ফখরে আলম
হায়দরাবাদ শহর থেকে দুই হাজার টাকায় একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। যাব পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফিল্ম সিটি দেখতে। সঙ্গে স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে। অবাঙালি চালক গুড্ডু ফিল্ম সিটি সম্পর্কে ধারণা দিলেন। যাত্রাপথেই দেখা মিলল বিখ্যাত ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটির। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি। গাড়ি এসে দাঁড়ায় রামোজি ফিল্ম সিটির গেটে। বিরাট গেট। টিকিট কাউন্টার অনেক। পাশেই কফি হাউস। ৮০০ টাকা দিয়ে প্রবেশমূল্য সংগ্রহ করে পা রাখি ফিল্ম সিটিতে। ঢুকতেই দেখি কয়েক শ লোক দাঁড়িয়ে আছে। বুকে রামোজি ফিল্ম সিটির স্টিকার। নীল রঙের পোশাক পরা ফিল্ম সিটির কর্মীরা এসে আমাদের বুকেও স্টিকার সেঁটে দেন। এরপর আমাদের উঠিয়ে দেওয়া হলো একটা সুন্দর বাসে। ৪০ জন যাত্রী নিয়ে বাসটা ছুটতে থাকে ফিল্ম সিটির ভেতরে তৈরি হাইওয়ে দিয়ে। সড়কের দুই পাশে ফুটপাত। ফুটপাতজুড়ে মনোমুঙ্কর বাগানবিলাসের উৎসব। চলন্ত বাসে মাইক্রোফোনে ভেসে আসে গাইডের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, ‘এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফিল্ম সিটি। ২০০২ সালে গিনেস বুকস অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে রামোজি ফিল্ম সিটি স্থান করে নিয়েছে। এক হাজার ৬৬৬ একর জমির ওপর এই ফিল্ম সিটি। এর দেখভালের জন্য আছে সাড়ে সাত হাজার কর্মী। রামোজি রাও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মনের মতো করে এই সিটি নির্মাণ করেন। এখানে তৈরি হয়েছে এক হাজার ৪০০ চলচ্চিত্র। প্রতিদিন সাত থেকে ১০ হাজার পর্যটক আসে এই সিটি দেখতে। ভারতবর্ষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি-সব কিছুরই একসঙ্গে দেখা মিলবে এখানে।’
বাস ছুটছে পাহাড়ের ভেতরে থাকা হাইওয়ে ধরে। ১৫ মিনিট যাত্রার পর দেখি মুঘল গার্ডেন। একেবারে যেন দিল্লির লালকেল্লার কপি পেস্ট। এরপর দিল্লির ইন্ডিয়া গেটও দেখলাম। রেপ্লিকা আরকি! হাওয়া মহল, লাইম লাইট গার্ডেনসহ আরো অনেক কিছুই নজরে পড়ল ২৫ মিনিটের এই ট্যুরে। ট্যুর শেষে বাস থামে। এরপর গাইড আমাদের নিয়ে গেল ‘ভগবতম’-এর ভেতরে। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনাগৃহ। কারুকাজখচিত হলরুম আকৃতির কামরাটিতে এসে অনেকেই মাথা নিচু করে প্রার্থনায় মগ্ন হন। এরপর আমাদের বিশেষ একটি বাসে তোলা হলো। সিটে বসে চারদিকের সব কিছু দেখা যায়। এবার অন্য গাইড। বাস চলছে ধীরগতিতে। সেন্ট্রাল জেল, কয়ালগঞ্জ গ্রামের রেলস্টেশন, সেকেন্দ্রাবাদ শহরের রেলস্টেশন, সিনেমার সেটের জন্য যা কিছু লাগে প্রায় সব কিছুর দেখা মিলল। চলতে চলতে অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানের নকল বাড়িও দেখি। দেখি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে ওড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে একটি হেলিকপ্টার।
গাড়ি এসে এবার থামে জাপানিজ গার্ডেনের সামনে। জাপান দেশের ফুলের বাগান। মুগ্ধ নয়নে দেখি। সবুজ ঘাসের মাঠ ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে দেখি সিনেমার শুটিং হচ্ছে। কয়েক মিনিট শুটিং দেখে আবার গাইডকে অনুসরণ করতে থাকি। ভদ্রলোক আমাদের এক গুহার মধ্যে নিয়ে গেলেন। আরে, অজান্তা ইলোরার গুহাও আছে এখানে! সব কিছু মাটির নিচে। ডাইনোসর, কুনোব্যাঙ, সাপ, মাকড়সা, ভূত, ডাইনি। খুবই ভীতিকর পরিবেশ। আধা ঘণ্টার বেশি সময় এই গুহায় কাটিয়ে একে একে দেখে নিই কারিশমা গার্ডেন, সেঞ্চুরি গার্ডেন, ফ্যামিলি গার্ডেন, আমব্রেলা গার্ডেন, লেগ গার্ডেনসহ আরো কয়েকটি গার্ডেন। জানতে পারি, এখানে এমন মনোরম পরিবেশের ১২৫টি বাগান রয়েছে। বাঙালি বাবুর বাড়ি, লন্ডন প্যালেস, স্বর্ণ মন্দির, তাজমহল সব ঘুরে ঘুরে দেখি।
দুপুরে খাবার পর্ব। তারও আয়োজন আছে এই শহরে। স্টিলের থালায় রাখা মুরগির কারি, ডাল, টক দই, আলু ভাজি বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খাই। এরপর রাস্তার পাশের বেঞ্চের ওপর বসি। আমাদের মতো শত শত দর্শনার্থী বসে আছে। হঠাৎ মাটির নিচ থেকে ভেসে আসে গানের সুর। আট-দশজন তরুণ-তরুণী গানের তালে তালে শুরু করে নাচ। দর্শকও নৃত্যের তালে তালে নেচে ওঠে। হঠাৎ দেখা গেল ‘চার্লি চাপলিন’ সেজে থাকা এক অভিনেতার সঙ্গে। ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসি। ছবি তুলি।
এরপর আমাদের গন্তব্য মিনা বাজার। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের হস্তশিল্প বিক্রি হচ্ছে এখানে। ক্রেতাদের মিছিলে আমরাও শামিল হই। এটা-ওটা কিনি। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বড় একটি মিলনায়তনে। ওখানে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অভিনয় আর গানের মাধ্যমে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষের ভারতকে উপস্থাপন করা হয়। বিকেলে নিয়ে যাওয়া হয় মুভি ম্যাজিক ওয়ার্ল্ডে। এখানে কয়েকটি সিনেমা হল আছে। একটিতে গিয়ে বসি। বড় পর্দায় রামোজি ফিল্ম সিটির প্রতিষ্ঠাতা রামোজি রাও দশনার্থীদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেন। ১৯৩৬ সালে জন্ম নেওয়া রামোজি এভাবেই প্রতিদিন হাজির হন দর্শকের সামনে। ভাগ্যিস এ ব্যবস্থা ছিল বলে, না হলে প্রতিদিন সশরীরে এভাবে দর্শকের উপস্থিত হওয়াটা বেশ ঝামেলারই হয়ে যেত ভদ্রলোকের জন্য!
আরেকটি সিনেমা হলে ঢুকে দেখি ঘোড়ায় তুলে নায়িকাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে নায়ক।
এরপর পাতাল রেল ভ্রমণ। একটি মার্কেটের সামনে গিয়ে হাঁফ ছাড়ে ট্রেন। নেমে কিছু কেনাকাটা সারি। বাইরে এসে হলিউড, রামোজি ভবন, ইটিভি ভবন দেখি। আর এরই মধ্য দিয়ে শেষ হয় রামোজি ফিল্ম সিটি দর্শন পর্ব। কিন্তু সাধ মেটে না। হয়তো আরেকবার আসব এই চলচ্চিত্রের শহরে!
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে শ্যামলী, গ্রিন লাইন, ঈগল পরিবহনে কলকাতার নিউ মার্কেট। ভাড়া ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকা। হাওড়া রেলস্টেশন থেকে সুপার ফাস্ট ট্রেন ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেসে হায়দরাবাদ। ১৬০০ কিলোমিটারের পথের এই যাত্রায় সময় লাগে ৩৩ ঘণ্টা। ভাড়া প্রায় ১০০০ টাকা। হায়দরাবাদ থেকে বাস কিংবা ট্যাক্সিতে ৪৫ কিলোমিটার দূরের রামোজি ফিল্ম সিটি। সূত্র : কালের কণ্ঠ