ইকবাল খন্দকার
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর। এই দিনে ‘দ্য ঢাকা নিউজ’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম তুলে ধরা হয় এ দেশে জাদুঘর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথা। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মার্চ তৎকালীন সচিবালয়ে দুই হাজার রুপি তহবিল নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয় জাদুঘরের। বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের একটি কক্ষে জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট যাত্রা শুরু করে জাদুঘরটি। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট এটি উন্মুক্ত করা হয় সর্বসাধারণের জন্য। তবে তখন এই জাদুঘরের নাম ছিল ঢাকা জাদুঘর।
ঢাকা জাদুঘরকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা দেয়া হয় ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর। একই দিনে জাদুঘরের জন্য একটি অত্যাধুনিক বৃহদায়তন ভবনের উদ্বোধন করা হয় ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে। আট একর জমির ওপর নির্মিত চারতলা এই ভবনটির তিনটি তলাজুড়ে রয়েছে ৪৪টি গ্যালারি। জাতীয় জাদুঘর বেশ কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত। এই বিভাগগুলো হলো- ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা, জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা, সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা, প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ, সংরক্ষণ গবেষণাগার ইত্যাদি।
ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগটি জাতীয় জাদুঘরের সবচেয়ে বড় বিভাগ। এ বিভাগের নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন আমলের মুদ্রা। এই বিভাগে আরো রয়েছে- পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ ও প্রস্তর ভাস্কর্য, প্রাচীন স্থাপত্যিক নিদর্শন, শিলালিপি, তাম্রলিপি, মৃৎপাত্র, পাণ্ডুলিপি, ঐতিহাসিক দলিলপত্র, কৃতী সন্তানদের ব্যক্তিগত স্মৃতিনিদর্শন, অস্ত্রশস্ত্র ও আলোকচিত্র। এই বিভাগে ব্রোঞ্জ ও প্রস্তরের যেসব ভাস্কর্য রয়েছে- অলঙ্করণ, কারুকার্য ও শিল্পমানের বিবেচনায় এগুলো সমগ্র পৃথিবীতে অনন্য।
আর পোড়ামাটির ফলক- বিশেষ করে মহাস্থান, ময়নামতি, পাহাড়পুর ও মধ্যযুগের মন্দির-মসজিদে ব্যবহৃত অলঙ্কৃত ফলকগুলো এই বিভাগের গ্যালারির অন্যতম আকর্ষণীয় দৃশ্যপট। জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা বিভাগের অধীনে রয়েছে মোট ১৬টি গ্যালারি। যেখানে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনধারা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই বিভাগে সংরক্ষিত নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে- বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও সামাজিক পেশাজীবী মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি এবং প্রথা সংশ্লিষ্ট নিদর্শনাদি, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, নৌকা, হাতিয়ার, অস্ত্রশস্ত্র, দারু শিল্পকর্ম, কারু শিল্পকর্ম, ধাতব শিল্পকর্ম, চীনামাটির শিল্পকর্ম, হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম, সুচি শিল্পকর্ম, পরিধেয় বস্ত্র ও অলঙ্কারসামগ্রী, নকশিকাঁথা, বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি।
কামার, কুমার, জেলে, কৃষক, গ্রাম্য হাটবাজার, জনজীবন ও আদিবাসী সংস্কৃতির ওপর নির্মিত কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ডিওরামা এই বিভাগের গ্যালারির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক। দৃষ্টিনন্দন দারু শিল্প- যেমন অলঙ্কৃত ও কারুকার্যখচিত খাট, পালকি, কাঠের বেড়া, আসবাবপত্র, ঢেঁকি প্রভৃতি নিদর্শন জাদুঘর পরিদর্শনকারী দর্শকদের আনন্দ ও কৌতূহলের উৎস। রুপার উন্নত তারজালিক শিল্পকর্ম এবং হাতির দাঁতের শীতলপাটি, সোনা-রুপার অলঙ্কারসামগ্রী নিঃসন্দেহে একটি উন্নত জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে।
সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগে রয়েছে সাতটি গ্যালারি, যেখানে উপস্থাপন করা হয়েছে দেশী-বিদেশী সমকালীন শিল্পকর্ম এবং বিশ্বসংস্কৃতির নিদর্শনাদি। জাতীয় জাদুঘরের আর্ট গ্যালারি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের বরেণ্য শিল্পীদের শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো হয়েছে এসব গ্যালারি। আর্ট গ্যালারির শুরু হয়েছে বাংলাদেশের শিল্পকলা চর্চার পথিকৃৎ জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম দিয়ে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ওপর জয়নুল আবেদিনের আঁকা চিত্রকর্ম দুর্ভিক্ষের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেয়।
এ ছাড়াও জেলেজীবন, বেদেদের জীবন, বিদ্রোহী, প্রকৃতি ও গ্রাম্য জনজীবনের ওপর আঁকা জয়নুলের বিভিন্ন শিল্পকর্ম নাড়া দেয় দর্শকদের অনুভূতিকে। আর্ট গ্যালারির একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে শিল্পী এস এম সুলতান, কামরুল হাসান এবং ভাস্কর নভেরার শিল্পকর্ম। বিশেষ করে এস এম সুলতানের শিল্পকর্মে সুচারুরূপে প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামীণ জনজীবন। জাতীয় জাদুঘরের চতুর্থ তলায় রয়েছে বিশ্বসভ্যতা গ্যালারি। রেনেসাঁ যুগ থেকে আধুনিক ইউরোপীয় বিখ্যাত শিল্পকর্মের মূল ও অনুকৃতি উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে।
এ ছাড়াও রয়েছে ইরানীয় কর্নার, সুইজারল্যান্ড কর্নার, কোরীয় কর্নার, চাইনিজ কর্নার ইত্যাদি। এসব কর্নারে উপস্থাপন করা হয়েছে ওইসব দেশের শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, বাদ্যযন্ত্র, চীনামাটি ও ধাতব শিল্পকর্ম এবং সর্বোপরি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী। প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগটি সাজানো হয়েছে গাছপালা, প্রাণিবৈচিত্র্য ও পতঙ্গের অস্তিত্বের ইতিহাস দিয়ে। আর সংরক্ষণ গবেষণাগারে রয়েছে গবেষণার নানা উপকরণ।
প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আজকের বাংলাদেশ যতগুলো অধ্যায় পার করেছে, সব ক’টির চিহ্ন ধরে রেখেছে জাতীয় জাদুঘর। যে কারণে আমাদের কাছে জাদুঘর মানেই এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর দৃষ্টিনন্দন শিল্পের সমাহার। এই ইতিহাস, ঐতিহ্য আর দৃষ্টিনন্দন শিল্প অক্ষুণœ থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সূত্র : নয়া দিগন্ত