সীমান্ত দীপু
২৫ আগস্ট ২০১৩
সাদা মানুষ ক্রিস বাউডেন। শকুনের স্লাইড দেখাচ্ছিলেন একটি ঘরোয়া সভায়। একটি-দুটি স্লাইডের ওপর লাল ডট। এর অর্থ, শেষ হয়ে গেছে। দেখানো শেষ হলে আমি কৌতুক করে বললাম, তুমি এত সুন্দর মানুষ, আর কাজ করো এ রকম একটি অসুন্দর পাখি নিয়ে! সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর প্রতিবাদ, তুমি মনে হয় কখনো শকুন দেখনি দীপু। বাংলার প্রকৃতিতে ঝকঝকে রোদের আকাশে তো নয়ই! একবার দেখে নিয়ে কথা বলো। ব্রিটিশ বাউডেনের কথাগুলো মনে বসে গেল। ক্রিসের কাছেই শুনেছিলাম প্রায় ৪ কোটি বাংলা-শকুন ছিল এই উপমহাদেশে। মাত্র দুই যুগেই এর ৯৯ শতাংশ হারিয়ে গেছে। অথচ শকুন প্রাকৃতিক পরিষ্কারক। শকুন হারিয়ে যাচ্ছে বলে অ্যানথ্রাক্সের মতো জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে এখন মাত্র ১০ হাজার শকুন টিকে আছে। বাংলাদেশে আছে মাত্র ৫০০। হারিয়ে যাওয়ার পেছনে একটি ওষুধই প্রধান কারণ। এর নাম ডাইক্লোফেনাক (ওষুধের ক্রিয়া পশুর শবদেহেও থাকে। শকুন সেগুলো খেয়ে রোগে আক্রান্ত হয়)। গবাদি পশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ওই মাসেই শকুন রক্ষায় একটি জাতীয় কমিটি করা হলো। আমাকে কমিটির সদস্যসচিব করা হলো।
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩
সিলেটের খাসিয়াপল্লীর একটি স্কুল। ইনাম আল হক সঙ্গে আছেন। শকুন নিয়ে আলাপে তিনি বললেন, ‘আজ শকুন রঙের একটি জামা পরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই রঙের জামা আমার নেই।’ একজন কেউ বলল, আপনার গায়ের রং তো প্রায় শকুনের মতোই। ইনাম ভাই উত্তরে বললেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ জানাই যে আপনি আমাকে সঠিক কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন। শকুনের রঙে সত্যিই আমি গর্ববোধ করি।’
ওই দিনই অর্ধশত শকুন আমরা উড়তে দেখেছিলাম। বাউডেনের কথা মনে পড়ে গেল, নীলাকাশে শকুনের ওড়াউড়ি সত্যি মনোমুঙ্কর।
৪ মার্চ ২০১৪
বাংলাদেশ বন বিভাগ ও আইইউসিএন বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে বাংলা-শকুন প্রকল্প শুরু হলো। ওই প্রকল্পের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে। শুরু হলো বাংলা শকুন টিকিয়ে রাখার লড়াই। শকুন বাঁচানোর জন্য আমাদের দেশে এটিই প্রথম বড় কোনো উদ্যোগ। তানিয়া খান ঢেওড়াছড়ার শকুনদের খোঁজখবর রাখছেন অনেক দিন। আমার ইচ্ছা, শকুনের হটস্পট শনাক্ত করে একটি ম্যাপ তৈরি করা। খুব ভোরেই তানিয়ার সঙ্গে মৌলভীবাজার থেকে রওনা দিলাম। শমশেরনগর পার হওয়ার আগেই একদল শকুনকে একটি মরা গরু খেতে দেখলাম। প্রায় ২৫ বছর পর দেখতে পেলাম এমন দৃশ্য। নব্বইয়ের দশকে আমার গ্রামে শত শত শকুন দেখেছি।
২০ এপ্রিল ২০১৪
রেমার বনে পাখি দেখতে গেছে বন্ধু সায়েম। ফিরে এসে জানাল, প্রায় ৫০টি শকুন আছে ওই বনে। কয়েকটি বাসাও সে পেয়েছে। বাসায় শকুনের বাচ্চাও আছে। দেরি না করে পরদিন ভোরেই রওনা দিলাম। সত্যিই শকুনের বাসা ও বাচ্চা পেলাম। ওই প্রজনন মৌসুম পুরোটা সময় রেমার বনে ঘুরে বেড়ালাম। আটটি বাচ্চা ওই বছর পেলাম।
২৬ জুলাই ২০১৪
সারা দেশে শকুন শুমারি শেষ হলো। সম্ভাব্য সব জায়গায় আমরা গেলাম। ২০০-র বেশি শকুনের দেখা পাইনি।
২২ নভেম্বর ২০১৪
শকুন সংরক্ষণে একটি আন্তর্জাতিক সভা হলো বাংলাদেশে। পৃথিবীর প্রায় সব গবেষকই এলেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সভার উদ্বোধন করতে এসে অভিজ্ঞতা বললেন, ‘আমাদের একটি ভাঙা এয়ারগান ছিল। আমরা ছেলেরা হুল্লোড় করে সেটি দিয়ে শকুন তাড়াতাম। এখন আফসোস হচ্ছে! কোনো দিন ভাবিনি, শকুন শেষ হয়ে যাবে, বিশ্বের শকুন গবেষকদের এভাবে একটি সভায় বসতে হবে। আমিও আপনাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাই। শকুন সংরক্ষণে সরকার সব ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে।’ পরের মাসেই সরকার এ দেশে শকুনের জন্য দুটি নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করল। দুনিয়ার প্রথম সরকার ঘোষিত শকুনের নিরাপদ এলাকা এটি। আরো খুশির কথা, প্রায় ৪০ বছর পর রেমার বনে প্রথম দেখা মিলল সরুঠোঁটি শকুনের।
১২ জানুয়ারি ২০১৫
শকুনের প্রজনন মৌসুম। সারা দেশে আমরা ছয়টি শকুন সংরক্ষণ দল গঠন করেছি। এরা শকুনের বাসা দেখভাল করছে। মস্তু মিয়া শকুন সংরক্ষণ দলের একজন নিয়মিত সদস্য। লোকমুখে শুনি, তিনি নাকি বনে ঢোকার পাস দেন স্থানীয়দের! সেই তিনিই এখন চার দিন পরপর শকুনের ৩২টি বাসা দেখে আসেন। তিনি পড়ালেখা জানেন না, তাঁর মেয়ে তথ্যাদি টুকে রাখে। মাস শেষে আমরা তা সংগ্রহ করি। প্রজনন মৌসুম শেষে এবার পেলাম ১৫টি বাচ্চা।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
শকুনের গবেষণা করতে এসে তিনটি বড় সমস্যা শনাক্ত করলাম। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ক্ষতিকর ওষুধ। পরের দুটি হলো খাবার ও পর্যাপ্ত বাসা বানানোর গাছ। সরকার পশু চিকিৎসায় বহু আগেই ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করেছে। কিটোপ্রোফেন বন্ধেও উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু নিরাপদ খাবারের কী হবে। শকুনের জন্য নিরাপদ ‘খাবার স্টেশন’ তৈরির পরিকল্পনা করলাম। রেমায় এর কার্যক্রম শুরু হলো। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা হলো ওই এলাকায় যেসব গরু মারা যাবে, তা যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিরাপদ মনে হয় তবে শকুনের খাবার স্টেশনে ফেলা হবে। সে অনুযায়ী গরু ফেলা হলো নিয়মিত। সেসঙ্গে আমরা ওই এলাকায় গাছের চারা বিতরণ শুরু করলাম। প্রাথমিকভাবে শকুন বাসা বাঁধতে পছন্দ করে এ রকম চার জাতের গাছ লাগানোর কার্যক্রম শুরু হলো।
৩ মার্চ ২০১৫
সুন্দরবনের কাছাকাছি বটিয়াঘাটা উপজেলায় একটি শকুনের কলোনি আছে। একটি বাড়িতে নারিকেলগাছে তারা বিশ্রাম নেয়। বাড়ির গৃহস্থ না বুঝে তাড়িয়ে দেন। এমনকি এয়ারগান দিয়ে গুলিও চালান। একবার আমরা তাঁর বাড়িতে গেলাম। সব কিছু খুলে বলার পর সেই লোকই নিজের নারিকেলগাছ শকুনের জন্য বরাদ্দ করলেন। ওই মাসেই সুন্দরবনে আমরা শুমারি পরিচালনা করি। বাসা, বাচ্চা সবই পাই সুন্দরবনে।
২৮ জুন ২০১৫
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম ভেটেরিনারি ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে। তাঁরা বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন। এ বছরের শুরুর দিকে পঞ্চগড়ে প্রায় ২০টি অসুস্থ শকুনের দল পাওয়া গেছে। তারা সুস্থ করার জন্য কাজ করেছেন। মৃত শকুনের পোস্টমর্টেম করেছেন।
২৭ আগস্ট ২০১৫
পশু চিকিৎসায় মেলোক্সিক্যামের ব্যবহার শকুনের জন্য ভালো। ওষুধ কম্পানি একমি তার প্রোডাক্টের কভারে শকুনের ছবি দিয়ে এই ওষুধটি পশু চিকিৎসায় ব্যবহারে উৎসাহিত করেছে।
ভালো থেকো শকুন
বন্ধুরা আমাকে ডাকে শকুনের ম্যানেজার বলে। আমার খারাপ লাগে না। গত দুই বছর আমি যত কথা বলেছি তার বেশির ভাগই শকুন নিয়ে। আগের মাসে রেমার বনে গিয়ে দেখেছি, একটি বাচ্চা শকুন বড় হয়ে গেছে। প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। ধন্যবাদ বাউডেন। তোমার মতোই এখন আমি প্রার্থনা করি, বাংলার আকাশে আবার শকুন ফিরে আসুক। ভালো থাকুক শকুনেরা।
ছবি: লেখক ও সংগৃহীত। সূত্র : কালের কণ্ঠ