নৈসর্গিক প্রকৃতি, বিস্তর তুষারপাত, সাদা মেঘের পাহাড়, সবুজ গালিচায় মোড়ানো অনন্য ক্যানভাস। পুরোটাই হিমাচলের রূপবৈচিত্র্য। পাশেই ভারতের অন্যতম মনোমুগ্ধকর পর্যটন শহর হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালা। সকালে রোদ, বিকালে মেঘ আর রাতে প্রচণ্ড শীত। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক প্রকৃতি বিরাজ করে ছবির মতো সুন্দর ধর্মশালায়। শহুরে রুক্ষতা, কৃত্রিমতা থেকে অনেক দূরে প্রকৃতির আন্তরিক আতিথেয়তা পর্যটককে মুগ্ধ করবেই। হিমাচলের নৈসর্গিক শহর ধর্মশালা সম্পর্কে জানাচ্ছেন— আবদুল কাদের
হিমাচল প্রদেশ মানেই শিমলা, কুলু, মানালি নয়। যদিও প্রতিটি স্থানেই প্রকৃতি তার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে। তবু এর বাইরেও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ছোট্ট শহর ধর্মশালা। ভারতের হিমাচল প্রদেশের কাংরা জেলায় অবস্থান। জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হওয়াতে হিমাচলের প্রকৃতির আদি অকৃত্রিম রূপ, রস, গন্ধ কিছুটা হলেও মিশেছে অপরূপ ধর্মশালায়। খোলা নীল আকাশ, সাদা বরফে ঢাকা হিমালয়, দেবদারুতে ছাওয়া উপত্যকা, ছোট ছোট কাঠের বাড়িঘর, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কৃতির আবহের সঙ্গে পাহাড়ি মানুষের সারল্য বেশ উপভোগ্য।
ধর্মশালার ইতিহাস : ধর্মশালার অধিকাংশ মানুষই হিন্দু ধর্মের। এই ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ ও শিখদেরও বসবাস রয়েছে। অপার সৌন্দর্যেই নয়, ধর্মশালার রয়েছে একটি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক ইতিহাস। যার মূল নায়ক তিব্বতের ধর্মগুরু দালাইলামা। ১৯৫৯ সালের আলোচিত ঘটনা। তিব্বতের ধর্মগুরু দালাইলামা তিব্বত থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ভারতে আসেন। শরণার্থী হিসেবে আসা ধর্মগুরুকে ভারত সাদরে গ্রহণ করে। ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে তিনি এবং তার বেশ কিছু শিষ্য এখানে এসে বসতি গড়েন। দালাইলামা যে জায়গাটিতে থাকতেন তার নাম ম্যাকলিয়ডগঞ্জ। এটি ধর্মশালার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬,৩৮১ ফুট উঁচু এ পাহাড়টিতে অবস্থান করে দালাইলামা ও তার শিষ্যরা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতেন। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের জন্য ধর্মশালা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র স্থান। এখানের সুরম্য বৌদ্ধাশ্রমটি আগত দর্শনার্থীদের বিশেষ আকর্ষণ।
ভিসা প্রসেসিং : ভারতের ভিসা পেলে গোটা ভারত ঘুরে বেড়াতে কোনো বাধা নেই। এ জন্য বৈধ ভিসার অনুমোদন প্রয়োজন। ভিসা প্রসেসিংয়ের প্রথম শর্ত ই-টোকেন সংগ্রহ। ই-টোকেন পাওয়া মাত্র তিন কার্যদিবসের মধ্যে ভিসা প্রদান করে থাকে। ঠিকানা : ভারত হাইকমিশন, লেক ভিউ, বাড়ি ১২, সড়ক ১৩৭, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
কীভাবে যাবেন : বাংলাদেশ থেকে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় যাবার সহজ ব্যবস্থা আকাশ পথ। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ধর্মশালা কিংবা কাংরা বিমানবন্দর যেতে পারবেন। এ ছাড়া বাই রোডে কিংবা রেলপথে ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছে তারপর কলকাতা থেকে বিমানে করে দিল্লি আর দিল্লি থেকে বাসে সরাসরি হিমাচল প্রদেশ যেতে পারবেন। আবার কলকাতা থেকে গাড়ি বা টয়ট্রেনে শিমলা পৌঁছে যান। শিমলা থেকে সরাসরি ধর্মশালার বাস কিংবা ট্যাক্সি পেয়ে যাবেন।
কখন যাবেন : মার্চ থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর যে কোনো সময় ধর্মশালা পর্যটকদের ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। মার্চ-এপ্রিলে অফসিজন হওয়াতে বাড়তি পাওয়া থাকছে প্রচুর বরফ আর বাহারি ফুলের সুভাষ। যারা স্নো-ফল পছন্দ করেন তারা ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে যেতে পারেন।
থাকা-খাওয়া : হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালাকে পর্যটক অধ্যুষিত অঞ্চল বললে ভুল হবে না। গোটা ভারতের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে ধর্মশালা অন্যতম। এখানকার রাস্তা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অভিজাত রুচির পরিচয় বহন করে। এখানকার কার্প ডিম, কমন গ্রাউন্ড ক্যাফে, জিমিস ইতালিয়ান চিকেন ও তিব্বত চিকেন রেস্টুরেন্ট সেরা। পাহাড়ি উপত্যকায় পর্যটকদের জন্য রয়েছে নিরিবিলি ও মনোরম পরিবেশের বিলাসী হোটেল এবং হিল রিসোর্ট।
কেনাকাটা : এখানে কেনাকাটায় রয়েছে ঐতিহ্য। রয়েছে ঐতিহ্যের লালনে গড়া নান্দনিক হস্তশিল্প, কার্পেট, ধাতব বস্তু, আকর্ষণীয় উপহার সামগ্রীসহ এক্সক্লুসিভ পোশাকের কালেকশন। এখানকার ম্যাকডিওরগঞ্জ সেন্টার স্কয়ার, কোতোয়ালি বাজার ও যোগীবাড়া রোড শপিং কেনাকাটার জন্য পর্যটকদের প্রথম পছন্দ।
জেনে রাখুন
ধর্মশালার আবহাওয়ার কোনো ধর্ম নেই। সময় অসময়ে এখানকার প্রকৃতি রূপ বদলায়। হিমাচল প্রদেশের কাছাকাছি হওয়াতে ঠাণ্ডাও যেন ঝেঁকে বসে রাতের আঁধারে। তাই গরম উপযোগী পোশাক নিতে ভুলেন না।
কেনাকাটার জন্য ধর্মশালা উপযুক্ত হলেও দাম বেশ চড়া। ভারতের অন্য প্রদেশগুলোর চেয়ে এখানে খরচ অনেক বেশি। তাই বুঝে-শুনে খরচ করাই উত্তম।
ধর্মশালা এমনিতেই পাহাড়েঘেরা অঞ্চল। তাই এখানে অ্যাডভেঞ্চার হবে না তা কি হয়! এখানে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের রয়েছে হাইকিং, রকিং ক্লাইম্বিং, প্যারাগ্লাইডিংসহ পেইন্টিং এবং মাছ ধরার মতো এক্সাইটিং সব এক্টিভিটিস।
দর্শনীয় স্থান : ধর্মশালার রূপের বর্ণনা বলে শেষ করা যাবে না। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ অবধি অপরূপ এ ধর্মশালা। মনমাতানো পাহাড়, বরফ ও মেঘ দেখে চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি আপেল-কমলার চাষ অপরূপ করে সাজিয়েছে ধর্মশালার প্রকৃতিকে। বাসুনাগ, ম্যাকলিয়ডগঞ্জ, নামক পাহাড়ে এমন বরফ দিন-রাত স্থানীয় নাগরিকসহ পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
দাল লেক : ১৭৭৫ মিটারের অপরূপ দাল লেক ডিওরও সবুজ বনের পাশেই অবস্থিত। মাত্র ২ কি. মি. দূরত্ব ম্যাকডিওরগঞ্জ থেকে। পর্যটকরা এখানে অবকাশ যাপন ছাড়াও বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযানে আসেন। পাশে বনে প্রাচীন শিবমন্দির রয়েছে।
কাংড়া দুর্গ : সবুজে ঘেরা পাহাড়ের উপরের দুর্গ ধর্মশালার ঐতিহ্য। এটি ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি যা খ্রিস্টপূর্ব ৪ শতাব্দীতে কাংড়া রাজ বংশের সদস্যরা নির্মাণ করেছিলেন। পাহাড়ের নিচের বহমান বাগাংগা নদী ও এখানকার মাঝি-মাল্লা পর্যটকদের আকর্ষণ। এখানে মহারাজা সন্সর চন্দ্র কোতাচে জাদুঘর রয়েছে। কাংড়া রাজ পরিবারের বহু ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা রয়েছে।
ভাসুনাগ জলপ্রপাত : এটিকে ভাসু জলপ্রপাতও বলা হয়। ভাসু মন্দিরের কাছাকাছি এর অবস্থান। এখানে দেবতা শিবকে উৎসর্গ করে এখানে পূজা-অর্চনা করা হয়। এটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থান ছাড়াও হিন্দু পিলম্রিগদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে কয়েকটি অপূর্ব ক্যাফেটেরিয়া ও পিকনিক স্পট রয়েছে।
কাংড়া আর্ট মিউজিয়াম : তিব্বতীয় বোদ্ধদের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শনের সাক্ষী। জাদুঘরটি উদ্বোধন হওয়ার পর থেকেই জনপ্রিয়। কাংড়া উপত্যকার সাংস্কৃতিক অতীত, কারুশিল্প, শিল্পকলা ও ক্ষুদ্র পেইন্টিং, মন্দির, ভাস্কর্য এবং স্বর্ণালঙ্কার, অস্ত্রসহ অন্যান্য প্রাচীন হস্তনির্মিত এবং রাজবংশের অনেক গুপ্তধন সংরক্ষিত রয়েছে।
নেগলি মঠ : এটি বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাইলামার ঘর। এর আশপাশে প্রবাসী তিব্বতীদের বসতি। তিব্বতের নির্বাসিত আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা সেখানে বাস করেন। এ ছাড়া অনেক তিব্বতী শরণার্থী সেখানে আশ্রয়ে রয়েছেন। ঐতিহাসিক মঠটির প্রথম খোঁজ মেলে ১৬ শতাব্দীতে।এখান থেকেই তিনি ধর্ম প্রচার করতেন। সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন