বাবদ মিসরের বার্ষিক আয় হতো প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। হোসনি মুবারক জমানার পতন এবং তারপর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশটিতে পর্যটনে ভাটা এসেছিল। নতুন এ সংযোগ খাল নির্মাণের ফলে বিশ্ব আন্তর্জাতিক জাহাজগুলোর অপেক্ষার সময় ১৮ থেকে ১১ ঘণ্টায় নেমে আসবে। আগে দৈনিক ৪৯টি জাহাজ এ খাল দিয়ে চলাচল করত। ৬ আগস্ট পরীক্ষামূলক মহড়ায় বেশ কিছু কনটেইনার জাহাজ খালটি অতিক্রম করে। পরীক্ষামূলক যাত্রায় নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। প্রতিটি জাহাজকে সঙ্গ দেয় নৌবাহিনীর জাহাজ। এই খালের সীমানায়ই রয়েছে সিনাই উপত্যকা, যেখানে জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে। আগামী মাসে এই জলপথ পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

মিসর সরকার আশা করছে, ২০২৩ সালের মধ্যে এই খাল দিয়ে দৈনিক ৯৭টি জাহাজ চলবে। এ ছাড়া ২০২৩ সাল নাগাদ সুয়েজ খাল থেকে বর্তমান আয় ৫৩০ কোটি থেকে বেড়ে এক হাজার ৩২০ কোটি ডলার হবে। তবে জাহাজ থেকে আয় খালের সক্ষমতার ওপর নয়; বরং সুয়েজ খালে বেশি সমুদ্রযান আসার ব্যাপারটি অনেকটাই বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সূত্র : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *