বিশ্বজিৎ পাল বাবু
দুর্গাচরণ রায়চৌধুরী ছিলেন এ বংশের সর্বশেষ জমিদার। তাঁর ছেলে নরেশ রায়চৌধুরী ও স্ত্রী মিলে প্রায়ই স্বজনদের বলতেন, বাড়িতে সাতটি ডেকচিতে অংসখ্য মুদ্রা রাখা আছে। কিন্তু এগুলো কোথায় রাখা আছে, তা কেউ জানেন না। এ নিয়ে পরিবারের অনেকেরই ছিল কৌতূহল।
প্রায় শত বছর আগের সেই ‘গল্পের ধন’ মিলেছে গতকাল শনিবার। তবে সাতটি নয়, একটি ডেকচিতে পাওয়া গেছে ৪৮৬টি রৌপ্য মুদ্রা। এর একেকটির ওজন এক ভরি করে। এসব মুদ্রার প্রতিটির এক পিঠে ‘ওয়ান রুপি ইন্ডিয়া’ লেখা। অন্য পিঠে রানি ভিক্টোরিরার নাম ও ছবি। মুদ্রাগুলোর কোনোটিতে আঠারো আবার কোনোটিতে উনিশ শতকের বিভিন্ন সালের উল্লেখ আছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. লতিফ ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আঠারো ও উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসন চললেও ওই সময় অনেক এলাকায় ভারতীয় রুপি প্রথা চালু করা হয়। এটা ছিল ব্রিটিশদের একটা কৌশল। তখন মুদ্রায় রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি ছিল।’
জমিদারবাড়ি/চৌধুরীবাড়ি হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের গঙ্গানগরের একটি বাড়ি। জমিদারবাড়ির আমেজ চোখে পড়বে ঢোকার পথেই। পুরনো, জরাজীর্ণ জমিদারি স্টাইলের ঘরটি বাড়ির সামনের অংশেই। উল্টো দিকে পুরনো একটি ঘাটলা।
বাড়ির ভেতরে কাজ করছে জনা দশেক শ্রমিক। ছালাম মিয়া নামের এক শ্রমিক এ প্রতিবেদককে বলেন, তখন সকাল সাড়ে ৮টা কি পৌনে ৯টা। মাটি কাটার সময় কোদালে কোপ বসালে ভিন্ন ধরনের শব্দ হয়। এরপর একটি শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে ওঠানো হয় ডেকচি, যার ভেতরে ছিল অসংখ্য মুদ্রা।

মুদ্রার এক পিঠে রানি ভিক্টোরিয়া এবং অন্য পিঠে রুপির কথা উল্লেখ আছে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, সর্বজনীন দুর্গামন্দির পরিচালনা কমিটির সদস্য সুশীল দাস ও দুখ্খন ঘোষ নামের দুই ব্যক্তি জানান, এ বাড়িতে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় প্রতিবছরই দুর্গাপূজা হয়। এ বছর থেকে হরিনাম সংকীর্তন করার জন্য পুরনো একটি পরিত্যক্ত ভিটি ভেঙে ফেলা হয়। ভিটির উঁচু মাটি কেটে নিচু করতে গিয়ে ডেকচির সন্ধান পাওয়া যায়। পরে পুলিশে খবর দেওয়া হলে সবার সামনে গুনে এগুলো তারা থানায় নিয়ে যায়।
আখাউড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আহাদ বলেন, ‘সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে থানার সদস্য কাফি মোল্লার কাছে রৌপ্য মুদ্রা পাওয়ার খবর আসে। পরে সেখানে গিয়ে এর সত্যতা পাই। একটি লোহা বা পিতলের ভাঙা ডেকচিতে মোট ৪৮৬টি রুপার মুদ্রা পাওয়া যায়। এসব মুদ্রার গায়ে ১৮৮৪ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত বিভিন্ন সালের উল্লেখ আছে।’
দুর্গাচরণের বংশধর পরিতোষ রায়চৌধুরী (৬৯) বলেন, ‘জমিদার যাত্রামণি রায়চৌধুরীর পাঁচ ছেলে। এর মধ্যে দুর্গাচরণ ছিলেন সর্বশেষ জমিদার। আমি যখন ছোট তখন আমার দাদা নরেশ চৌধুরী (দুর্গাচরণের ছেলে) ও ঠাকুরমা প্রায়ই বলতেন, বাড়ির বিভিন্ন স্থানে অনেক মুদ্রা আছে। আর এত দিনে আমরা এর সন্ধান পেলাম। এখন মনে হচ্ছে, মাটির নিচে আরো কিছু মুদ্রা আছে।’
দুর্গাচরণ রায়চৌধুরীর ছেলে বিষ্ণুচরণ রায়চৌধুরীর নাতি কৃষ্ণ রায়চৌধুরী বলেন, ‘উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জায়গায় আমরা দুর্গাপূজা করি। এবার হরিনাম সংকীর্তন করার জন্য জায়গা ঠিক করছিলাম। এ অবস্থায় মাটি কাটতে গিয়ে পাওয়া মুদ্রা ধর্মীয় কাজে লাগানোর ঘোষণা দিয়ে মন্দিরে রেখে দিই। এরই মধ্যে পুলিশ এসে মুদ্রাগুলো নিয়ে যায়। নিজেদের সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু আমরা এগুলো পাব না, সেহেতু সরকারিভাবে মন্দিরের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছি।’
ওই বাড়ির বিমলা চৌধুরী বলেন, ‘আমি এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি প্রায় ৬০-৬৫ বছর হলো। মনে হয়, জমিদার প্রথা থাকাকালেই এসব মুদ্রা রাখা। তবে বাড়ির আরো কোথাও মুদ্রা আছে কি না সে বিষয়টি আমার জানা নেই।’
গঙ্গানগর গ্রামের মুরুব্বি রেবতি মোহন দেবনাথ (৯৮) বলেন, “ওই বাড়িটি জমিদারবাড়ি ছিল। আমি যখন ছোট তখন ওই বাড়িতে ‘দেশ নিমন্ত্রণ’ করা হয়েছিল। তখন এত বেশি লোক হয়েছিল যে অনেকে না খেয়েই ফেরত গেছে। মনে হচ্ছে, দুর্গাচরণের আমলেই এসব মুদ্রা জমানো হয়েছিল। তখন এক টাকার অনেক মূল্য ছিল। আমি চার-পাঁচ পয়সা নিয়ে বাজারে যেতাম।”
আখাউড়া থানার ওসি মো. মফিজ উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আলোচনা সাপেক্ষে মুদ্রাগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগে জমা রাখা যায় কি না ভাবা হচ্ছে। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে আপাতত থানার মালখানায় মুদ্রাগুলো রাখা হয়েছে। সূত্র : কালের কণ্ঠ