আব্দুল্লাহ আল সাফি
দেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের কাছে বর্তমান সময়ের আলোচিত স্পট হচ্ছে ‘সাজেক ভ্যালি’। দৃষ্টি নন্দন প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে অনেকে এই স্পটকে ভারতের দার্জিলিং এর সঙ্গে তুলনা করে থাকেন।
রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন সাজেক। সাজেকের অবস্থান রাঙামাটিতে হলেও যাতায়াতের সহজ পথ খাগড়াছড়ি দিয়ে।
খুব কাছ থেকে মেঘ দেখা আর উচুঁ থেকে চারিদিকের পাহাড়ী এলাকা দেখার সুযোগ হয় শুধুমাত্র সাজেকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন সাজেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উচুঁতে অবস্থিত। রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে।
প্রাকৃতিক কারণে অনেকসময় একইদিনে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের আমেজ মেলে সাজেকে। প্রচণ্ড গরম, ঝুম বৃষ্টি আর রাতে কম্বল গায়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সাজেকমুখী পর্যটকদের ঢল নামছে।
বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটারের দূরের সাজেকের পুরোটাই পাহাড়ী পথ। বিদেশে গিয়ে অনেকেরই হয়তো বড় আকারের রোলার কোস্টারে চড়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের সৌভাগ্য হয় না, কিন্তু সাজেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া প্রতিটি পর্যটক পাবেন প্রাকৃতিক রোলার কোস্টারের চড়ার অভিজ্ঞতা।
খাগড়াছড়ি থেকে দিঘীনালা হয়ে বাঘাইহাট, মাচালং পেরিয়ে সেই মায়াবী সাজেক। মাইল হিসেবে দূরত্ব খুব বেশি না হলেও পুরোটা পথ জুড়ে সবুজ পাহাড় আর মেঘের কোল ঘেঁষে থাকায় প্রায় চার ঘন্টার রোমাঞ্চকর ভ্রমণের ক্লান্তি আর উত্তেজনার পরে সেই কাঙ্খিত ভ্যালি। কুয়াশা আর শীতের সকালে কিছুটা উষ্ণতা নিয়েই বিরতি শেষে যাত্রা করতে হয়।
চাঁদের গাড়ি, সিএনজি অথবা মোটরসাইকেলে করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় সাজেকে। যাত্রাপথ বেশ দূর্গম হওয়াতে ড্রাইভার-যাত্রীদের ক্লান্তি সামলাতে ২/৩ দফা বিরতি দিয়ে পৌঁছাতে হয় গন্তব্যে। প্রথমে বাঘাইহাট আর পরে মাচালং বাজারে স্বল্প-বিরতিতে পাহাড়ী কলা, ডাব আর পেপে কিনে আবার যাত্রা শুরু করে থাকেন পর্যটকরা। রাস্তার পাশের অল্প সংখ্যক চায়ের দোকানের লম্বা লাইনে দাড়িয়েও চা ভাগ্য অনেকেরই হয় না।
একটি বিষয় খেয়াল রাখা উচিত, সাজেকে দিনের বেলা সবসময় প্রবেশ করা যায় না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ডের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সাজেকে প্রবেশ করে থাকে পর্যটকবাহী যানবাহন। ফেরার সময়ও একই অবস্থা। প্রচণ্ড ধৈর্য্য আর দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা সেনা ও বিজিবি সদস্যদের তল্লাশি-জিজ্ঞাসাবাদকে পর্যটকরা সহযোগীতার মন নিয়ে মেনে নিয়ে থাকেন। সেনা ক্যাম্প ও সেনা স্থাপনার ছবি তোলা বিশেষভাবে নিষিদ্ধ।
চাঁদের গাড়ির ছাদে বসে সাজেক ভ্যালির পথের দু’পাশের বিশাল সমৃদ্ধ বনভূমি আর পাহাড়ী নদী দেখতে পছন্দ করেন পর্যটকেরা। তবে উচ্ছসিত হয়ে অসাবধনতায় যেনো কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেদিকে সাবধান থাকা জরুরি।
পথের দু’পাশের আদিবাসীদের বাড়িঘরের সামনে আদিবাসী শিশুদের অনবরত হাত নেড়ে স্বাগত জানানোকে সাড়া দিতে, অনেক পর্যটককেও শিশু হয়ে যেতে দেখা যায়। অনেকে সাথে নিয়ে যাওয়া চকলেট ও শুকনো খাবার ছুড়ে দিয়ে থাকেন ওইসব শিশুদের দিকে।
সাজেক ভ্যালিতে ঢোকার মুখে সেনা ছাউনিতে পর্যটক টিকেট কিনে প্রবেশ করতে হয় সবাইকে।
সাজেকে প্রবেশ মুখেই সেনা বাহিনী পরিচালিত ‘সাজেক রিসোর্ট’, থাকা-খাওয়ার খরচ রাজধানীর অভিজাত হোটেলের মতই। সাজেকের প্রতিটি বাড়ি লাল নয়তো সবুজ রঙে রাঙানো। সাজেক ভ্যালিতে মূলত লুসাই,পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা আদিবাসীদের নিয়ে ‘রুইলুই’ ও ‘কংলাক’ নামে দুটি পাড়া বা বসতি রয়েছে।
পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য সাজেকে রয়েছে পর্যাপ্ত রিসোর্ট ও হোটেল। সকাল-সন্ধ্যায় জানালা খুলে মেঘ দেখার সুযোগ বিনামূল্যে আর জুমের বিশেষ সবজি দিয়ে পাহাড়ী খাবার পাওয়া যায় সুলভে।
পিকনিকের জন্য রয়েছে ‘ঝাড়ভোজ’ নামের তিনটি ছাউনি বিশিষ্ট আলাদা পিকনিক স্পট। এখানে প্রবেশের জন্যও আলাদা করে টিকেট করতে হবে।
রুইলুই পাড়ার নিচ থেকে প্রধান উপত্যকার অংশ শুরু। রুইলুই পাড়া থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা পথ কংলাক পাড়া। কংলাকের পাথরচূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো সাজেক ভ্যালি চমৎকারভাবে দেখা যায়। সাজেকের তিনটি হেলিপ্যাড থেকেও সাজেকের অনেকটা ও আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়।
কংলাক পাড়াতে খুব অল্পসংখ্যক লুসাই ও পাংখোয়া পরিবার বাস করে। ইদানিং কিছু ত্রিপুরা পরিবার সেখানে বাস করেন। পর্যটকদের পদচারণায় তারা অনেকসময় বিরক্ত হন আবার অনেকসময় সাদরে বরণ করে নেন। আদিবাসীদের ছবি তোলার ব্যাপারে তাদের অনুমতি নেওয়াটা সাধারণ ভদ্রতা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা পুরোটাই রুইলুই পাড়াতে। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত গির্জা, ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয় (সরকারী) আর সাম্প্রতিক সময়ের ডিজিটাল সেন্টার, গণ পাঠাগার আর গণ শৌচাগারের দেখা মিলবে রুইলুই পাড়াতে। সাজেকের একমাত্র মসজিদটির অবস্থান রুইলুই পাড়ার শেষ প্রান্তে বিজিবি ক্যাম্পের সামনে অবস্থিত।
সাজেকের সকাল, দুপুর, বিকেল-সন্ধ্যা ও রাতের চিত্র উপভোগ করতে হলে সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে কংলাক পাড়াতে পর্যটকদের হেঁটে বেড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে একদিনের বদলে অন্তত দুইদিন অবস্থান করলে সাজেকের আসল সৌর্ন্দয্য দেখা যাবে। পুরো সাজেক মাত্র দেড় থেকে দুই ঘন্টার মধ্যে ঘুরে দেখা সম্ভব হলেও উঁচুনিচু পথে অনেকে সিএনজি ও চাঁদের গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন সাজেকের ভেতরে।
বিদ্যুতহীন সাজেকে সম্প্রতি সৌরবিদ্যুত ব্যবস্থায় স্ট্রিটল্যাম্প ও রিসোর্টের সামনের অংশ আলোকিত করা হয়ে থাকে। মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ও ল্যাপটপ চার্জ করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই সাজেকে। কিছু হোটেল-রিসোর্টে জেনারেটর দিয়ে চার্জ করার সুবিধা থাকলেও তা বেশ সময় সাপেক্ষ। সব মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও নেই সাজেকে, শুধুমাত্র রবি ও টেলিটক কাজ করে সেখানে। পাওয়ার ব্যাংক ও অতিরিক্ত ব্যাটারি নিয়ে যাওয়াটা পর্যটকদের জন্য সুখকর হবে, কারণ খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথ আর সাজেকের বিভিন্ন অংশের ছবি-ভিডিও করে রাখতে না পারলে আফসোস হবে।
যে লাল রিসোর্টটি দেখে সাজেককে মনে রাখেন পর্যটকেরা, সেই ‘রুন্ময় রিসোর্ট’ সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত। ৪টি থাকার কক্ষ, খাবার হোটেল ও ঝুলন্ত পার্কের কারণে রুন্ময়ের আশেপাশেই পর্যটকদের বেশী দেখা যায়। তবে রুন্ময়ে প্রবেশের জন্য আরেক দফা টিকেট কাটতে হবে সবাইকে।
পাশে থাকা হেলিপ্যাড ও তীর নিক্ষেপের স্থান পর্যটকদের ছবি-ভিডিও করার আদর্শ স্থান। হেলিপ্যাডের ওপরে দাড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত না দেখলে অনেকটাই মিস করবেন পর্যটকেরা। নীচে ও আশেপাশের পাহাড়ে রোদ-ছায়া-মেঘের খেলা দেখে পর্যটকেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। রাতের সাজেকের সৌর্ন্দয্য আরেকরকম, পাহাড়ে চাঁদের আলোর অপরুপ দৃশ্য দেখতে অনেকে পূর্ণিমায় ছুটে যান সাজেকে।
সদ্য বিবাহিত দম্পতি থেকে শুরু করে দলবেঁধে আনন্দ করতে যাওয়া সকলের জন্য দারুণ উপভোগ্য অপরুপ সৌর্ন্দয্যের মায়াবী ‘সাজেক ভ্যালি’। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা আর পর্যটক সহায়ক পরিবেশের কারণে শীত ও বর্ষাকালে পর্যটকেরা বেশী ভিড় করে থাকেন।
প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয্য ও পরিবেশ যেনো ঠিক থাকে সেদিকে খেয়াল রেখে ভ্রমণ করলে সাজেক হয় উঠতে পারে একটি আন্তজার্তিকমানের পর্যটন এলাকা। সৌজন্যে: চ্যানেল আই