Skip to content

রুক্ষ ভালোবাসার শহর

:: সজল জাহিদ ::

রুক্ষ ভালোবাসার শহর। অদ্ভুত না নামটা? তা ছাড়া ভালোবাসা কি কখনো রুক্ষ হয় নাকি? হ্যাঁ হয়, লেহ শহরের গল্পটা ঠিক এমনই। রুক্ষ এক শহর, কিন্তু ভালোলাগা, ভালোবাসা, আকর্ষণ, মায়ায় ভরপুর এক শহর। যে শহরে গিয়ে প্রথমেই আপনি বেশ অবাক হয়ে যাবেন শহরের রুক্ষতা, ধুলো-বালি, সরু পথ-ঘাট, গলি-ঘিঞ্জি আর জ্যাম দেখে।

কিন্তু যতই সামনে এগোবেন এবং ভিতরের দিকে যেতে থাকবেন শহরের বাস স্ট্যান্ড ছেড়ে ততই ওর রঙ-রূপ-রস আপনাকে বিমোহিত করতে শুরু করবে, যেটা এক সময় রূপ নেবে ভীষণ ভাললাগা, ভালোবাসা আর মায়ায়। ছেড়ে আসতে মন চাইবে না কিছুতেই।

মানালি থেকে লেহ শহরের দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। আপনি যখন মানালি থেকে লেহর দিকে যাত্রা শুরু করবেন তখন মানালি-লেহ হাইওয়েটাই থাকবে আপনার মূল আকর্ষণ। যাঁরা কমবেশি ভ্রমণ করেন আর ভ্রমণ ভালোবাসেন এবং ভ্রমণ নিয়ে অল্প বিস্তর ভাবেন তাঁরা মাত্রই জানেন যে মানালি-লেহ হাইওয়ে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় আর রোমাঞ্চে ভরপুর একটি পথ। যে পথে যাওয়ার স্বপ্ন বুনে থাকেন লাখো ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। এই রোমাঞ্চকর পথের গল্প না হয় অন্যদিন শোনা যাবে। আজকে শুধু লেহ শহরের গল্পটা শুনি।

মানালি থেকে লেহ যেতে পুরো দুই দিন সময় লাগে। হাজার হাজার, রং-বেরঙের পাহাড়, আর ভয়ানক সব রোমাঞ্চকর বাঁক পেরিয়ে লেহ শহরের বাস স্ট্যান্ডে আপনার গাড়ি যখন নামিয়ে দেয়, তখন দুপুর গড়িয়ে যাবে। লেহ নেমে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যেতে পারে আপনার। ভাঙা রাস্তা, ধুলোর সাগর, সরু রাস্তা, জ্যাম আর অগোছালো সবকিছু দেখে। শহরটা যে এমন হবে স্বপ্নেও ভাবেননি। বেশ কিছুটা বিষণ্ণ মন নিয়েই আর একটি গাড়িতে করে চলে যেতে পারেন আপনি হোটেলের খোঁজে। জায়গাটার নাম হতে পারে আপার কারজু।

প্রায় ১০ মিনিট গাড়ি চলবে, বাস স্ট্যান্ড, মল রোড, বাজার পেরিয়ে আপনার গাড়ি আপার কারজুর পথে উপরের দিকে উঠতে শুরু করবে। আর সেই সঙ্গে মনের মধ্যে জমে যাওয়া হালকা কালো অভিমানের মেঘ কেটে যেতে থাকবে সুখের বাতাসের পরশে। দেখে আপার কারজুর বাঁকে বাঁকে হেসে থাকা অপরুপ সৌন্দর্য আর মায়ায় মাখা আর ভালোবাসায় ঘিরে ধরা এক-একটা বাড়ি, হোটেল আর গেস্ট হাউজ দেখে।

যে জায়গার প্রতিটি বাড়ি, হোটেল, কটেজ বা গেস্ট হাউজই এক একটি ছোট ছোট সুখের স্বর্গ। প্রতিটি বাড়ির গেটের দুই পাশের আপেল গাছ আপনাকে হেসে স্বাগত জানাবে।

গেট দিয়ে ঢুকতেই হয়তো পাবেন ঝুলে থাকা আঙ্গুরের আহ্বান। লাল-গোলাপি আর সবুজ আপেলের বাগান, গাছের তলায় সবুজ ঘাসে পড়ে আছে অগনিত আপেল।

আখরোট, হলুদ আর ভীষণ মিষ্টি সুস্বাদু কোনো নরম-কোমল ফল। অতিথিদের পছন্দ করে কি খাবে বললে তাৎক্ষনিক বাগান থেকে তুলে আনবে নানা রকম সবজি। আলু, কপি, শালগম, গাজর, পালং বা অন্যকিছু। একদম বাগানের তরতাজা।

প্রতিটি বাড়ির রুমের দেয়াল জোড়া সচ্ছ কাঁচের জানালা। যে জানালার ভারী পর্দা সরাতেই আপনি চোখের সামনে পাবেন এক অপার্থিব পৃথিবী। বাড়ির বেলকনি, জানালার কার্নিশ, সামনের লন সব জায়গাজুড়ে রয়েছে রং-বেরঙের নাম না জানা শত রঙের ফুলের টব। আর বাগানজুড়ে ফুটে আছে নানা রকমের, বর্ণের আর গন্ধের গোলাপ, এক বা থোকা থোকা, সূর্যমুখী, ডালিয়া, কসমস এবং নাম না জানা আরো অজস্র ফুলের সমারোহ।

এবার নিচ থেকে উপরের দিকে চোখ তুললে এঁকে এঁকে আপনার চোখে পড়বে, সবুজ চারদিকের রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ের মাঝে ছোট্ট ছোট্ট সবুজ ভ্যালি আর বর্ণিল বাড়িঘর।

আর একটু উপরে তাকালে ধীরে ধীরে সবুজ পাহাড়ের শেষ শত শত রুক্ষ সোনালি পাহাড়। কোনোটা পাথরের, কোনোটা মাটির আর কোনোটা সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো। আরো একটু দূরে আর উপরে তাকালে সেদিক থেকে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করবে না কিছুতেই। কারণ সেখানে নীল আকাশের সঙ্গে মিতালি করে মাথা তুলে গৌরবে দাঁড়িয়ে হেসে আছে বরফে বরফে মোড়া পাহাড়ের চূড়া। একটি, দুইটি, তিনটি… নাহ গুনে শেষ করতে পারবেন না আপনি ।

এই সবকিছুর মায়াবি আকর্ষণ আপনাকে এতটাই মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলবে যে ফিরে আসার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে যাবে নিজের অজান্তেই। আর একটি দিনের জন্য শুধু লেহ শহরের আশপাশেই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। ৩০-৪০ মিনিটের ড্রাইভ শেষ করে পাবেন ইন্দাস আর জান্সকার নদীর অপূর্ব মিলন মোহনা যাকে ওরা সঙ্গম বলে। যেখানে পাবেন পাহাড়ি উত্তাল জান্সকার নদীতে রাফটিংয়ের অনন্য রোমাঞ্চ। একই সঙ্গে পাহাড়ের ভয়ানক বাঁক, উত্তাল পাহাড়ি নদীর ডাক আর মাটির পাহাড় কেটে কেটে বানানো বৌদ্ধদের উপাসনালয় বা স্তুপা।
সেদিক থেকে আবার লেহ শহরের দিকে ফিরে এসে লেহ-মানালি হাইয়েওর ২০-২৫ কিলোমিটার গেলেই পাবেন কয়েক শতাব্দী আগের বিখ্যাত হেয় প্যালেস, থ্রি ইডিয়টস মুভির জনপ্রিয় র‍্যাঞ্চস স্কুল, পাহাড়ি ধলকে কীভাবে ক্ষুদ্র নদীর মতো বানিয়ে সাধারণ মানুষের কাজে সেই পানি ব্যবহার করা যায় তার এক অনন্য উদাহরণ পুরো শহরের বাঁকে বাঁকে। আর আপার কারজুর পাশেই পাবেন আর একটি স্তুপা, শান্তি স্তুপা। যেখানে হেঁটে হেঁটেই ঘুরে আসতে পারবেন অনায়াসে। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন যুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর হল অব ফেম, পাহাড়ের খাঁজে ছোট্ট লেহ এয়ারপোর্টসহ আরো নানা নান্দনিক স্থাপনা।

কখন যে এসব দেখে এই রুক্ষ শহরকে ভালোবেসে ফেলবেন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন না। কখন যে আপনার কাছে এই রুক্ষ শহর এক মায়ার বাঁধনে বাঁধা ভালোবাসার শহরে রুপান্তরিত হবে জানতেই পারবেন না। যতক্ষণ না ফেরার সময় হয়ে আসবে। ফেরার সময় দেখবেন কেমন বিষণ্ণ লাগে, ঠিক প্রিয়জনকে ফেলে দূরে চলে যাওয়ার মতো করে এক অব্যক্ত অনুভুতির মতো। যেটা শুধু নিজে বুঝতে পারবেন, কাউকে বোঝানো দুঃসাধ্য। তখন মনে মনে ঠিক বলবেন……

লেহ-এক রুক্ষ ভালোবাসার নাম!

যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে কলকাতা। কলকাতা থেকে ট্রেনে দিল্লি হয়ে কালকা বা মানালি। মানালি থেকে জিপে লেহ। অথবা দিল্লি থেকে জম্মু হয়ে শ্রীনগর। শ্রীনগর থেকে জিপে করে লেহ। আর ঢাকা থেকে প্লেনে কলকাতা হয়ে দিল্লি। এরপর দিল্লি থেকে প্লেনে সরাসরি যাওয়া যাবে লেহ। সৌজন্যে : এনটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *