Skip to content

রাতারগুল থেকে পান্তুমাই

মাহবুবুর রশিদ
দিনটি ছিল শুক্রবার। সকালের ঘুম ভাঙল পরিবেশপ্রেমী সাংবাদিক শাহীন ভাইয়ের মোবাইল ফোনে। ঢাকা থেকে ‘ফেইস বাংলাদেশ ভ্রমণ গ্রুপ’-এর ১৫ জনের একটি প্রতিনিধি দল সিলেটে হাজির। তারা এখানে দুদিন থাকবেন, ঘুরে বেড়াবেন দর্শনীয় স্থানগুলো। ‘ফেইস বাংলাদেশ ভ্রমণ গ্রুপ’-এর টিম লিডার শাহীন ভাইয়ের বাড়ি সিলেট বিভাগের বড়লেখায়। বড়লেখা মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত।

আমাকে ভ্রমণ সিডিউল আগেই দেয়া হয়েছিল। জানানো হয়েছিল সকাল ৭টার দিকে সিলেট সার্কিট হাউসে উপস্থিত হতে হবে।

Ratargul

রাতারগুলে ফেইস বাংলাদেশ গ্রুপ

যথাসময়ে আমিও এসে হাজির হলাম। সবার সাথে কুশলবিনিময়ের পর প্রথম দিন ভ্রমণের স্থান নির্ধারণ করা হলো দেশের অন্যতম সোয়াম ফরেস্ট সিলেটের সুন্দরবন খ্যাত রাতারগুল ও গোয়াইনঘাটের পান্তুমাই। কীনব্রিজ-সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা সারলাম। ঠিক সময়ে রিজার্ভ করা লেগুনা নিয়ে হাজির হলেন চালক রমজান ভাই। এবার যাওয়ার পালা। আম্বরখানা পয়েন্ট হয়ে যাত্রা শুরু করলাম রাতারগুলের দিকে। রাতারগুল গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন একটি গ্রাম। সকাল বেলার পাখির কিচিরমিচির ডাক ও বিমানবন্দর রোডের দু’পাশে চায়ের বাগান, পাহাড়ি টিলায় সারি-সারি গাছগুলো যেন আমাদের আহলান সাহলান বা স্বাগতম জানাচ্ছে। সকাল ৯টার দিকে এসে পৌঁছলাম রাতারগুল গ্রামে। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সামনে থাকা সিলেটের গৌরব রাতারগুলের সুন্দরবন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মেঠোপথের শেষ প্রান্তেই বনের শুরু। রাতারগুলের সুন্দরবনে প্রবেশের জন্য এখানে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে ডিঙ্গি নৌকা। নৌকাগুলো বেশ ছোট। তিন-চার জনের বেশি উঠা যায় না। তাও নড়াচড়া করলে বিপদ। আমরা পাঁচটি নৌকা রিজার্ভ করে খাল দিয়ে বনে প্রবেশ করলাম। খালগুলো বেশ গভীর। গভীর খালে গ্রামের মানুষজন কেউ জাল দিয়ে আবার কেউ বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করছেন। আমাদের নৌকা এগোতে লাগল। কী মনোরম দৃশ্য? একদিকে পানির নিচে সারি সারি মুর্তার গাছ, অন্যদিকে বড় বড় হিজল গাছগুলো দেখে আমরা সবাই আনন্দে আত্মহারা। হিজল গাছের ডালপালায় বনের ভেতর কিছুটা অন্ধকার দেখাচ্ছে। আর এ মুর্তার গাছ দিয়ে তৈরি করা হয় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি।

আমরা যার যার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আঁকাবাঁকা খাল পেরিয়ে একসময় নৌকা প্রবেশ করল গভীর একটি খালে। আমাদের নৌকার মাঝি সদা হাস্যোজ্জ্বল নুর উদ্দিন ভাই বললেন, এটা একটা দিঘি, অনেক গভীর। এখানে বিষধর অনেক সাপ থাকে। তার কথা শুনে মনে ভয়ের সঞ্চার হলো। দিঘির একপাশ দিয়ে নৌকা চলতে লাগল। হঠাৎ মুন ভাই চিৎকার করে উঠলেন সাপ…। সবাই আঁতকে উঠলাম- সত্যিই সাপ। ভয়ঙ্কর সাপ! কবির ভাই সাপের ছবি তুললেন। আমাদের নৌকা গিয়ে ভিড়ল দিঘির শেষ প্রান্তে, বড়সড় একটি হিজল গাছের তলায়। মাসুম ভাই নামার চেষ্টা করলেন, দলনেতা শাহীন ভাই বাধা দিলেন। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, তারপর ড্রাইকেক আর চকলেট বিতরণ করলেন কিবরিয়া তাহসিন ভাই। বিশ্রামের পর কাদাজল মিশ্রিত সরু একটা পথ দিয়ে নেমে পড়লাম বনের ভেতর। মাঝি ভাই বনের ভেতর বানর ও জোঁকের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করলেন। চলতে চলতে বনের পশ্চিমে নদীর ধারে পৌঁছলাম। নদীটার নাম চেঙ্গের খাল- এটি সারি নদীর একটি শাখা। সারি নদীর মোহনা গোয়াইনঘাট, জৈন্তা, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাটের বিভিন্ন সংযুক্তির সাথে রয়েছে।

Ratargul2নদীর পানি দেখে লোভ সামলাতে পারেননি শাহীন ভাই আর রিফাত ভাই। নদীতে নেমে তারা সাঁতরে গোসল করলেন। আমরা এরই ফাঁকে নদীর ধারে বনের এক প্রান্তে বন বিভাগের অফিসের আশপাশে ঘোরাফেরা করলাম। ঘণ্টাখানেক পর ফের নৌকায় ফিরলাম। নৌকায় বসে পেছনে ফিরে থাকাই ছায়াঘেরা মায়াঘেরা সবুজ বনটির দিকে। কিছুতেই যেন আমাদের বিদায় দিতে চাইছে না রাতারগুলের সুন্দরবন। অতঃপর সুন্দরবনকে টা-টা দিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি পান্তুমাইয়ের দিকে। পান্তুমাই গোয়াইনঘাটের পাহাড়ি অঞ্চলের একটি গ্রামের নাম। রাতারগুল পেরিয়ে ফতেহপুরের একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে হরিপুর বাজারের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সারলাম। খাবারের বেশ প্রশংসা করলেন নুমান ভাই। তারপর বাঘের সড়ক হয়ে গোয়াইনঘাটের সীমান্তবর্তী পান্তুমাই গ্রামে পৌঁছলাম। গ্রামের রাস্তাগুলো আঁকাবাকা। রাস্তার দু’পাশে সারি-সারি গাছ। গ্রাম থেকে ভারতের পাহাড়ি মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায়, যা লেখায় শেষ করা যাবে না। ভারতের মেঘালয়ের গহিন অরণ্যের কোল থেকে পান্তুমাই গ্রামের পানে নেমেছে এক অপরূপ ঝর্ণাধারা। ঝর্ণার পানি ছড়া দিয়ে নেমে এসেছে পান্তুমাইয়ের দিকে। অবস্থান ভারতে হলেও পান্তুমাই গ্রাম থেকে পরিষ্কার চোখে আমরা উপভোগ করলাম ঝর্ণার স্বচ্ছধারা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি : লোভাছড়া ট্যুরিস্ট ক্লাব কানাইঘাট, সিলেট
mahbuburrashid68@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *