নরসিংদীর শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলা এবং এর আশপাশের এলাকায় লটকনের বাণিজ্যিক চাষ বেশি হয়। স্বাদের জন্যও এখানকার লটকনের সুনাম রয়েছে। লিখেছেন-গাজী মুনছুর আজিজ
থোকায় থোকায় লটকন ঝুলছে গাছের পুরো শরীর জুড়ে। এমনকি গাছের গোড়ার দিকে ঝুলে থাকা লটকন মিশেছে মাটির সঙ্গেও। লটকনে পরিপূর্ণ বাগানের প্রায় সব গাছ। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ছোটাবন্দ গ্রামের এ লটকন বাগানে ঢুকেই খায়েশ হল লটকন খাওয়ার। বাগানের মালিক হাসান ভূঁইয়া হয়তো মনের কথা বুঝতে পেরেই বললেন- ‘যে গাছ থেকে মন চায় ছিঁড়ে খেতে পারেন, যত খুশি খেতে পারেন।’ তিনি শুধু বলেই শেষ করেননি, সঙ্গে দেখিয়ে দিলেন কোন গাছের লটকন মিষ্টি, আর কোন গাছের লটকন টক।
হাসান ভূঁইয়া জানান, শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলা এবং এর আশপাশের এলাকা জুড়েই লটকনের চাষ হয়। তবে বেশি হয় শিবপুর উপজেলাতে। এখানকার যোশর, আগরপুর, মাকাল্লা, ভিটিখৈনকুট, দক্ষিণ কামালপুর, লালখারটেক, কামারটেক, চৈতন্য, চান্দারটেক, শরীফপুর, কুলুরটেক, টঙ্গিরটেক, পুরানা আটশিয়া, আমরাতলী, কাজিয়ারা, লেটাব, মাছিমনগর, মালিয়ারা, নৌকাঘাটা, নন্দিরটেক, দেবালেরটেক, পাহাড়ফুলদী, শৈকারচর, শ্রীরামপুর, সৃষ্টিগড়, ভঙ্গারটেক, জাঙ্খারটেকসহ আশপাশের সব গ্রামেই লটকনের বাগান আছে। দেশের অন্য এলাকায় লটকন হলেও স্বাদের জন্য এখানকার লটকনের সুনাম রয়েছে। এছাড়া এ অঞ্চলেই বাণিজ্যিকভাবে লটকনের চাষ বেশি হয়। আর এ লটকন যায় সারা দেশে।
জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত লটকনের পূর্ণ মৌসুম। তবে ভাদ্রের প্রথম দিকেও কিছু লটকন পাওয়া যায়। এখানকার লটকন বিক্রির হাট বসে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল বাজার বাসস্ট্যান্ড, শিবপুরের কামারটেক বাজার বাসস্ট্যান্ড, চৈতন্য বাজার ও গাবতলী বাজার। চাষিরা খুব সকালে লটকন ছিড়ে ছোট ঝুড়িতে ভরে নিয়ে আসেন বাজারে। সকালেই বাজার জমে। পাইকার আসেন ঢাকা, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে। অনেক পাইকার বাগান থেকেও কিনে নেন। পাইকার নাজমুল হক বলেন, মূলত স্বাদের জন্য এখানকার লটকনের চাহিদা বেশি থাকে। সকালে লটকন কিনে দিনে দিনেই পাঠিয়ে দিই মোকামে।
লটকন বাগানের মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, সারা বছরই লটকনের চারা লাগানো যায়, তবে আমরা সাধারণত বর্ষা মৌসুমে চারা লাগাই। চারা আলাদা করে কিনি না। গাছ থেকে লটকন পড়ে বা পাখি খেয়ে যে লটকন ফেলে দেয় সেই লটকন থেকেই চারা গজায়। সেই চারা লাগাই। লাগানোর চার বছর পর থেকে গাছে লটকন ধরতে শুরু করে। তবে চারা বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়। এছাড়া খুব একটা যত্নও করতে হয় না লটকন গাছের। মৌসুম শেষে গাছের গোড়ায় কিছু মাটি বা গোবর দিই।
লটকন বাগানের মালিক সিদ্দিক মিয়া বলেন, বড় আকারের একটি গাছ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত লটকন পাওয়া সম্ভব। আর একটি গাছ ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। তবে লটকন গাছের কাঠ দিয়ে ফার্নিচার হয় না, কেবল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। লটকন বিক্রি হয় বড় বা ছোট আকার ভেদে। মৌসুমে বড় আকারের লটকন প্রতি মণ ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ছোট আকারেরগুলো আরও কম দামে।
বাগান ছাড়াও এখানকার প্রায় সব বাড়ির আশপাশেই লটকনের গাছ আছে। আর প্রতিটি লটকন গাছ মানেই সম্পদ। সেজন্য লটকন এখানকার মানুষের অন্যতম অর্থকারী ফসলও বলে জানালেন এখানকার মানুষ।
লটকন খেয়ে বাগান দেখে আসি কামারটেক বাজার। বাজারে দেখি কয়েকজন বিক্রেতা খুচরা লটকন বিক্রি করছেন। বাজারের হুমায়ূন কবিরের দোকানে গরুর দুধ খেয়ে বিদায় নিই লটকনের এ রাজ্য থেকে।
জেনে নিন: গুলিস্তান, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী থেকে সিলেট বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গাড়িতে শিবপুরের কামারটেক নামা যাবে। সেখান থেকে হেঁটে বা অটো রিকশায় ছোটাবন্দসহ এর আশপাশের গ্রামের লটকন বাগানে যাওয়া যাবে। সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর