মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান
লোকচক্ষুর অন্তরালের একটি ঝরনা। কেউ বলেন চিতা ঝরনা। কেউ হাম হাম, আবার কেউ হাম্মাম। রোমাঞ্চপ্রেমীদের ভ্রমণের একটি আদর্শস্থান। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত রাজকান্দি বনাঞ্চলের একদম গভীরে এর অবস্থান। ২০১০ সালের শেষের দিকে ঝরনাটি আবিষ্কার করেন একদল পর্যটক। দুর্গম জঙ্গলের এই ঝরনাটির উচ্চতা ১৬০ ফুট ধরা হলেও এ নিয়ে পরীক্ষিত কোনো মত নেই। তবে অনেকের মতে, দেশের সবচেয়ে উঁচু মাধবকুণ্ডের ঝরনার চেয়ে হাম হামের ব্যাপ্তি তিনগুণ বেশি।
নামের উৎপত্তি নিয়ে আছে নানা মত
হাম হাম ঝরনার নামের উৎপত্তি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আজো আসা যায়নি। তবে পর্যটকেরা ঝরনাটির উৎপত্তি নিয়ে নানা কথা বলেন। কেউ বলেন, ঝরনাটির সাথে গোসলের সম্পর্ক রয়েছে। পানি পতনের স্থানে এক সময় পরীরা গোসল করত। গোসলখানাকে আরবিতে ‘হাম্মাম’ বলে। আবার পানির স্রোতধ্বনিকে ত্রিপুরার টিপরা ভাষায় ‘হাম্মাম’ বলে। এ জন্য ‘হাম্মাম’ (গোসলখানা) শব্দ থেকে এর নাম হয়েছে হাম হাম। পানির তীব্র শব্দ সিলেটের উপভাষায় ‘আ-ম আ-ম’ বলে বোঝানো হয়। ঝরনাটি যেহেতু এ রকম শব্দ করে, এ জন্য শহুরেরা ভাষান্তর করে এটিকে ডাকে হাম হাম নামে। তবে স্থানীয়রা এটিকে চিনে ‘চিতা ঝরনা’ হিসেবে। কারণ, এক সময় এখানের জঙ্গলে প্রচুর চিতাবাঘ পাওয়া যেত।
পুরোই অ্যাডভেঞ্চার
সব ঝরনার মতো হাম হামেরও যৌবন হলো বর্ষাকাল। বর্ষাকালে প্রচণ্ড ব্যাপ্তিতে এর পানির ধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে তা মিইয়ে মাত্র একটি ঝরনাধারায় এসে ঠেকে। ঝরনার ঝরে পড়া সেই পানি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলে। এ রকমই বিভিন্ন ছোট-বড় ছড়া পেরিয়ে জঙ্গলের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই ঝরনার কাছে পৌঁছতে হয়। এটি লোকালয় আর শহর থেকে বেশ দূরে। এখানে যাওয়ার জন্য যোগাযোগব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এ জন্য সরকারিভাবেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ঝরনাটিকে ঘিরে তৈরি হয়নি কোনো সরকারি অবকাঠামো। সাধারণত স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে কাউকে গাইড বা পথপ্রদর্শক নির্ধারণ করে পর্যটকেরা ঝরনাটি ভ্রমণ করেন।
কমলগঞ্জের একেবারে শেষ গ্রামের নাম কলাবনপাড়া। তৈলংবাড়ি নামেও জায়গাটি পরিচিত। এরপর থেকে তেমন কোনো জনবসতি নেই। আর এখান থেকেই শুরু হয় হাম হাম যাওয়ার আসল অ্যাডভেঞ্চার। চার দিকে ঘন জঙ্গল। বিশেষ করে প্রচুর বাঁশবন। বেয়ে উঠতে হয় ছোট-বড় পাহাড়। আবার কখনো বেশ খাড়া পথ বেয়ে নিচে নামতে হয়। প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা।
ঝরনায় যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চম্পারায় চা বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা বাগান থেকে ঝরনার দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। অনেক ঝিরিপথ ও ছড়ার কাদামাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। ঝিরিপথে কখনো কখনো চোরাবালুও তৈরি হয়। কিন্তু সেসব স্থানে পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশিকা দেখা যায় না। এ ছাড়া গভীর জঙ্গলে বানর, সাপ, মশা এবং জোঁকের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়।
এত কিছুর পরও মনে আনন্দ। নতুন জায়গা। আবিষ্কারের নেশায় আত্মহারা।
পথে দেখা মিলবে চশমা পরা হনুমানের
হাম হাম যাওয়ার পথ এবং হাম হাম-সংলগ্ন রাজকান্দি বনাঞ্চলে রয়েছে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি কদমগাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে রঙ-বেরঙের প্রজাপতি। ডুমুরগাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অসংখ্য চশমা পরা হনুমানের। এ ছাড়াও রয়েছে ডলু, মুলি, মির্তিঙ্গা, কালি ইত্যাদি বিচিত্র নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ।
পুরো জায়গা জুড়ে কেমন যেন সুনসান নীরবতা। কাচের ঘরে আটকে থাকলে যেমন লাগে, অনেকটা সেরকম। তবে মাঝে মধ্যেই খুব কাছে, কখনো দূর থেকে ভেসে আসছে অচেনা পাখির মিষ্টিকণ্ঠের গান।
পাহাড়ের গায়ে হালকা বিশ্রাম নিতে নিতেই দেখে নেয়া যায় অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি। চোখজুড়ে থাকে মাতাল করা সবুজে ঘেরা চার পাশে। ঘামে ভেজা শরীর ঝিরির পানিতে ভিজিয়ে সমস্ত ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। পিচ্ছিল পাথুরে পথ, সাবধানে পা ফেলতে হয়। এভাবে প্রায় অনেকটা সময় হাঁটার পর হঠাৎ শোনা যায় এক শিহরণজাগানিয়া শব্দ। সেই কাক্সিক্ষত হাম হাম জলপ্রপাতের শব্দ। মনে হয়, এই তো এসে পড়েছি। একটু ভালো করে উঁকি দিলেই দেখা যাবে জলধারা।
সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাবেন
বর্ষাকালে হাম হামে যাওয়ার কিছু আগে পথে দেখা পাওয়া যায় আরেকটি ছোট ঝরনার। হাম হামের রয়েছে দু’টি ধাপ। সর্বোচ্চ ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাঝখানের ধাপে। সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের অগভীর খাদে। এক দিকে পাহাড়ে ঘেরা বনজঙ্গল আর অন্য দিকে অবিরাম বয়ে চলা জলরাশি পাথরের খাঁজে খাঁজে ঢেউ খেলে যাওয়া পানিতে ব্যাঙ আর ব্যাঙাচির মেলা। ঝরনার পাশে গেলে প্রথমেই এর সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাবেন। হাঁটু গেড়ে বসে সেই পরিবেশ উপভোগ করার মজাই আলাদা।
আয়নার মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেয়ে আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে। গুঁড়িগুঁড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের ১৫০ ফুট ওপর থেকে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের দিকে। চার পাশ গাছগাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতির লতাপাতা ও লতাগুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ি শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভূমিতে।
চার দিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ। ডানে-বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তার এই অনন্য সৃষ্টির জন্য। জঙ্গলে উল্লুক, বানর আর হাজার পাখির ডাকাডাকির সাথে ঝরনার ঝরে পড়ার শব্দ মিলে-মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ক্ষণিকের জন্য ভুলে যেতে হবে কোথায় আছি, কিভাবে আছি। ওপরে আকাশ, চার দিকে বন, পায়ের নিচে ঝিরির স্বচ্ছ জল আর সামনে অপরূপ ঝরনা।
অপচনশীল বর্জ্য পুড়ে ফেলতে হবে
দুর্গম পথ পাড়ি দিতে অনেক পর্যটক খাবার ও প্ল¬াস্টিকের পানির বোতল সাথে নেন। খাবার যাতে ভিজে না যায়, সেজন্য প্রায়ই পলিথিন ব্যবহার করেন। এগুলো প্রায়ই যত্রতত্র ফেলে দেন তারা। এতে নষ্ট হয় জঙ্গলের সৌন্দর্য। পরিবেশের জন্যও এটি ক্ষতিকর। তাই পর্যটকদের পচনশীল বর্জ্য পুঁতে ফেলা এবং অপচনশীল বর্জ্য সাথে করে নিয়ে আসা কিংবা পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়।
ফিরতে হবে সন্ধ্যার আগেই
ঝরনার ওপড়ের যে স্থান থেকে পানি পড়ে, সেখান থেকে ২০০ ফুট পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা সীমানা। ঝরনার আশপাশের বাসিন্দারা ত্রিপুরা উপজাতির। বনজঙ্গলের মায়া ছেড়ে আসতে হয়তো একটু বেশিই সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই চলে আসা উচিত।
পিচ্ছিল পাথুরে এই পথে যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার যাওয়ার সরাসরি বাস আছে। ভাড়া ৪০০-৪৫০ টাকা। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল থেকেও যাওয়া যায়। মৌলভীবাজার থেকে যেতে হবে কমলগঞ্জ। সেখান থেকে আদমপুর বাজার, বাসভাড়া ১৫-২০ টাকা। এখান থেকে ২০০-২৫০ টাকা সিএনজি ভাড়ায় পৌঁছে যেতে পারেন উপজাতিদের বস্তি তৈলংবাড়ি বা কলাবনপাড়ায়। এরপর হাঁটা রাস্তা। সাত থেকে আট কিলোমিটারের মতো পাহাড়ি পথ শেষে হাম হাম ঝরনার দেখা মিলবে। তবে যেখান থেকেই যাওয়া হোক, কলাবনপাড়ার দিকে অবশ্যই সকালে রওনা হতে হবে।
এ ছাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি রেলপথে মৌলভীবাজার যাওয়া যায়। যারা আকাশপথে মৌলভীবাজার যেতে চান, তাদেরকে প্রথমে সিলেট গিয়ে, তারপর সেখান থেকে সড়ক বা রেলপথে মৌলভীবাজার যেতে হবে। অন্য রুটের চেয়ে রেলপথে ভ্রমণই সুবিধাজনক।
রাতে থাকতে হবে শ্রীমঙ্গলে
থাকার ব্যবস্থা বলতে যাওয়ার আগে শ্রীমঙ্গলে এক রাত থেকে পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা দিয়ে সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যার পরে শ্রীমঙ্গল ফিরতে পারেন। তবে ওই সময়টায় ফেরার সম্ভাবনা খুব একটা বেশি থাকে না। সে ক্ষেত্রে উপজাতিদের বাড়িতে থাকা যায়। যদি শ্রীমঙ্গল ফেরা না যায়, তবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা তৈলংবাড়ি বস্তি বা কলাবনপাড়ায় থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
জোঁক থেকে সাবধান
যাওয়ার আগে অবশ্যই কলাবনপাড়ার স্থানীয়দের কাছ থেকে ভালো-মন্দ জেনে নেবেন। সাথে সরিষার তেল আর লবণ রাখতে হবে। কেননা প্রচুর জোঁকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এই দু’টি ব্যবস্থাই কার্যকরী। হাতে একটা ছোট বাঁশের টুকরা বা লাঠি সাথে নেয়া ভালো। এতে পাহাড়ি পথে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা থেকে শুরু করে সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী থেকে নিরাপদ রাখবে। সাথে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর খাবার স্যালাইন রাখতে ভুলবেন না। জীবাণুনাশক ক্রিম আর তুলা নেবেন। আর খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।
খরচ
চার-পাঁচজনের গ্রুপে খরচ হবে মাথাপিছু চার হাজার টাকার মতো। লেখক: ঢাকা ট্যুরিস্ট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট