Skip to content

লৌহমানবীর দেশে

Ifel-Tower

দিনের আইফেল টাওয়ার

ম্যারিনা নাসরীন
‘লৌহমানবীর দেশে’ শিরোনামটি দেখে অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, হয়তো ব্রিটেনের কথা বলছি। কারণ, ‘লৌহমানবী’ বা আয়রন লেডি বলতে আমরা ব্রিটেনের রানি মার্গারেট থ্যাচারকে চিনি। যিনি রক্তমাংসের তৈরি একজন মানুষ, যাকে লোহার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে লোহা দিয়ে তৈরি একটি কাঠামোকে যে মানবীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, সে বিষয়ে হয়তো অনেকেরই জানা নেই।

প্যারিসের দিনগুলো ঝড়ের গতিতে চলে যাচ্ছিল। প্রতিদিন ভোরে বের হই, রাতে ঘরে ফিরি। টাইট শিডিউল। প্যারিসের ভেতরেই দেখার মতো এত এত জায়গা, কোনটা রেখে কোনটায় যাই। তার ওপর রয়েছে আশপাশে স্বপ্নের নানা দেশ। ব্রাসেলস, জেনেভা, ইতালি কত কী! এর মধ্যে ঠিক হলো ১৬ তারিখে জার্মানের মিউনিখে যাব। আমার স্বামী মেলা সামলাবে, মোরশেদা আপা আর আমি জার্মানি ঘুরে আসব। তার আগে যেতে হবে আইফেল টাওয়ারে। ড্রাইভার নন্দ শ্রী সঙ্গে থাকায় রাস্তাঘাট চেনা নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। সেদিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেনটাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস। এই দিনটাকে আমরা আইফেল টাওয়ারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। যেতে হবে সন্ধ্যাবেলা, তা না হলে আইফেল টাওয়ার দেখে মজা নেই। রাতের ঝলমলে লৌহকুমারী যতটা লাস্যময়ী, দিনের বেলা ততটাই নীরস। ১৪ তারিখ সকালে বের হয়ে প্রথমে মোবাইলে ইন্টারনেট প্যাকেজ ঠিক করতে গেলাম।

রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা দোকানে এর আগের দিন মোবাইলের সিম কার্ড কিনে রিচার্জ করেছিলাম; কিন্তু নেট কানেকশন পাচ্ছিলাম না। যেহেতু আমাদের নামে সিম কিনতে গেলে নানা হ্যাপা, সেহেতু সব সিমকার্ড ফিরোজ ভাইয়ের নামে কেনা হলো। প্যারিসে এই একটা ঝামেলা, মোবাইলে সহজে নেট কানেক্ট হয় না। নির্মল নামের শ্রীলঙ্কান ছেলেটি বেশ কিছু সময় চেষ্টার পর আমার মোবাইলে নেট কানেকশন দিতে সমর্থ হলো। আমিও সেই ফাঁকে ফেসবুকে লগইন করে বন্ধুবান্ধবের খোঁজ নিলাম। ভার্সাই প্যালেসের কিছু ছবিও আপলোড করলাম। মেইল চেক করলাম। একটা বিষয় এখানে বলে রাখি, আপনি যদি প্যারিসে যান এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে চান, তাহলে জানাশোনা কারো নামে সিম ব্যবহার করাই ভালো। নিজের নামে সিম রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে অনেক ধরনের ফর্মালিটি রয়েছে।

মোবাইলের দোকান থেকে আমরা সেদিন সরাসরি চলে গেলাম মেলা প্রাঙ্গণে। মেলাটি হচ্ছিল লাবুর্জে নামক জায়গায়। বেশ বড় এরিয়া নিয়ে পার্মানেন্ট ফেয়ার কমপ্লেক্সে ফাইবার গ্লাস দিয়ে স্টলগুলো করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে মোট ১১টি কোম্পানি তাদের মালপত্র নিয়ে এই মেলায় অংশগ্রহণ করছে। প্যারিসের বুকে একসঙ্গে বেশকিছু বাঙালিকে দেখে ভীষণ ভালো লাগল। মেলাটি ছিল গার্মেন্টশিল্পের। তবে একটা বিষয় খেয়াল করলাম। যত স্টল ছিল, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্টলই চায়নার। কীভাবে তারা বিশ্ব মার্কেট দখল করে ফেলেছে, সেটা এখান থেকে সহজে অনুমেয়। ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের স্টলও যথেষ্ট ছিল।

যাই হোক, সেখানে এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নে বিকেল পর্যন্ত অবস্থান করে সন্ধ্যার আগে আগে আমরা আইফেল টাওয়ারের দিকে রওনা হলাম। আমাদের সঙ্গে গাড়ি ছিল। তবে না থাকলেও সমস্যা নেই। মেট্রোর খুব সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি চাইলে মেট্রো দিয়েও সেখানে সহজে চলে যেতে পারেন। যেকোনো মেট্রো স্টেশন থেকে Bir Hakeim নামের স্টেশনে নামলে সেখান থেকে সামান্য হেঁটে আইফেল টাওয়ার। শেইন নদীর তীরে এই টাওয়ারের অবস্থান।

ড্রাইভার নন্দ শ্রী আমাদের শেইন নদীর তীরে নামিয়ে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য, শেইন নদীটি দেখে যাওয়া। আমরা নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে সেই অনিন্দ্যসুন্দরীর দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। দূর থেকে রাতের আইফেল টাওয়ারকে দেখতে ঠিক যেন নীল আকাশের বুকে আলো ঝলমলে তরবারির মতো লাগছিল। সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। পেছনের গোল রুপালি চাঁদটি লৌহকুমারীর সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বর্ধিত করেছিল। আমরা বিমোহিত হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম।

Ifel-Tower2

শেইন নদীর তীরে সাঁঝবেলায় লৌহমানবী

আইফেল টাওয়ারের নিচে দেখা গেল, কৃষ্ণ বর্ণের কিছু আফ্রিকান যুবক বড় বড় গোলাপের তোড়া থেকে একটি-দুটি করে ফুল ট্যুরিস্টদের হাতে তুলে দিচ্ছে। আমাকে দুইটা গোলাপ দিল। ভ্যালেন্টাইন ডে। আমাদের দেশে আজকাল ভালোবাসা দিবসে সাজসাজ রব পড়ে যায়। রাস্তাঘাটে লাল ড্রেসের জুটি ঢাকা শহরকে রঙিন করে তোলে। গোলাপ ফুলের দাম বেড়ে যায় কয়েক গুণ। কিন্তু সে দেশে ভালোবাসা দিবসের বাড়তি কোনো আয়োজন চোখে পড়ল না। কিছু কিছু কাপল একে অপরের বাহুলগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুবকটি আমাকে যখন ফুল দিল, ভাবলাম হয়তো ভ্যালেনটাইন ডে উপলক্ষে ট্যুরিস্টদের ফুল উপহার দেওয়া সে দেশের কালচার। আমি সানন্দে ফুল দুটি হাত বাড়িয়ে নিতেই আমার স্বামী সম দ্রুততার সঙ্গে আমার হাত থেকে ফুল দুটি ছিনিয়ে লোকটিকে ফেরত দিল। আমি একটু অবাক হলাম। মনে মনে রাগও হলো। সে হেসে বলল, এর দাম কয় ইউরো চেয়ে বসবে তুমি জানো? অদ্ভুত, গোলাপ বিক্রির কথা আমার মনেই আসেনি।

প্রচণ্ড শীত। আমরা কিছু সময়ের মধ্যেই সেই লৌহমানবীর চার পায়ের নিচে এসে দাঁড়ালাম। বিশাল বিশাল চারটি পায়ের ওপর তিনি গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। এক পা থেকে অন্য পায়ের দূরত্ব প্রায় ১৫০ ফুট। চারটে পা থেকেই লিফট দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। আমরা উত্তরের পায়ের কাছে এসে লাইনে দাঁড়ালাম। দীর্ঘ কিউ। একদিকে প্রচণ্ড ঠান্ডা, অন্যদিকে শেইন নদী থেকে ধেয়ে আসা হিমেল বাতাস শরীরে বরফের হুল বিঁধিয়ে দিচ্ছিল। মাঝেমধ্যে ভাবছিলাম, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আগে জীবন বাঁচাই পরে আইফেল টাওয়ার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখে যাওয়ার ইচ্ছাটাই প্রবল হলো। একটা বিশাল লিফটে যত মানুষ ধরে, ততজন করে সামনে থেকে কমে যাচ্ছিল।

লাইনে থাকতেই একসময় পুরো আইফেল টাওয়ারের রূপ মনে হলো বদলে গেল। তার পুরো শরীরে লাখ লাখ জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। পরে জানলাম, এক ঘণ্টা পরপর আইফেল টাওয়ারের লাইটিংয়ের এই শো হয়। অভূতপূর্ব সুন্দর সে দৃশ্য। ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিউতে দাঁড়িয়েই আমি শীর্ষ দেখার চেষ্টা করলাম। শুনেছি উচ্চতা প্রায় ৩২৪ মিটার। এই উচ্চতায় একাশি তলা বাড়ি তৈরি করা যায়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব হয়, এর ঠিক একশ বছর পর ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শত বার্ষিকী উদযাপন এবং ইউনিভার্সাল এক্সপজিসন উপলক্ষে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাণ করেন স্থপতি গুস্তাফ আইফেল। স্থপতির নামেই টাওয়ারটির নামকরণ করা হয় ‘আইফেল টাওয়ার’। স্থানীয়ভাবে ফরাসিতে বলা হয় ‘তুর দ্যাফেল’। অনেকে আদর করে বলেন, ‘লা ডেম ডি ফার’ বা ‘দি আয়রন লেডি’। বাংলায় যাকে বলা যায় ‘লৌহমানবী’। আমার এই ভ্রমণ কাহিনীর শিরোনাম নেওয়ার রহস্য আসলে এখানেই, ‘লা ডেম ডি ফার’ বা ‘দি আয়রন লেডি’।

Ifel-Tower5

আইফেল টাওয়ারের শীর্ষ থেকে নিচের প্যারিস শহর

১৮ হাজার ৩৮ টুকরো লৌহখণ্ড জোড়া দিয়ে আইফেল টাওয়ার তৈরি করা হয়। এটিতে পঁচিশ লাখ রিভিট ব্যবহার করা হয়েছে এবং সময় লেগেছিল দুই বছর। শোনা যায়, তিনশ শ্রমিক এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চ আইফেল টাওয়ার উদ্বোধন করা হয় হয়েছিল। ওই বছর ৬ মে থেকে পর্যটকরা এই লৌহমানবীকে দেখার সুযোগ পান। পৃথিবীতে বিখ্যাত অনেক কিছুই প্রথমে তীব্র সমালোচনা সয়ে বিখ্যাত হয়েছে। আইফেল টাওয়ার তেমনই একটি স্থাপনা। সৃষ্টির শুরু থেকে এই আয়রন লেডিকে দেশে-বিদেশে নানা ধরনের অপবাদ সইতে হয়েছিল। বিরক্তিকর ছায়া, বিরক্তিকর রিভিট মারা লোহার পাত বলেছেন কেউ কেউ। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও বলেছিলেন, ‘আইফেল টাওয়ার মূর্খতার নিদর্শন।’ তবে আমাদের কবিগুরু রবিঠাকুর আইফেল টাওয়ারের প্রেমে পড়েছিলেন। এবং কথিত আছে তিনি এই টাওয়ারে বসে স্ত্রীকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন (১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর)।

যাই হোক, আইফেল টাওয়ারের ইতিহাস লিখতে গেলে বিশাল হবে। বর্তমানে এই লৌহস্তম্ভ যে ফ্রান্সের গৌরব, সেটা আমরা সবাই কমবেশি জানি। অর্থের বিনিময়ে বিশ্বের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান যত না দর্শনার্থীর ভিড় হয়, তার থেকে অনেক বেশি দর্শনার্থী আসে আইফেল টাওয়ার দেখতে। হিসাবমতে, প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ইউরো খরচ করে লৌহমানবীকে স্পর্শ করতে আসেন।

শীত বাড়ছিল, ওদিকে আমরা ক্রমেই কিউর প্রথমে চলে এসেছিলাম। টিকেট কাউন্টারে গিয়ে আমরা প্রতিজন ১৬ ইউরো করে টিকেট কাটলাম। এরপর আমাদের বিশাল একটি লিফটে তোলা হলো। আমার কাছে মনে হয়েছিল, লিফটটি আমাদের দেশের মাঝারি সাইজের একটি বেডরুমের মতো হবে। লিফটে এসে একটু আরাম পেলাম। বাতাস নেই, শীত কম। লিফট থেকে আমরা দোতলায় নামলাম। এখানে স্যুভেনির শপ দেখলাম যেখানে ছবি, ম্যাপ ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। ড্রিঙ্কস বা ফাস্টফুডের ব্যবস্থাও রয়েছে, তবে সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। আমরা দোতলা থেকে আর একটা লিফটে ওপরে চলে গেলাম। এই লিফটটি অপেক্ষাকৃত ছোট। প্রতি লিফটেই দীর্ঘ কিউ শেষে ঢুকতে হচ্ছে। কিন্তু সর্বোচ্চ তলায় যাওয়ার জন্য এস্কেলেটরের সামনে যে কিউ, সেটা দেখে হতাশ হলাম। টিকেট চেকিং চলছে। পার হয়ে যেতে কত সময় লাগবে কে জানে।

Ifel-Tower6

শীর্ষের সেই ঘরটিতে গুস্তাভ আইফেল

এদিকে শীতে দাঁতে কপাটি লেগে যাওয়ার অবস্থা। প্যারিসে গিয়ে একটা বিষয় আমার বিস্ময় উদ্রেক করল। সেখানে খুব ছোট্ট ছোট্ট শিশুকে নিয়ে বাবা-মা নির্দ্বিধায় বাইরে বের হন। আমরা শীতে বাচ্চাদের যতটা সম্ভব ঘরে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তুই সেখানে দেখলাম, কয়েক দিন বয়সী শিশুকে নিয়ে তাঁরা বেরিয়েছেন। কারো বুকের সঙ্গে ঝোলানো, কারো পিঠে; কোনো কোনো বাচ্চা প্র্যামে। তবে যাদের সঙ্গে শিশু রয়েছে, সিরিয়ালের ক্ষেত্রে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আমার সামনে বেশ কয়েকটা শিশু ছিল। দেখতে এত কিউট যেন একেকটা বিশাল সাইজের গোলাপ ফুল। বারবার মনে হচ্ছিল ছুঁয়ে দিই। কিন্তু বিদেশবিভুঁই, নিজেকে আটকালাম। আমার পেছনে এক জাপানি বালিকা ঘ্যানঘ্যান করছে এবং কাঁদছে । প্রশ্ন করে বুঝলাম, তার আর ভালো লাগছে না, সে ঘরে ফিরতে চায়। বেশ সামনের এক জুটির আবার অন্য কাহিনী। তাঁরা কিছুক্ষণ পরপর দুজন দুজনকে এমনভাবে জাপটে ধরছে এবং চুম্বন করছে যে উদাসীনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাঙালি মেয়ে আমি, শরম-ভরমের একটা বিষয় তো রয়েছেই।

শেষ পর্যন্ত টিকেট জমা দিয়ে আমরা লৌহকন্যার শিখরে উঠে এলাম। এখান থেকে নিচে তাকিয়ে প্যারিসকে দেখছি যেন দূরের কোনো স্বপ্নের আলোক শহর। সামান্য দূরে শেইন নদীতে রংবেরঙের নৌবহর চলছে। প্রচণ্ড বাতাসে আমার চুল ঝড়ের মতো উড়ছে। কাছের কারো কথা শুনতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণের জন্য ভেবে নিলাম, আমি আকাশের কাছে পৌঁছে গেছি এবং আকাশে বিশাল চাঁদ আমার খুব কাছে। পুরো এরিয়া বেশি নয়। আমরা ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে থেমে গেলাম। মাথার একটু ওপরে বিভিন্ন দেশের পতাকা এবং আইফেল টাওয়ার থেকে সে দেশের দূরত্ব লেখা। সেসব পতাকার ভিড়ে আমার প্রিয় স্বদেশের লাল-সবুজে আঁকা পতাকাটি ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। মনে হলো কত দূরে অথচ কতই না কাছে!

শীর্ষের কেন্দ্রে একটি ছোট ঘর মতো। ঘরটির মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলাম গুস্তাভ আইফেল এবং টমাস আলভা এডিসন (মূর্তি) বসে আলাপে মত্ত। পাশেই গুস্তাভ আইফেলের কন্যা ডট উদাসীনভাবে বসে আছেন। ক্যামেরায় শাটার ফেলে তাঁদের আমার স্মৃতিতে ধরে রাখলাম। রেলিংয়ে ঝুঁকে আর একবার দেখে নিলাম নিচের প্যারিস আর ওপরের চাঁদ। লোহার ফাঁক দিয়ে ধেয়ে আসা বাতাস তখন অনেকটা কাবুতে।

Ifel-Tower7

রাতের আইফেল টাওয়ার

রাত বাড়ছিল। ধীরে ধীরে মানুষ কমে যাচ্ছিল। আমরাও ফেরার লিফট ধরলাম। সুন্দর বা আকাঙ্ক্ষিত যেকোনো কিছুই ছেড়ে আসার মধ্যে অনেকখানি শূন্যতা কাজ করে। আমার মধ্যেও ক্ষণিকের জন্য অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি হল। নিচে নেমে দেখলাম, ফিরোজ ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কৃষ্ণ বর্ণের মানুষগুলো তখন পর্যন্ত হাতে গোলাপ আর আইফেল টাওয়ারের রেপ্লিকা নিয়ে ক্রেতা ভঞ্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু কৃষ্ণরাই কেন? ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল, দেশে দেশে একই রীতি। আমি ফুল নিলাম না। তবে সোনালি-রুপালি মিলিয়ে অনেক রেপ্লিকা নিলাম। কুয়াশা মোড়া শহর কিন্তু আলোর ছটা এত বেশি যে কুয়াশার পর্দা খুব একটা ভারী হতে পারে না। আমি, আমার স্বামী, মোরশেদা আপা, ফিরোজ ভাই—আমরা চারজন হাঁটতে হাঁটতে আবারও শেইন নদীর ধারে চলে এলাম। এখান থেকে আইফেল টাওয়ার একটু দূরে। তার শীর্ষ থেকে নীল রঙের লাইট শহর পরিভ্রমণ করছে। দূর থেকে দেখার এই সৌন্দর্য আলাদা। নদীর ধারে সিঁড়িতে বসে নদীর পানিতে চাঁদের আলোর খেলা দেখছি। আমাদের পাশে আড্ডাবাজ আরও অনেক মানুষ। সামান্য দূরে কিছু তরুণ-তরুণী গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। স্থানীয় গান। সুতরাং কথা বুঝতে পারছি না, তবে সুরের মূর্ছনায় বাতাসও মনে হলো উন্মনা হয়ে উঠছে। সেই দেশ, সেই নদী, সেই জ্যোৎস্না ভেজা রাত, সেই গান আর আইফেল টাওয়ার আমরা ভিনদেশি কজন মানুষ—এ এক অনন্য সংযোগ।

সবশেষে গাড়িতে উঠতে গিয়ে যখন দরজায় হাত রাখলাম, ঠান্ডায় হাত শিরশিরিয়ে উঠল। এতক্ষণে বুঝলাম, আমি আমার একটি হাতমোজা ফেলে এসেছি সেই লৌহমানবীর কাছে। থাকুক, কিছু সময় আমার স্মৃতি ওর কাছে, ওর স্মৃতি আমার কাছে রইল আজীবন। সৌজন্যে: এনটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *