নাবীল অনুসূর্য
ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার রাস্তাগুলোর নতুন করে নম্বর দেওয়া হয়েছে, বেশ অনেক দিন হয়ে গেল। তবু ১১ নম্বর রাস্তাটি পুরনো নম্বরেই পরিচিত। ৩২ নম্বর। এই কৃতিত্ব রাস্তাটির নয়, একটি বাড়ির। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরেই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ছিল। সেখানেই তিনি থাকতেন। স্বাধীন দেশে ফিরে এসেও তিনি সেখানেই থেকেছেন। নতুন দেশটির রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি সরকারি বাসভবনে থাকেননি। দিন শেষে ফিরে আসতেন তাঁর নিজের ৩২ নম্বরের সেই বাসাতেই। বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেনও এই বাড়িতেই। পরে তাঁর স্মৃতিধন্য এই বাড়িতেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’।
বাড়িটিতে ঢুকতেই নিচতলায় প্রথম যে ঘরটি সেটি ছিল ড্রয়িংরুম। এই ঘরে বসেই বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গে কথা বলতেন। রাজনীতির সহকর্মীদের সঙ্গে, সাংবাদিকদের সঙ্গে কিংবা যারা একবার দেখতে আসত, তাদের সঙ্গে। ঘরটিকে এখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের নানা ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। লাগোয়া ঘরটি ছিল তাঁর পড়াশোনার ঘর। তিনি পড়তেন মূলত রাজনীতির বই। ইতিহাসের বই। মার্ক্সবাদের বই। সান ইয়াত সেন-লেনিনের বিপ্লবের ইতিহাসের বই। মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লব-আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাসের বই। এই ঘরের অবশ্য একটি বিশেষ গুরুত্বও আছে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে, এ ঘর থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। ওপরতলার প্রথম ঘরটি ছিল লিভিং রুম। পাশের ঘরটি বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘর। এর পাশেরটি শেখ রেহানার। এই ঘরগুলোতে বঙ্গবন্ধুর অনেক পারিবারিক ছবি রাখা আছে। আছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র। তাঁর ব্যবহৃত চশমা, পাইপ,
থালা-বাসন, চেয়ার-টেবিল, বিছানা। তাঁর নিজ হাতে লেখা কিছু কাগজপত্র।
এই বাড়িতে বঙ্গবন্ধু বাস করতে শুরু করেন ১৯৬১ সালের অক্টোবর মাস থেকে। সপরিবারে। তাঁর পারিবারিক এবং রাজনৈতিক জীবন-দুটোর সঙ্গেই বাড়িটির তাই একদম নাড়ির যোগ। এ বাসাতেই তাঁর সঙ্গে সলাপরামর্শ করতে এসেছেন দেশের যত রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী। বিভিন্ন সময় দেশের ছাত্র-জনতা তাঁর এই বাসার সামনে ভিড় করেছে, তাঁর দিকনির্দেশনার জন্য। অসংখ্যবার তিনি জমায়েত
হওয়া ছাত্র-জনতার উদ্দেশে এই বাসার দোতলার বারান্দা থেকেই হ্যান্ডমাইকে বক্তৃতা দিয়েছেন। এমনকি তাঁকে অনেকবার গ্রেপ্তারও করা হয়েছে এই বাসা থেকে।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হয়। বাঙালির মনের মধ্যে দানা বাঁধতে থাকা অসন্তোষও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে অপশাসনের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। শেখ মুজিবুর রহমান দিন দিন আরো বেশি করে গণমানুষের নেতা হয়ে উঠতে থাকেন। আর ৩২ নম্বরের এই বাড়িও হয়ে উঠতে থাকে মুক্তির প্রতীক। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো ৩২ নম্বরের এই বাড়িও গণমানুষের ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে থাকে। গণমানুষের এই ভরসার প্রতিদানও বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন। ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বাংলার মানুষকে সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আর এসব আন্দোলন-সংগ্রামের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছিল এই ৩২ নম্বরের বাড়িতেই। এমনকি ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক অলিখিত ভাষণে যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ইঙ্গিত দেবেন, তাও ঠিক করেছিলেন এই বাড়িতেই।
এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেষবারের মতো গ্রেপ্তার হন ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। আবারও বাস করতে শুরু করেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে। সরকারি বাসভবনেও ওঠেননি তিনি, সরকারি নিরাপত্তাও নেননি নিজের জন্য।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। এক রাতেই ঘাতকের নির্মম বুলেট মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের ১৭ সদস্যকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সে রাতে প্রাণ দেন তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব, তিন ছেলে-শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, বড় দুই ছেলের দুই স্ত্রী সুলতানা, রোজিসহ সবাই। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান কেবল দুই মেয়ে-শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দোতলার ঘরগুলোর সামনে একটা বারান্দা আছে। এই বারান্দার গোড়াতেই সিঁড়ি। সে রাতে চেঁচামেচি শুনে এই সিঁড়ি দিয়েই নেমে আসছিলেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ নতুন করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেও যেমন শেষ করতে পারেননি, তেমনি সেই সিঁড়ি দিয়ে নামাটাও তাঁর শেষ হয়নি। মাঝপথেই ঘাতকদের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় তাঁর শরীর। নিজ বাসায় খুন হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর শরীরের রক্ত জমাট বাঁধে সিঁড়িতে। শুকিয়ে কালো হয়ে যায়। সিঁড়িতে সেই রক্তের দাগ এখনো আছে। দাগগুলোতে কাচ লাগানো আছে। যাতে যুগের পর যুগ বাংলার মানুষ গিয়ে দেখতে পারে, কোথায় কিভাবে আমাদের জাতির পিতা খুন হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে, ১৯৮১ সালে বাড়িটি তাঁর কাছে হস্তান্তর করা হয়। যে বাড়ির যত্রতত্র বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকারীদের বুলেটের চিহ্ন। যে বাড়িজুড়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের রক্তের ছোপ ছোপ কালচে দাগ। পরে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করে বাড়িটি সে ট্রাস্টকে প্রদান করেন শেখ হাসিনা। বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপ দেয় ট্রাস্ট। নামকরণ করা হয়-‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’। জাদুঘর বানানো হলেও, মূল বাড়িটির কাঠামো যতটা সম্ভব অবিকল রাখা হয়েছে। ঠিক যে বাড়িটাতে বঙ্গবন্ধু থাকতেন, সে রকম। সে বাড়িটার সবগুলো ঘর অবশ্য এখনো দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি নতুন আরেকটি ছয়তলা ভবন বানানো হয়েছে। সে ভবনের প্রথম তিন তলায় ধরে রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবন। চতুর্থ তলায় জাদুঘরের গ্রন্থাগার ও দপ্তর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর খোলা থাকে বৃহস্পতি থেকে মঙ্গলবার, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। সাপ্তাহিক বন্ধ বুধবার। প্রবেশ মূল্য পাঁচ টাকা। সূত্র : কালের কণ্ঠ