ফারুখ আহমেদ
নৌকা থেকে নামার পর একদল শিশু আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। আশপাশের সৌন্দর্য অসাধারণ। সোজা পাহাড়ের গায়ে গভীর জঙ্গল, তার সামনে চমৎকার একটি সেতু। পাহাড়ের গা বেয়ে একটি ঝরনা দুরন্ত গতিতে নেমে আসছে। চারপাশে অসংখ্য বাঁশঝাড়।
সেদিন সায়েদাবাদ থেকে রাত ১১টায় ছাড়ল আহমেদ পরিবহনের বাস। নরসিংদী, ভৈরব, হবিগঞ্জ, শেরপুর হয়ে সকাল সাতটায় পৌঁছালাম জৈন্তাপুর। জৈন্তাপুর এক দিন থেকে পরদিন সকালে আবার একটি লোকাল বাসে চলে এলাম সিলেট শহরে। সেটা গত বছরের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। এই সময়টায় আবহাওয়া দারুণ থাকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, ঝুমবৃষ্টি, মেঘলা আকাশ, আবার কখনো ঝকঝকে রোদেলা আকাশ। জৈন্তাপুর থেকে সিলেট পৌঁছে এক দিন সিলেট শহরে অবস্থান করে পরদিন আবার বের হলাম।
এবারের গন্তব্য অচেনা এক ছড়ার কাছে। সিলেট শহর থেকে সেই ছড়ার দূরত্ব সাকল্যে তিন ঘণ্টার। এলাকাটি ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড় হলেও এই পথ কেউ খুব একটা মাড়ায় না। পাহাড়ি নদী পিয়াইন, পশ্চিম জাফলং এলাকার বিভিন্ন গ্রাম আর জঙ্গলঘেরা সেই ছড়ার উদ্দেশে আমরা হাদারপারের পথে যাত্রা শুরু করলাম। হাদারপার পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম গনি মিয়ার হোটেলে। খাওয়াদাওয়া শেষে একজন গাইড নিয়ে ছইবিহীন এক খোলা নৌকায় চেপে বসলাম।
বিছনাকান্দি পেছনে ফেলে পশ্চিম জাফলং এলাকার পিয়াইন নদীর বুক দিয়ে নৌকা ছুটে চলেছে। আমাদের চলার দুই পাশে বাঁশঝোপ। একটা এমন ঝোপ দেখে ক্লিক করলাম। ভিউ ফাইন্ডারে ছবি দেখে মনে হলো যেন এক সবুজ ডাইনোসর পিয়াইন নদীর জলে নেমে জলপানে ব্যস্ত। ক্যামেরা রেখে সৌন্দর্য চোখ দিয়ে গিলে খেতে খেতে সেই জলপথে এগিয়ে চলি। এভাবেই একসময় বাঁ দিকে মোড় নিতে হয়। এবার আঁকাবাঁকা খালের ভেতর দিয়ে আমাদের জলপথে চলা। অসাধারণ সেই পথ। চেনা-অচেনা কত না গাছগাছালি। সবুজ ঘাস, সবুজ ফুল, কখনো হলুদ রঙা, আবার কখনো গোলাপি বা সাদা ফুলের বাহারে বিমোহিত আমরা। সেদিন চরম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে পিয়াইনের এই খাল দিয়ে চলা আমাদের ভ্রমণের সেরা প্রাপ্তি। দিনটা রোদ ঝকঝকে ছিল না।
তবে দিনের আলোয় কী এক মায়া ছিল। জলপথে চলতে আলো-ছায়ার চমৎকার খেলা দেখে মুগ্ধতায় ভরে উঠছিল আমাদের মন। আবার যদি এই পথে না আসা হয়, ভাবতেই ক্যামেরায় হাত চলে আসে। চলে সমানে ক্লিক। ক্রমশ খাল সরু হয়ে আসছে। দেখা মিলছে চিকন বাঁশের সেতুর। একসময় যাত্রাপথ শেষ হয়। আন্দাজ করি, আমরা সীমান্ত এলাকায় চলে এসেছি। কৌতূহলী গ্রামবাসী আমাদের জেঁকে ধরেছে, এর মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি। সামনে অসাধারণ এক সেতু। একেবারে হাত ছোঁয়া দূরত্বে ঝরনা দেখা গেলেও সেই অংশ পড়েছে ভারতের ভেতরে। বাংলাদেশ প্রান্তে এ কেবলি অসাধারণ এক ছড়া। সবাই পাথর বিছানো সেই জলে নেমে পড়লাম। এর মধ্যে একটু বোকা বোকা ভাব করে মুরব্বি গোছের একজনকে পেয়ে প্রশ্ন করে বসি, কাকা, এই জায়গার নাম কী। কাকার স্বতঃফূর্ত জবাব, লক্ষ্মণছড়া!
জেনে নিন
ঢাকা থেকে আপনাকে প্রথমে সিলেট যেতে হবে। সন্ধ্যার বাসে সিলেট রওনা হলে মধ্যরাতে পৌঁছে যাবেন। রাতে বিশ্রাম, পরদিন হাদারপার। সে ক্ষেত্রে আপনার বাহন হতে পারে লেগুনা, মাইক্রোবাস কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা। হাদারপার দেড় ঘণ্টার পথ। হাদারপার থেকে নৌকায় যেতে হবে লক্ষ্মণছড়া। ইদানীং বিছনাকান্দির দর্শনার্থী বেড়ে যাওয়ায় নৌকার মাঝি ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকেন। সে জন্য ঠিকঠাক মতো দরদাম করেই নৌকায় উঠবেন। হাদারপার থেকে লক্ষ্মণছড়া ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার পথ। নৌকার মাঝির লক্ষ্মণছড়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে কি না, সে বিষয়ে অবগত হয়ে অথবা সঙ্গে গাইড নিয়েই যাত্রা শুরু করুন। নদীর বাতাস আর ছড়ার পানিতে গোসলের পর খিদে মাথাচাড়া দেবেই। সুতরাং সঙ্গে শুকনা খাবার আর পানি রাখতে পারেন। তবে সীমান্ত অতিক্রম করে ঝরনার অনেক কাছে বা সেতুর ওপর ওঠার চেষ্টা করবেন না। লক্ষ্মণছড়া বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত সময় জুন থেকে অক্টোবর মাস। সূত্র : প্রথম আলো