ফেরদৌস জামান
একদিন হঠাৎ এক বিকেলে সংবাদ পাই পরশুদিন বরিশাল যাওয়া হচ্ছে। রকেটের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। বিশেষ ব্যাবস্থায় শাওন বিআইডাব্লিউটিএ’র মতিঝিল কার্যালয় থেকে পাঁচটি টিকিট কাটতে সক্ষম হয়েছে। সহজে নাকি টিকিট মেলে না। কখনও কখনও ওজনদার রেফারেন্সেরও প্রয়োজন পড়ে, তা স্বাভাবিক- রকেট বলে কথা! তখনও জানি না, কে কে যাচ্ছি? নির্দিষ্ট তারিখে টঙ্গী থেকে রওনা দেই, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছতে যেখানে কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা সময় লেগে যাওয়ার কথা, সেখানে লাগল মাত্র দেড় ঘণ্টা। গিয়ে দেখি অন্যরা আগেই এসে বসে আছে। অনিক, মাকসুদ, শাওন এবং শুভ। ৪র্থ জনের সাথে সেদিনই প্রথম পরিচয়। জানা মতে রাষ্ট্রের সেবামূলক যতগুলি খাত রয়েছে তার মধ্যে একমাত্র বিআইডাব্লিউটিএ’র রকেটেরই কোনো লোকসান নেই। সরকার চাইলে কথাটি গর্বের সঙ্গে বলতে পারে। সদরঘাট থেকে স্টিমারে চলাচলকারী লোকেরা বাহনটিকে সাধারণত ‘রকেট’ বলে। সব শেষে মাত্র চারটি রকেট চলাচলের উপযোগী ছিল- অস্ট্রিচ, লেপচা, মাসুদ এবং গাজী (সম্প্রতি বহরে যুক্ত হয়েছে স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত নতুন আরও দুইটি)।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি স্টিমারগুলো এখনও সেই সাবেকি ঠাঁটেই চলছে। আমাদেরটির নাম ‘অস্ট্রিচ’। অত্যন্ত পরিপাটি অস্ট্রিচের অভ্যন্তরের পরিবেশ। চারপাশে কেবিন, ঠিক তার মাঝে পুরু গালিচা বিছানো মেঝেতে স্থাপন করা টানা লম্বা একটি ডাইনিং টেবিল। পাশে কয়েকটি সোফাও রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে সার্বক্ষণিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত টিপটপ ব্যবস্থাপনা। সবখানে আভিজাত্যের ছোঁয়া। কেবিনের পেছনে টানা বারান্দা। একেবারে জলের ওপর পর্যন্ত ছড়ানো। বারান্দার মাঝামাঝিতে দুই পাশে দুইটি বিশাল আকারের চাকা। চাকার ওপরের দিকটা প্রায় ছাদ বরাবর উঁচু। স্কুলে পড়তে কোন শ্রেণীতে যেন বাংলা বই-এ এক গল্প ছিল। গল্পের প্রথম পাতাতেই দেয়া ছিল স্টিমারের বড় একটি ছবি। গল্পের চেয়ে গল্পের ছবিটাই বেশি টানতো। ভাবতাম এত্তো বড় নৌকা তাও আবার চাকাওলা! ধরেই নিয়েছিলাম স্টিমার চাকার ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। কিন্তু একটি বিষয় কখনও মেলাতে পারতাম না- নদীর তলদেশ তো সমতল নয়, কোথাও গভীর তো কোথাও উঁচু। তাহলে কীভাবে চলে? এইবার আমার ভাবনার ঘোর কাটল, চাকার মাঝে সংযুক্ত রয়েছে অনেকগুলো প্যাডেল, যার সাহায্যে জল কেটে কেটে রকেট এগিয়ে চলে। সব শেষে সম্মুখের ফাঁকা অংশে টেবিল চেয়ার পাতা। চাইলে আবার ছাদেও যাওয়া যায়, রেলিং দিয়ে ঘেরা সংকীর্ণ দাঁড়াবার জায়গা রয়েছে।
নির্দিষ্ট সময় সন্ধ্যা ছয়টায় ছেড়ে দিল অস্ট্রিচ। চায়ের সাথে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর কাঠিতে ফোড়ানো কোরাল মাছের কাবাবে সেরে নেয়া হল সান্ধ্যকালীন নাস্তা। অনিক ও শুভ’র পৈত্রিক বাড়ি বরিশাল, যার সুবাদে আমাদের পক্ষে স্টিমার সংস্কৃতি বুঝে নিতে সহজ হল। রাত সাড়ে নয়টায় খেয়ে নিলাম রাতের খাবার। দেখলাম যাত্রা শুরুর পর পরই সকলে ফ্রেশ হয়ে বসে পড়ল ডাইনিং-এ। চলল দীর্ঘ আড্ডা। এক দল মিশে গেল আরেক দলে অথবা একজন আরেকজনের সাথে। গল্পে গল্পে চলল পেয়ালার পর পেয়ালা চা। গল্পের প্রসঙ্গের কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে ভূত-প্রেত, হাসি, কৌতুক এমন কি সঙ্গীতের আসর পর্যন্ত! দেখা যায় এই গল্প বা আড্ডার আসর থেকে নতুন পরিচিত অনেকেই পরস্পরের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। পৌঁছে যায় দাওয়াত দেওয়া নেওয়ার পর্যায়ে। তেমনই এক ঘটনা অবশ্য আমাদের বেলাতেও ঘটে গেল।
রাতের খাবারের পর পাঁচ জনে গিয়ে বসি সম্মুখের ফাঁকা জায়গাটায়। ছলাৎ ছলাৎ ছরর ছরর শব্দ উঠেছে দুপাশের প্যাডেল ভর্তি চাকায়। এগিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রিচ। চারদিকে শুধু পানি আর পানি, আশপাশ দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে মিটমিটে রঙ্গিন আলোয় বর্ণিল দু-একটি লঞ্চ। এদিকে অস্ট্রিচ চলে একই গতিতে, সহসা গতি পরিবর্তন না করা তার ঠাঁটের অংশ। বাতাসের ঝাপটা অনবরত শরীরে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই ডাইনিং- এ বসে গলা চেপে ধরে গান গেয়ে অস্বস্তি জমা হয়ে রয়েছে, তার ওপর দিয়ে বাতাসের উন্মত্ত খেলা। যে যেভাবে পারি একের পর এক গাইতে থাকি গান। মাঝে মাঝে গল্প। এমনি করে এক পর্যায়ে রাতের সমস্ত গভীরতা এসে যেন লুটে পড়ল খোলা জায়গাটায়। সাথে সাথে গলাও চড়ে গেল উঁচু থেকে আরো উঁচুতে। আমাদের ফাটা বাঁশের মতো হেরে গলার সংগীত চর্চা শুনে এগিয়ে এলেন মাঝবয়েসী দুই যাত্রী। বাবু ভাই এবং ডন ভাই যথাক্রমে ইউএসএ এবং ইন্দোনেশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত দুই ব্যবসায়ী। তারাও টেবিল চাপড়ে সুরে তাল মেলালেন। এভাবেই চলল, রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত। ডাইনিং-এ হালকা আলাপ পরিচয় তারপর দীর্ঘ গানের আড্ডা, মাঝ রাতের পর সম্পর্ক গিয়ে ঠেকল তাদের বাড়িতে পর দিন ডিনারের নিমন্ত্রণে। যদিও শেষ পর্যন্ত সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
খুব সকালে গিয়ে নামলাম বরিশাল লঞ্চ ঘাটে। আমাদের আরেক বন্ধু সাফিনের বদৌলতে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল বরিশাল সার্কিট হাউসে। রুমে উঠে হালকা নাস্তার পর দুই ঘণ্টা বিশ্রাম শেষে দ্বিতীয় দফা নাস্তার ডাক পড়ল অনিকের নানাবাড়ি থেকে। বিএম কলেজের একটু আগে ওর নানাবাড়ি। পরোটার সাথে অনেক কিছুর মধ্যে বরিশালের বিখ্যাত রসে টইটুম্বুর গরম রসগোল্লা ও গৌরনদীর দই ছিল অনন্য দুটি পদ। বিকেল বেলা আমাদের নেয়ার জন্য চলে এলেন শুভ’র চাচা। তিনি আমাদের দেখাতে নিয়ে যাবেন শুভ’র বাজার ও কাউয়ার চর। কীর্তনখোলা ঘাটে গিয়ে ভাড়া করা হয় একটি মেশিন চালিত নৌকা। পাশেই দেখলাম প্রস্তত হয়ে আছে সুন্দরবন-৭ ও সুরভী-৮ সহ বেশ কয়েকটি লঞ্চ। সন্ধ্যায় ছেড়ে যাবে ঢাকার উদ্দেশে। কি লম্বা একেকটি লঞ্চ! তিন চার তলার এই লঞ্চগুলোই রাতে আমাদের অস্ট্রিচকে পেছনে ফেলে চলে এসেছে। ওদিকে ঘাটের অপর পাড়ে একটি জেটিতে লাইটার জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করা হচ্ছে।
ফটফট শব্দে চললো নৌকা। তখনও জানি না শুভ’র বাজারে কি দেখতে যাচ্ছি? বংশের প্রথম প্রদীপ হিসেবে নাতির জন্মের সাথে সাথে জোদ্দার দাদা ঘোষণা করেন, অমুক জায়গায় একটা বাজার স্থাপন করা হবে, যার নাম হবে আদরের নাতির নামে- শুভ’র বাজার। প্রত্যন্ত চরের আশপাশ দিয়ে এগিয়ে চললো নৌকা। জলরাশির বুকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে নৌকা থামতে বলা হল। আমরা তো ভাবছি, চাচা ভাতিজা মিলে কী করে? মাঝ নদীতে নৌকা দাঁড় করানো হল কেনো? চাচা খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, এই হল শুভ’র বাজার। পনেরো বছর আগে ভাঙ্গনে বিলিন হয়ে গেছে। সাথে ভেঙে নিয়ে গেছে অনেক মানুষের স্বপ্ন। চায়ের দোকান, কাপড়ের দোকান, তরিতরকারীর দোকান সবই ছিল। মাঝি বলল, তার শ্বশুরেরও একটা দোকান ছিল। পরিবেশটা কেমন ভারি হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ধরতে হল ফিরতি পথ। সন্ধ্যা হয়ে আসায় সেদিন আর কাউয়ার চরে যাওয়া সম্ভব হল না।
যথারীতি পর দিনের গন্তব্য কাউয়ার চর। আবারও সেই মেশিনের নৌকা। কীর্তনখোলা পেরিয়ে চরে অবতরণের পর ভাড়া করা হলো তিনটি মোটরসাইকেল। নিয়ে যাবে চরের এ প্রান্ত থেকে ওদিকে সর্বশেষ পর্যন্ত, যেখানে ঢ়াড়িয়ালখা নদীর ঘাট। ভেবেছিলাম চরে অনেক কাক আছে অথবা নামকরণের শানে-নুজুলে থাকবে কাউয়া নামে কোনো লোকের গল্প। না, তেমন কিছুই খুঁজে পেলাম না। ঘন সবুজে আবৃত সম্পূর্ণ চরের বুকে পাতলা বসতি, এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে পিচ ঢালা সরু পথ। চরের বাজারে একটা মধ্যবিরতি দিলাম। সখি বিস্কুটের সাথে চা। হাড্ডির মত শক্ত সখি বিস্কুট চায়ে চুবিয়ে খেতে মন্দ ছিল না। তবে রং চা হলেও স্বাদে খানিকটা অন্যরকম। জানতে চাইলে বিক্রেতা তৃপ্তি ভরা মুখে বললেন, স্পেশাল চা তাই চিনির সাথে দেয়া হয়েছে সমান্য লবনের ছিটা। সময়টি ছিল তালের শাসের মৌসুম। ঢ়াড়িয়ালখা’র ঘাটে গিয়ে মিলল কঁচি তালের এক বিশাল মজুদ। কেবলই নৌকা থেকে নামানো হয়েছে। দাম কত বলতেই ব্যাপারী আমাদের উচ্ছ্বাস দেখে বললেন, আগে খান, কতটা পারেন দেখি। তারপর দাম যা হয় দিবেন।
দুপুরে ভরপেট খাওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাদেই নাক ডুবিয়ে তালের শাস খাওয়ায় কেউ ছাড় দিতে নারাজ। এমনিতেই এই জিনিসটি অতিরিক্ত খেলে শরীর ঢুলু ঢুলু করে। বরিশালের মাটি স্পর্শ করার পর থেকেই খাওয়ার ওপর আছি। সন্ধ্যায় বিএম কলেজ রোডে নিতাইয়ের দোকানে হানা দেয়া হল। ছোট ছোট সাইজের রসগোল্লা, এই দোকানের রসগোল্লার খবর আমাদের আগে থেকেই জানা ছিল। সুতরাং নিতাইয়ের গরম রসগোল্লা ভক্ষণের ক্ষেত্রেও নাক আর শুকনো রাখা গেল না, এখানেও নাক একেবারে ডুবিয়ে খাওয়া! অবশেষে শুভ’র চাচার বড়ি বাদশাহী ডিনার শেষে সার্কিট হাউসে ফিরতে ফিরতেই শাওনের তো যায় যায় অবস্থা! লাইন ডাইরেক্ট হলে যা হয় আর কি। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত এক পাশের বিশেষ ছোট ঘরটা ওর জন্যই বরাদ্দ রাখা হল। বেচারির চোখ এরই মধ্যে গর্তে প্রবেশ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভ্রমণ পরিকল্পনার দু-একটি আকর্ষণ বাদ রেখেই ঢাকার পথে রওনা দিতে সন্ধ্যায় আবার উঠে বসলাম রকেটে। সৌজন্যে : রাইজিংবিডি