Skip to content

রহস্যময় চরিত্র হাটসেপুট

ফারাওদের দেশ মিশর। ফারাওদের সূর্যদেব আমুনের বিশ্বাসের ছায়াতলে গড়ে উঠেছে স্ফিংস, শেয়াল দেবতা আর সমাধি পিরামিড। অবশ্য শুধু ফারাওরাই সম্রাটই ছিলেন না, অনেক সম্রাজ্ঞীও মিশরকে শাসন করে গেছেন তা ইতিহাস অনেক আগেই জেনে গেছে। নারী শাসকদের মধ্যে সম্রাজ্ঞী হাটসেপসুট অন্যতম। খুবই সুন্দরী এবং রহস্যময়তার অদ্ভুত আবর্তে বন্দী ছিলেন তিনি। নিজেকে সুন্দরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো চেষ্টা ছিল না তার। বরং বেছে নিয়েছেন ছেলেদের পোশাক। নকল দাড়িতে তাকে দেখে সবাই মনে করত কোনো পুরুষই বুঝি শাসন করছে মিসর।

Hatseputতিনি নিজেকে ফারাও বলেই পরিচয় দিতেন। সময়টা ১৪৭৯ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ থেকে খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ১৪৫৮ পর্যন্ত। অপরিসীম দক্ষতায় মিসর শাসন করেছেন রানী হাটসেপসুট। তিনি ছিলেন অন্য আট/দশজন রাজা-রানীর তুলনায় একেবারেই অন্যরকম। তিনি পরম সুন্দরী ছিলেন, ছিলেন শান্তশিষ্ট। অথচ রাজনৈতিক প্রজ্ঞারও কোনো কমতি ছিল না তার। আর এ কারণেই দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর মিসরের রাজসিংহাসন ছিল তার দখলে।

মিসরের রাজা প্রথম থুতমোস এবং রানী আহমোসের কন্যা ছিলেন হাটসেপসুট। ছোটবেলা থেকেই ভাইদের তুলনায় বাবা-মায়ের কাছে একটু বেশি প্রিয় ছিলেন তিনি। সবার প্রত্যাশা ছিল রাজার মৃত্যুর পর হাটসেপসুটের ভাই অ্যানিনেমিস সিংহাসনে বসবেন। কিন্তু অ্যানিনেমিসের সেই দক্ষতা কখনোই ছিল না।

সে সময় সিংহাসনে বসার যোগ্যতা ছিল আরেকজনের। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় থুতমোস, হাটসেপসুটের সৎ ভাই। সে সময় মিসরের রাজ রক্তের বিশুদ্ধতা ঠিক রাখার জন্য ভাই ও বোনের বিয়ের প্রথা ছিল। সেই প্রথা মেনেই হাটসেপসুট হয়েছিলেন রাজা দ্বিতীয় থুতমোসের রানী।

এভাবেই প্রায় ১৪ বছর থুতমোস আর হাটসেপসুট মিসর শাসন করেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে দ্বিতীয় থুতমোসের মৃত্যু হয়। এবার কে হবে রাজা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়ল মিসরের রাজপ্রশাসন। কারণ একটাই। হাটসেপসুট আর থুতমোস দম্পতির উত্তরাধিকারী বলতে কেবল একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে একটা মেয়ের কথা শুরুতেই ভেবে ফেলার মতো সাহস তখনকার প্রশাসনের ছিল না।

অন্যদিকে দ্বিতীয় থুতমোস রানী হাটসেপসুটকে ছাড়াও তখনকার রীতি অনুযায়ী আরও ক’জনকে বিয়ে করেছিলেন। তবে হাটসেপসুট ছিলেন আসল রানী বা রয়েল কুইন। নিয়মানুসারে তার সন্তানরাই সিংহাসনে বসার কথা। কিন্তু সন্তান তো মেয়ে! তাও আবার অপরিপক্ব।

অন্য রানীর ছেলে ছিল তবে অল্পবয়স্ক। অভিজ্ঞতার অভাবে রাজ্য শাসন যে কোনো মুহূর্তে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে হাটসেপসুটও নিজেকে রানীর আসন থেকে সরাতে চাইছিলেন না। অবশেষে ঠিক হয় তৃতীয় থুতমোস এবং হাটসেপসুট দু’জনেই সিংহাসনে বসবেন।

রানী হাটসেপসুটের অসীম দক্ষতা, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা আর যোগ্যতা সম্পর্কে মিসরীয়দের আগে থেকেই ধারণা ছিল। তাছাড়া ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রাচীন মিসর, গ্রিসের মতো অনেক দেশের চেয়ে একটা বিষয়ে মিসরীয়রা বেশ উদার ছিল। আর সেটি হচ্ছে মেয়েদের চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা। মেয়েদের ঘরের ভেতর বন্দী করে রাখার নীতিতে মোটেও বিশ্বাসী ছিল না মিসরীয়রা। হাটসেপসুটের আগেও মিসরে ফারাও হিসেবে অনেক রানী ছিলেন।

তবে এবার হাটসেপসুট একা ছিলেন না। সঙ্গে ছিলেন রাজা তৃতীয় থুতমোস। সৎ পুত্রের সঙ্গে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে রানী হাটসেপসুটকে সহজেই স্বীকার করে নিয়েছিল মিসরের জনগণ। তবে হাটসেপসুট রাজসিংহাসনে বসার প্রথম দিন থেকেই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। এটা তাকে আস্তে আস্তে অর্জন করে নিতে হয়েছে। আর রাজ্য শাসনের প্রথম দিন থেকেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দেশ শাসনের সবরকম প্রস্তুতি আর প্রজ্ঞা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল।

প্রথম দু’বছর সৎ ছেলের সঙ্গে রাজ্য ভাগ করে নিলেও পরবর্তীতে নিজেকেই ফারাও বা রাজা বলে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় খুব যে সাড়া পড়ে গিয়েছিল, এমন নয়। কিন্তু কিভাবে প্রজাদের সম্মতি নিয়ে নিতে হয় আর মন জয় করে নিতে হয়, সেটা বেশ ভালো করেই জানতেন রানী হাটসেপসুট।

সেকালের সাধারণ মানুষ ফারাওকে দেবতাদের প্রতিভু মনে করত। আর ফারাওরাও নিজেদের কোনো না কোনো দেবতার পুত্র বা কন্যা হিসেবে প্রচার করত। সবাই সেটা বিশ্বাসও করত। হাটসেপসুটও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। এক্ষেত্রে তার অভিধা ছিল ‘গডস ওয়াইফ অব আমুন’। অর্থাৎ আমুনের স্ত্রী। আর আমুন মিসরের সূর্যদেবের একটি রূপ।

সিংহাসনের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠার পরও রানী হাটসেপসুটকে প্রতিনয়ত নানারকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কখনো ভাগ্য তার সহায়ক হয়েছে। অবশ্য সেজন্য প্রতিদিনই রাজ্যে যুদ্ধ বেধে ওঠেনি। কিন্তু রানীর আত্মবিশ্বাস দেখে মনে হতেই পারে যুদ্ধ হলেও তিনিই হয়তো জয়ী হতেন। তার রাজত্বকালে অনেক সময়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করে গণতন্ত্র। কিন্তু নিজস্ব কৌশলে সবাইকে শান্ত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন রানী।

Hatseput2

মজার ব্যাপার হলো অন্য সব মিসরীয় রানী থেকে হাটসেপসুট একটি জায়গায় একেবারেই আলাদা। আর সেটি হলো যথেষ্ট সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে সত্যিকারের সুন্দরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোনো চেষ্টা ছিল না তার মধ্যে। বরং তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছেলে মানুষের ছদ্মবেশ। ছেলেদের পোশাক, নকল দাড়ি দেখে সবাই মনে করেছে চেনাপরিচিত ঢংয়ে কোনো পুরুষই হয়তো সিংহাসনে রয়েছেন।

ঠিক কি কারণে রানী পুরুষের ছদ্মবেশে সিংহাসন সামলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। নিজের কন্যাকেও তিনি পুরুষের পোশাক, নকল দাড়িতে সাজিয়ে রাখতেন। রানীর এমন পদক্ষেপের দিকে তাকালে তার প্রজ্ঞা, অন্যরকম চিন্তাভাবনা এবং সাহস সম্পর্কে অনুমান করা যায়।

মিসরে ফারাওদের যে সব মূর্তির দেখা মেলে তাতে হাটসেপসুটের পুরুষালি রূপটাই চোখে পড়বে। রানীর বেশে তিনি যদি সে সময় রাজ্য শাসন করতেন তাহলে সত্যিই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে অসফল হতেন কিনা সে কথা কারো জানা নেই। রাজার বেশে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত রানী পুরোহিতমহলের কাছেও হয়ে ওঠেন একজন যোগ্য ফারাও।

মন্দির জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেক দৃশ্যে রানীকে ঠিক একজন সৈনিকের মতো ভঙ্গিতে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কেবল সৈন্য হিসেবেই নয়, রানী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরিরও চেষ্টা চালান।

তখন রাজারাই নিজেদের সমাধিমন্দির তৈরি করত। বিখ্যাত দায়ের এল-বাহারি জুড়েও ছড়িয়ে রয়েছে হাটসেপসুটের মরচুয়ারি টেম্পল বা সমাধিমন্দির। এমনকি রানীর মন্দির থাকার কারণে জায়গাটিকে বলা হয় ‘ভ্যালি অফ দ্য কুইন’। বিখ্যাত কারনাক মন্দিরে একটি পাথরের ওবেলিস্ক (লম্বাটে স্তম্ভ যার চূড়াটা অনেকটা পিরামিডের মতো, সারা গায়ে প্রাচীন মিসরীয় ভাষায় লেখা) তৈরি করিয়েছিলেন রানী হাটসেপসুট।

রানী হাটসেপসুটের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কোনো কমতি ছিল না। আর সে কারণে তিনি দীর্ঘদিন রাজসিংহাসন আঁকড়ে ধরে থাকতে পেরেছিলেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে তার রণকৌশল যেন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইলেন তৃতীয় থুতমোস।

হাটসেপসুটের বিরুদ্ধে সব সময়ই সরব ছিলেন তৃতীয় থুতমোস। রাজসিংহাসন অধিকার করতে রানী হাটসেপসুটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন? আর এতেই কি মৃত্যু হয়েছিল প্রবল পরাক্রমশালী রানী হাটসেপসুটের এমন প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসের পাতায় নেই।

তবে তৃতীয় থুতমোস মনেপ্রাণে রানী হাটসেপসুটের পতন চেয়েছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রানীর বিরুদ্ধাচারের পরিপূর্ণ ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে তৃতীয় থুতমোসের সব কাজে। হাটসেপসুটের মৃত্যুর পর সব মূর্তি, কোনো আঁকা বা লেখা, সব জায়গা থেকে রানীর নাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন তিনি। রানীর সব ছবিই ছিল পুরুষের বেশে। সে জন্য সব ছবির নিচে নাম পাল্টে থুতমোস করে দেয়া হয়েছিল বলেও মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ।

রানী হাটসেপসুট নিজেই তার জন্য একটি সমাধিমন্দির নির্মাণ করে রেখেছিলেন। তার সেই সমাধিমন্দিরটি এখনও অটুট রয়েছে। কিন্তু এটি মোটামুটি অক্ষত থাকলেও রানীর মমি সেখানে পাওয়া যায়নি। ভ্যালি অব দ্য কিংসের কোনো সমাধি গুহাতেও মিলেনি রানীর মমি। সে কারণেই প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের কাছে হাপসেপটুস একজন রহস্যময়তার অদ্ভুত আবর্তে বন্দিনী ফারাও সম্রাজ্ঞী।

ইতিহাস বলে হাটসেপসুট এক অমর চরিত্র। মিশর শাসনকার্যে তিনি অপরিসীম দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। ক্লিওপেট্রার চাইতে কম সুন্দরী ছিলেন না রানী হাটসেপসুট। কিন্তু স্বভাবে তাকে পাওয়া যায় রানী ক্লিওপেট্রার উল্টো।

হাটসেপসুটের মৃত্যুর পর সব মূর্তি, পোট্রেট ও আসবাব থেকে রানীর নাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন থুতোমস। রানী হাটসেপসুট নিজেই তার জন্যে একটি সমাধিমন্দির নির্মাণ করে রেখেছিলেন যা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রানীর মমি সে মন্দিরে পাওয়া যায়নি। তবে একটি গুহা থেকে পাওয়া গিয়েছিল হাটসেপসুট নাম লেখা একটি বৈয়াম বা ক্যাপোনিক জার।

আর সে জারে মমি তৈরির সময় বের করে নেয়া রানীর লিভার আর অন্যান্য প্রত্যঙ্গ পাওয়া যায়। সঙ্গে ছিল একটি দাঁত। অন্যদিকে আরেকটি সমাধি গুহায় বেশ কয়েকটি নাম না জানা মমি খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল একটি নারী দেহের মমি।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মমিটি যে তথ্য দেয় তা হলো, এটি কোনো ৬০ বছরের স্থূল দেহের নারীর মমি। মমির চোয়ালের একটি দাঁত খোয়া ছিল। দেখা যায় হাটসেপসুটের নাম খোঁচিত বৈয়ামে প্রাপ্ত দাঁতটিই এ মমির চোয়ালের হারানো দাঁত। সন্দেহাতীতভাবে মমিটি রানী হাটসেপসুটের বলে প্রমাণিত হয়।

মমিটি বর্তমানে মিশরের কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সাড়ে তিন হাজার বছর পরও রানীর দেহ কাচের বাক্সে সাজানো আছে। শত প্রচেষ্টা করেও তৃতীয় থুতমোস সম্রাজ্ঞী হাপসেপটুসকে ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেননি।

All-Tour-2-(14.09.15)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *