মাসুম সায়ীদ
ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল
কিছুদূর যাইয়া মর্দ রওনা করিল…
আমাদের গন্তব্য রুমা থেকে জাদিপাই। পথে বগালেক আর কেওক্রাডং। হাতে সময় দেড় দিন। ট্রাকিং করার সময় নেই। অগত্যা চান্দের গাড়ি। ঠিক হলো লাইনের গাড়ি ধরে যাওয়ার।
কাকডাকা ভোরে আমরা জৌমি রিসোর্টের উষ্ণ বিছানা ছেড়ে ঝোলা কাঁধে তুললাম। পথ থাকলে পথিকের অভাব হয় না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদের আটজনের একটা দল যাবে ওই পথে। দুদল মিশে গেলাম এক সঙ্গে। গাড়ির ভেতর প্যাক হয়ে যাওয়ার মানে হয় না। আমি উঠে গেলাম ছাদে। একটু এগিয়েই আবার থামতে হলো। থানার বইয়ে নামধাম, গাইড-গন্তব্য ইত্যকার তথ্য নথিভুক্ত করার পর মিলল অনুমতি। ঝামেলা শেষ। ড্রাইভার নিশ্চিন্ত। ছুটাল গাড়ি যেন চাঁদের পথে ঊর্ধ্বগামী।
চান্দের গাড়ির চান্দিতে চড়ে কেওক্রাডং! অন্য রকম এক অনুভূতি। পুরনো ফোর হুইল জিপ। ছাদ খোলা। ফ্রেমটা আছে বৃষ্টি-বাদলায় ত্রিপল চাপানোর জন্য। ড্রাইভাররা নিজেরাই ভালো মিস্ত্রি। সাজসরঞ্জাম সঙ্গেই থাকে।
থানা কম্পাউন্ড সংলগ্ন পাড়া ছাড়িয়ে একটা ব্রিজ পাওয়া গেল ঝিরির ওপর। ঝিরিটা পাহাড়ের সখিত্ব ছেড়ে ছুটছে সাঙ্গুর দিকে। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল হালকা হতে। বুঝলাম দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি এটা।
এই ফাঁকে আমরা ব্রিজের ওপর ফ্রেমবন্দি হলাম। আমাদের পেছনে কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড় আর বাদাম, ভুট্টার সবুজে মোড়া ঝিরির পলল ভূমি।
লেক তো নয় যেন পাহাড়ের আয়না!…
ব্রিজের গোড়া থেকেই শুরু হলো অবরোহণ। কয়েকশ ফুট খাড়া পাহাড়। ভিজে স্যাঁতসেতে শ্যাওলা ধরা লাল ইটের ওপর দিয়ে। তায় আবার সমকোণে মোড়। ওঠার পথে আবার জায়গা দিতে হলো আর একটা গাড়িকে নেমে আসার জন্য। কিছুক্ষণ পর সামনে পড়ল চিংড়ি ঝিরি। পথের ওপর দিয়ে পানি গড়াচ্ছে চুয়ে চুয়ে। একটা গাড়ি ভিজিয়ে গেছে পথ। আমাদের জিপ ব্যর্থ ওঠা-নামা করল বারকয়েক। বার দুয়েক চার চাকা কাদাজলে বেগার খাটল। আতঙ্ক গ্রাস করল আমাদের। নামতে মানা তাই বসে রইলাম দাঁতে দাঁত চেপে। হেলপার একটা ডাল গুজে দিল এক চাকার তলে। খানিকটা ধূলি ছিটাল ভেজা মাটিতে। ড্রাইভার দরজা খুলে একবার দেখল সবটা। এই ফাঁকে আমি দেখলাম ড্রাইভারকে। নির্লিপ্ত নিরুদ্বিঘ্ন মুখ। নিশ্চিন্ত হলাম। এবার উঠে গেল জিপ।
ডালপালার আঁচর, ধূলির মেঘ আর বাতাসের দাপট তুচ্ছ করে মাছির মতো চারদিকে দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। যত দেখি মন ভরে না। এক সময় চলে এলাম বগা লেকের গোড়ায়। এবার চূড়ায় ওঠার পালা। এতক্ষণ রাস্তা ছিল ইট বিছানো। এখন হাঁটু সমান ধুলা, প্রচণ্ড খাড়া সঙ্গে বিপজ্জনক বাঁক। বুনো শুয়োরের মতো গোঁ গোঁ করতে করতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে গাড়ি উঠে এলো চূড়ায়।
এই সেই বগা লেক! সমুদ্র সমতল থেকে ১০৫০ ফুট উপরে। আয়তন ১৫০ একর। গভীরতা ১২৫ ফুট। স্ফটিক স্বচ্ছ জলে পাহাড় আর মেঘের প্রতিবিম্ব। লেক তো নয় যেন পাহাড়ের আয়না! গাইডসহ দলের অন্যরা ক্যাম্পের দিকে রওনা হলো রিপোর্ট করতে। আমি ছাদ থেকে নেমে ছুটলাম লেকের কাছে। নীলাঞ্জনার নীল চোখে চোখ রাখতে।
স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে…
রিপোর্টিং শেষ করে চলে এলাম বাজারে। রাতে এখানেই থাকব। আড্ডা জমবে তখন। এখন আর দেরি নয়। থাকার ঘর ঠিক হতে হতে পাকা পেঁপে আর আখে ফলাহার হলো। দলের সবাই পাহাড়ে নতুন। যদিও গাড়িতে করে যাচ্ছি। তবু পাহাড় বলে কথা! হাইকিং স্টিক আমার সাথেই ছিল। অন্যদেরও লাঠি নিতে বললাম। হাতে লাঠি না থাকলে ট্রেকার মনে হয় না- এ ভাব নিয়ে লাঠি কিনল সবাই। কেওক্রাডং যাওয়ার স্বপ্ন অনেক দিনের। সাভারে নেচার স্টাডি অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবটা (নাসাক) সে জন্যই করা। তাও তো পাঁচ বছর আগের কথা। এতদিন হয়ে ওঠেনি। এবারের অভিযান ব্রাজকের উদ্যোগে।
বাসু-দা বলল এখন রাস্তা খুবই খারাপ। ছাদে না যাওয়াই ভালো। বসলাম ভেতরে। রাস্তা কই ! এ যে পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে থাকা শাপের খোলস। ধুলায় ঝড় তুলে আমরা ক্রমশ উঠে যাচ্ছি উপরে। হঠৎ পেছন ফিরে দেখি বগা লেক। একটা মেঘ বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মন বলল আসার পথে এ দৃশ্য আর পাব না। তাই চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বললাম। এবার আর ভুল করলাম না। উঠে পড়লাম ছাদে। গাড়ি চলছে রোলার কোস্টারের মতো হেলে দুলে বাঁক খেয়ে পাক খেয়ে।
বড় দিন গিয়েছে কাল। প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আমেজ। বিন্নি ধানের সুগন্ধ বাতাসে। একের পর এক পাহাড়, উপত্যকা পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা। কেউ কেউ ফিরছে। চলছে হাঁটা পথের অভিযাত্রীরাও। তাদের মধ্যে কোনো কোনো দলে মেয়েরাও আছে। নিশাত-ওয়াসফিয়া, অভিনন্দন তোমাদের।
দুপুর দেড়টার দিকে উঠে এলাম কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। এখানে থাকার জন্য কটেজ আছে। আছে হোটেল। খাবারের ফরমায়েশ আর ক্যাম্পে রিপোর্ট শেষে আবার শুরু হলো যাত্রা। কেওক্রাডং
এখানকার সবচেয়ে উঁচু চূড়া। জাদিপাই বেশ নিচে। জলপ্রপাতটা আরো নিচে। আমরা নামছি তো নামছিই। খাড়া নামতে গিয়ে আবার ৪৫ ডিগ্রি কোণে বাঁক। জিপটা মনে হলো কাত হয়ে পড়ে যাবে। বাঁক পার হয়ে ঘটল বিপত্তি। আর একটা জিপ উঠে আসছিল। পাশ কাটাতে গিয়ে একটা চাকা ফাঁসিয়ে দিল ঢালে। ওই জিপের যাত্রীরা নেমে পড়ল তাড়াহুড়া করে। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে। বাসুদেব নেমেই ধমক দিল ড্রাইভারকে। তারপর তার গাড়ির সঙ্গে দড়ি বেঁধে টেনে তুলে দিল ও গাড়ি। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
নিচে অনেকখানি ফসলি জমি। পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝে একটুকরো মাঠ। তাতে পাহাড়ি ছেলেরা বল খেলছে। তাদের কারো কারো গায়ে আধুনিক জার্সি। পায়ে বুট। গাড়ি থেকে নেমে রওনা হলাম ঝর্নার পথে। সামনের সমতল জায়গাটার পর একটা পাহাড়। পাহাড়ের ওপাশেই জলপ্রপাত। আমরা চূড়ায় এসে দাঁড়ালাম। পানি আছড়ে পড়ার শব্দ আসছে কানে। ঢালটা নেমে গেছে খাড়া হয়ে। ঝুরঝুরে মাটি। খুবই বিপজ্জনক। নিচ থেকে একটা দল উঠে আসছে। আমাদের দেখে স্মরণ করিয়ে দিলেন লাঠির কথা। প্রথম ধাপ নেমে আসার পর দেখা মিলল জলপ্রপাতের। ঝর্ণা হিসেবে পরিচিত পেলেও আসলে এটা জলপ্রপাত। উচ্চতায় মাধবকুণ্ডের চেয়ে কম হবে না। প্রশস্তেও বেশি। শুকনো মৌসুম বলে পানির প্রবাহ একটু কম। পাহাড়ের ওপর থেকে আছড়ে পড়েছে পানি। ফলে নিচটা হয়েছে গামলার মতো। তারপর সেই গামলা থেকে উপচে পড়া পানি পাথরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নিচে। সূর্য তখন ঠিক বিপরীত দিকে। আলো তির্যকভাবে এসে পড়ছে আছড়ে পড়া পানির ওপর। ফলে অসাধারণ একটা রংধনুর সৃষ্টি হয়েছে। বিশাল বিশাল পাথরের চাই পড়ে আছে এখানে ওখানে। বর্ষার ঢলে মস্ত বড় এই চাইগুলো হয়তো ছুটে এসেছে ফুটবলের মতো। তখনকার দৃশ্যটা যে কী ভয়ঙ্কর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মামুন ভাই, নুমান ভাই আর আমি বাদ। অন্যরা নেমে পড়ল পানিতে।
আঁধারের গভীরে পাহাড় ডুবে গেলে আমরা ফিরে এলাম বগা লেকে। নিঝুম অন্ধকারে বাজারটা তখনও জেগে। পর্যটকে টুইটুম্বুর। প্রায় প্রতিটি কটেজের সামনে জ্বলছে আগুন। পাহাড়িদের কাছে এ আগুন মশা আর শীতের দাওয়াই। কিন্তু কটেজে আয়েশি অবসরে এটা কী? স্রেফ বিলাসিতা। রাতের খাবারের পর আগুন, গান আর হইচই ছেড়ে নীরবে এসে দাঁড়ালাম চেকপোস্টের নিচে লেকের ধারটায়। প্রকৃতির কোন খেয়ালে কবে সৃষ্টি হয়ে ছিল এটা- সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। এখন ঘুমিয়ে আছে পুরো লেক। বুকে অসংখ্য তারা। লেকের ঠিক মাঝখানে কেসিওপিয়া। কালপুরুষ দক্ষিণের পাহাড় চূড়ায় কাত হয়ে শুয়ে। যেন পঞ্চ তত্তে¡র প্রতীক শায়িত বুদ্ধ। অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে প্রকৃতির মৌনতায় নিজেকে সমর্পণ করে ভাবছিলামÑ ক্ষতি কী যদি এখানকার একটা দোকানের বিক্রয় কর্মী হিসেবে থেকে যাই?
ফেরার পথ ভাটার টানের মতো…
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। নামাজ পড়ে নুমান ভাই আর আমি ক্যামেরা হাতে ছুটলাম বগা লেকের বুকে কুয়াশা আর আলোর আলিঙ্গন দেখতে। লেকের বুকে ধোঁয়া উঠছে। একসময় পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আলোর রশ্মি। ধূমকেতুর শলার মতো। আবছা নীল পাহাড়, কুয়াশা, বাষ্প ওঠা লেকের প্রশস্ত বুক, ভোরে নরম রোদÑ সব মিলে পরিবেশটা যেন জল রঙ্গে আঁকা ছবি। আলোয় আলোয় বেলা বাড়তে থাকল। ফিরে দেখি নেমে যাওয়ার জন্য তৈরি সবাই। আজও জিপের ছাদেই আসন গাড়লাম। কেন যেন মনে হলো ক্যামেরা থাকুক ব্যাগেই। দুচোখ ভরে দেখে যাই শুধু।
ফেরার পথ ভাটার টানের মতো। ফুরায় তাড়াতাড়ি। দেখতে দেখতে রূপকথা শেষ হয়ে এলো। সকাল সাড়ে নয়টা তখন।