Skip to content

রোজ গার্ডেন ইতিহাসের সাক্ষী

আসিফুর রহমান সাগর
ঘটনাটা কাকতালীয় কিন্তু বিস্ময়কর! ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভাগীরথী নদীর তীরে অস্তমিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। এর ১৯২ বছর পর একই দিনে বাংলার পরাধীনতার অন্ধকার কাটাতে নতুন সকাল উদ্ভাসিত হয়েছিল পুরানো ঢাকার রোজ গার্ডেনে। ১৯৪৯ সাল। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। রাজনীতির এক যুগসন্ধিক্ষণে সে বছরের ২৩ জুন এই রোজ গার্ডেনে জন্ম হয় বাংলার মানুষের মুক্তি আর অধিকার আদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ।

Roze-Garden

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দলটির গোড়াপত্তন হয়। পরবর্তীকালে এর নাম ছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সাল থেকে এর নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

শ্বেত পাথরের মূর্তি, কৃত্রিম ফোয়ারা, ঝর্ণা, শান বাঁধানো পুকুর ও অনন্য স্থাপত্য শৈলিতে নির্মিত ভাস্কর্য– এক রাজকীয় বাগানবাড়ি ‘রোজ গার্ডেন’। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে যা চিরদিনের মত যুক্ত হয়ে গেছে। কালের পরিক্রমায় রোজ গার্ডেন এখন রশিদ মঞ্জিল। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, মালিকপক্ষ বাড়িটিকে বিক্রি করে দিতে চাইছে।

রোজ গার্ডেনের জন্ম ইতিহাস

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে যেমন রয়েছে ইতিহাস, তেমনি রোজ গার্ডেন নির্মাণের পিছনেও রয়েছে বঞ্চনা আর অপমানের ইতিহাস। ১৯ শতকের বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। যা বর্তমানে বলধা গার্ডেন নামে পরিচিত। এখানে নিয়মিত গানের আসর বসতো। উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী নিজে নাট্যকার ছিলেন। বিনা আমন্ত্রণে ঢাকার একজন ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে হূষিকেশ দাস একদিন বলধার এক অনুষ্ঠানে যান। সনাতন হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী নিম্ন বর্ণের হওয়ায় তাকে অপমান করা হয়। এ অপমান থেকে একই রকম বাগানবাড়ি নির্মাণ করে এর প্রতিশোধ নিতে দৃঢ প্রতিজ্ঞ হন হূষিকেশ দাস। আর এভাবেই বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর বাগানবাড়ির আদলে নির্মিত হয় রোজ গার্ডেন।

১৯৩০ সালের দিকে হূষিকেশ দাস রোজ গার্ডেনের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুর্লভ সব গোলাপ গাছে সুশোভিত করেন উদ্যানটি। গোলাপ বাগান সমৃদ্ধ বাড়ি হওয়ার কারণেই এর নাম হয় ‘রোজ গার্ডেন’। এদিকে, ঋণের দায়ে হূষিকেশ দাস তার আত্মসম্মানের প্রতীক এই বাগানবাড়িটি ১৯৩৬ সালে ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের কাছে বিক্রি করে দেন। কালক্রমে এ বাড়িটির বর্তমান মালিক রশীদের বংশধরগণ। সত্তর সালের দিকে ‘রোজ গার্ডেন’ লীজ দেয়া হয় ‘বেঙ্গল স্টুডিও’কে। ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ‘রোজ গার্ডেন’কে সংরক্ষিত ভবন বলে ঘোষণা করে। ১৯৯৩ সালে বাড়িটির অধিকার ফিরে পান কাজী রকিব।

ঐতিহাসিক ও নির্মাণশৈলী দুই কারণেই সংরক্ষণ করতে হবে রোজ গার্ডেন

‘রোজ গার্ডেনের স্থাপত্য একটা মাস্টারপিস। মোগল স্থাপত্য, বৃটিশ ঔপনিবেশবাদ, লোকজ ও ইউরোপীয় স্থাপত্যেও চমত্কার সম্মিলন গঠেছে রোজ গার্ডেনের স্থাপত্য ব্যাকরণে,’—বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক নুরুল কবির রনি। তিনি বললেন, আওয়ামী লীগের জন্মেও সাক্ষী হিসাবে যেমন ইতিহাসের অংশ তেমনি স্থাপত্যশৈলী হিসাবেও রোজ গার্ডেন সংরক্ষণের দাবি রাখে।

এদিকে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মালিক পক্ষ বাড়িটি বিক্রি করতে আগ্রহী। তবে তারা যে দাম চাইছেন সরকারি নিয়মে সেই দামে কেনা সম্ভব নয়। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি নিয়মের দোহাই দিয়ে বাড়িটিকে ধ্বংস করতে দেয়া কোনভাবেই ঠিক হবে না। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে যে কোন উপায়ে তা সংরক্ষণ করা সরকারের দায়িত্ব।

আওয়ামী লীগের জন্মকথা

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তত্কালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। পরে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়; নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক সম্মেলন আহ্বান করে। রোজ গার্ডেনে ২৩ জুনের বিকেল ৩টায় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ। প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব। উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল তত্কালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল।

Roze-Garden2

দল গঠন প্রসঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তার জবানিতে বলা হয়েছে, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। কারাগারের যন্ত্রণা কি এইবারই বুঝতে পারলাম। সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিলেই আমার খারাপ লাগত। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে সমস্ত কয়েদির কামরায় কামরায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেওয়া হয় গণনা করার পর।”

বইটির আরেক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলছেন, “খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দি’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্র্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছে তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার কয়েকদিন পরেই আমার ও বাহাউদ্দিনের মুক্তির আদেশ এল। বাইরে থেকে আমার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে। বাহাউদ্দিন আমাকে চুপি চুপি বলে, ‘মুজিব ভাই, পূর্বে মুক্তি পেলে একটা মালাও কেউ দিত না, আপনার সাথে মুক্তি পাচ্ছি, একটা মালা তো পাব।’ আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘আর কেউ না দিলে তোমাকে আমি মালা পরিয়ে দিতাম।’ জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি, আমার আব্বাও উপস্থিত। তিনি আমাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকেও সালাম করলাম। সাথে সাথে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল। জেলগেটে এই প্রথম ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হল। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, ‘হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয়।’ হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘চল, এবার শুরু করা যাক’।”

তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিব সেই যে শুরু করেছিলেন এরপর তিনি বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের পরই থেমেছিলেন। হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের মানুষের ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির জনক’।

রোজ গার্ডেন : অনন্য স্থাপত্যশৈলী

রোজ গার্ডেনের পশ্চিম ও উত্তর দিকের দেয়ালের মধ্যবর্তী অংশে দুটি মূল ফটক আছে। প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য পশ্চিম দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমেই আছে একটি বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ। এখানে মঞ্চের ওপর দণ্ডায়মান রয়েছে কয়েকটি সুদৃশ্য নারী মূর্তি। পূর্বাংশের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে একটি আয়তকার পুকুর। পুকুরের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের মাঝামাঝি একটি করে বাঁধানো পাকা ঘাট আছে। এর পূর্ব দিকে আছে পশ্চিমমুখী একটি দোতলা ইমারত। যার বর্তমান নাম ‘রশিদ মঞ্জিল’। রশিদ মঞ্জিলের প্রবেশপথের সামনের চত্বরে ইট ও সিমেন্ট নির্মিত একটি সুন্দর ফোয়ারা রয়েছে। একটি সাত ধাপ বিশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে রশিদ মঞ্জিলের প্রথম তলায় যেতে হয়। এর সামনের দিকের মাঝামাঝি অংশের প্রতি কোঠার পাশাপাশি তিনটি খিলান দরজা আছে। ওপরের তলায় প্রতিটি খিলানের ওপর একটি করে পডিয়াম আছে। ?টিমপেনামগুলো লতাপাতার নকশা এবং রঙিন কাচ দিয়ে শোভিত। এর সামনে আছে বাইরের দিকে উপবৃত্তাকার বেলকনি। এর দুপাশে একটি করে করিনথীয় পিলার আছে। পিলারগুলোর দুই পাশের অংশে প্রতি তলায় আছে একটি করে দরজা। এদের প্রতিটির কাঠের পাল্লার ভ্যানিশিং ব্লাইন্ড ও টিমপেনামে লতাপাতার নকশা দেখা যায় এবং সামনেই অপ্রশস্ত খোলা বেলকনি আছে। এর ওপরের অংশে কার্নিস বক্রাকার যা বেলস্ট্রেড নকশা শোভিত। মধ্যবর্তী অংশ ছাদের সামনের ভাগে আছে আট কোনাকার এবং খিলান সংবলিত বড় আকারের ছত্রী। এর ছাদ একটি আধাগোলাকার গম্বুজ ঢাকা। ইমারতটির দুই কোণে দুটি করিনথীয় পিলার আছে এদের ওপরে দিকেও ছত্রী নকশা আছে। প্রতি তলায় মোট ১৩টি ছোট ও বড় আকারের কোঠা আছে। প্রথম তলায় প্রবেশের পর পশ্চিমাংশের বাঁদিকে আছে ওপরের তলায় যাওয়ার জন্য ঘূর্ণায়মান সিঁড়ি। ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন নাটক ও টেলিফিল্ম শুটিং স্পট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *