সুন্দরবনের দুবলার চরে আলোরকোল নামক স্থানে রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে প্রায় শত বছর ধরে। প্রতিবছর বাংলা কার্তিক মাসের শেষে বা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমদিকের ভরা পূর্ণিমার সময় এ রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূর্ণিমার জোয়ারের নোনা পানির স্নানে তাদের পাপ মোচন হয়ে মনষ্কামনা পূর্ণ হবে এমন বিশ্বাস নিয়ে এ রাস মেলায় যোগ দিলেও সময়ের ব্যবধানে এখন তা নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকায় করে তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীরা এসে সমবেত হয় দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। আসে অসংখ্য বিদেশি পর্যটকও। উৎসবের সময় কুটির শিল্পের মেলাসহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় দুবলার চরে। গত ২ নভেম্বরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। রাস মেলা থেকে ঘুরে এসে লিখেছেন অরনিতি সরকার
সাগরকে সাক্ষী করে হাজারও ফানুস
বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম প্রধান পার্বণ রাস উত্সব দুবলার চরের আলোরকোলে নতুন মাত্রায় সাড়া ফেলেছে। সাগর, প্রকৃতির অভাবনীয় সৌন্দর্যের মাঝে পূণ্য অর্জন আর আনন্দ সঞ্চার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আগে থেকেই যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করেন দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীরা। কার্তিক-অগ্রহায়ণের শুক্লপক্ষের ভরা পূর্ণিমায় সাগর যখন উছলে ওঠে, লোনা পানিতে ধবল চন্দ্রালোক ছলকে অপার্থিব সৌন্দর্য রচনা করে, চন্দ্রিমার সেই আলোকমালায় সাগর-দুহিতা দুবলার চরের আলোরকোল মেতে ওঠে রাস উত্সবে। সেখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেন পূণ্যার্থীরা।
তারা সাগরকে সামনে নিয়ে নির্জনে কৃষ্ণপূজার সঙ্গে দেবতা নীল কমল আর গঙ্গাদেবীর আরাধনায় নিমগ্ন হন। পাপ মোচন করেন সমুদ্র স্নানে। সূর্যোদয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেন ফল-ফুল। অতঃপর ঢাক-ঢোলক, কাসা-মন্দিরা বাজিয়ে ভজন-কীর্তনে নিনাদিত করেন চারপাশ। পূজা-অর্চনার ফাঁকে সূর্যাস্তের পর সাগরকে সাক্ষী করে আকাশের বুকে উড়িয়ে দেওয়া হয় ফানুস।
যেভাবে সূচনা রাস মেলার
লোকালয় থেকে বহুদূরে সুন্দরবনের দক্ষিণে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে বিচ্ছিন্ন চর দুবলার আলোরকোলের এই রাস উত্সব ধারণ করে আছে বহু বছরের ইতিহাস। ধারণা করা হয়, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে এক হিন্দু সাধু এই মেলা শুরু করেছিলেন। এই সাধু ২৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে গাছের ফল-মূল খেয়ে জীবনযাপন করতেন। অন্য মতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপ মোচন এবং পূণ্য লাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান। সেই থেকে শুরু হয় রাস মেলা। আবার কারও কারও মতে, দুর্গোত্সবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাস নৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ উপলক্ষেই দুবলার চরে পালিত হয়ে আসছে রাস উত্সব। আব্দুল জলিলের সুন্দরবনের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশকে ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রামের জনৈক হরিচাঁদ ঠাকুর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পূজা পার্বণাদি ও অনুষ্ঠান শুরু করেন দুবলার চরে গিয়ে। তারপর থেকে মেলা বসছে। লোকালয়ে এই মেলা নীল কমল নামে পরিচিত।
রাস মেলায় যেতে…
দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এ বছর সুন্দরবনের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনা অঞ্চল থেকে ৮টি পয়েন্ট দিয়ে রাস মেলায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। এরমধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চল দিয়ে ৩টি রুট ছিল। এগুলো হলো বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলানদী-বলনদী-পাটকোস্টা হংসরাজ নদী হয়ে দুবলার চর। কদমতলা থেকে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর ও কৈখালী স্টেশন হয়ে মাদারগাং, খোপড়াখালী ভাড়ানী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী। এসব পয়েন্ট দিয়ে অসংখ্য লঞ্চ, নৌকা ও ট্রলারে করে হাজার হাজার দর্শনার্থী আলোরকোলের উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশ করেন। দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীদের জান-মালের নিরাপত্তাসহ হরিণ শিকার রোধে বনরক্ষীদের পাশাপাশি পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড নিয়োজিত ছিল। তবুও যেন হয়রানির থেকে রক্ষা পাননি রাস মেলার অনেক পূণ্যার্থীরা।
যা হয় মেলাতে
যেখানে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন আর বনের হিরণময় নিস্তব্ধতা ছাড়া কিছুই নেই সেই সাগরের চর ৩ দিনের রাস উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। আলোয় আলোয় ভরে যায়। হিন্দু নর-নারী এ মেলাকে গঙ্গাসাগরের মতো তীর্থস্থান মনে করে। এই মেলাকে অনেকে মগদের মেলা বলে মনে করে থাকেন। লাখ লাখ ভ্রমণপিপাসু মানুষ সুন্দরবন এবং সাগর দর্শনে আনন্দ উপভোগের জন্য যান সেখানে। সমুদ্র কোলে ৫ মাইল প্রশস্ত বালুকাবেলায় পদব্রজে ভ্রমণ করেন। সৌন্দর্যপিপাসুদের ক্যামেরায় বন্দি হয় আশ্চর্য সুন্দর সব চিত্র। তীর্থযাত্রী ও ভ্রমণকারীরা নৌকায় রান্না ও আহার এবং বালুচরে ঘুরে বেড়ান।
সেইসাথে এই ৩ দিন বনের ভেতরে নির্ভয়ে চলাফেরা করেন মেলায় আগত মানুষ। শতশত নৌকা-ট্রলার ও লঞ্চের সমাগমে স্থানটি সজ্জিত হয়ে ওঠে আলোর ঝলকে। সন্তানহীন ধর্মানুরাগী হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দুবলার মেলায় মানত করেন এবং মেলায় এসে মানতকারীরা আনুষাঙ্গিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে থাকেন। মেলায় বাদ্য, নৃত্য, গীতসহ নানা প্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। বসে কুটির শিল্পের দোকান ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, ফল-ফলাদি, মিষ্টান্ন, মনোহারির সামগ্রীর দোকান। এ মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও আসেন ভারত, আমেরিকাসহ নানা দেশের পর্যটক।
ব্যতিক্রমধর্মী প্রচার অভিযান
এবারের ‘রাস মেলায়’ বেশকিছু সংগঠন চালিয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী প্রচার অভিযান। দুবলার চরে ‘সুন্দরবন উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় নবীন-প্রবীণ সংহতি’ শীর্ষক এ প্রচার অভিযান চালাচ্ছে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম, সাতক্ষীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক, শ্যামনগর উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কেন্দ্র, সামাজিক বনবিভাগ, কৃষি বিভাগ, স্থানীয় সরকারসহ ২২টি জনসংগঠন। ব্যতিক্রমধর্মী এই প্রচার অভিযান সম্পর্কে সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের সভাপতি মারুফ হোসেন মিলন বলেন, ‘উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় বরাবরই মায়ের মতো ভূমিকা পালন করে সুন্দরবন। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট নানা কারণে সুন্দরবন উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য এখন বিপদাপন্ন। তাই আমাদের এই প্রচার অভিযান।’ সাতক্ষীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিমের সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ হাসান ও প্রচার সম্পাদক নুরুল হুদা বলেন, ‘রাস উৎসব গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রাণের উত্সব। এ উত্সবকে কেন্দ্র করে দুবলার চরের রাস মেলায় আগমন ঘটে হাজার হাজার মানুষের।’
বিশেষ আকর্ষণ শুঁটকি পল্লী
রাস মেলার সময়ে আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে শুঁটকি পল্লী। সময়টা শুঁটকি মৌসুম। এই মৌসুমকে ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের দুবলার চর জেলে পল্লী। মাছ বাছাই, কাটাসহ জেলে ও ব্যবসায়ীদের সমাগমে এখন ভিন্ন আমেজ বইছে সাগরপাড়ের দুর্গম এ চরাঞ্চলে। গভীর সমুদ্রে নানা প্রজাতির মাছ আহরণ আর শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন জেলে, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। এ পল্লীতে উৎপাদিত হচ্ছে কীটনাশক ও বিষমুক্ত শুঁটকি। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের প্রসার ঘটছে না। জেলে ও ব্যবসায়ীরা জানান, সাগরপাড়ের ৬টি চরে এ মৌসুম শুরু হয় মূলত অক্টোবর মাসে। সমুদ্রযাত্রাসহ নানা প্রস্তুতিতে অনেক সময় লেগে যায় জেলে-ব্যবসায়ীদের। তাই দু-মাস আগে মৌসুম শুরু হলেও জেলেরা মত্স্য আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া শুরু করেছেন নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে। কয়েক হাজার জেলে এখন সুন্দরবনের সাগর উপকূলে মত্স্য আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ মাসব্যাপী থাকে এ মৌসুম। সৌজন্যে: ইত্তেফাক