Skip to content

শিশুর যত ইনজুরি

শিশুদের বিপদ ঘটে হঠাৎ, যা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে কী ধরনের বিপদ হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে করণীয়ই বা কী-এ বিষয়ে লিখেছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী

শিশু-কিশোর বয়সে নানা ধরনের ইনজুরি হয়। এক থেকে চার বছরের শিশু খুব চঞ্চল ও কৌতূহলী হয়, বিধায় এ বয়সে ইনজুরির হার খুব বেশি। যেমন : হঠাৎ শ্বাসরোধ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু বেশি ঘটে।

শিশুদের ইনজুরি বা হঠাৎ বিপদে কী করা উচিত-সে বিষয়ে প্রত্যেকেরই ধারণা থাকা উচিত।

Child

গলায় কিছু আটকে গেলে

গলায় কিছু আটকে যাওয়াকে বলে চকিং, যা মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। নিচের লক্ষণ থাকলে ধরে নেওয়া হয় শিশুর গলায় কিছু আটকে গেছে।
* শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসে টান উঠেছে বা শাঁই শাঁই শব্দ শোনা যাচ্ছে
* কথা বলতে, কান্না করতে বা মুখে আওয়াজ করতে পারছে না
* ঠোঁট-জিব-মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে
* নিজের গলা বা হাতে হাত বোলাচ্ছে
* শিশু ভীষণ আতঙ্কিত অবস্থায় আছে।

যা করতে পারেন

দাঁড়ানো অবস্থায় শিশুর মুখে হাত ঢুকিয়ে বা পিঠে চাপড় দিয়ে আটকে যাওয়া বস্তু বের করে আনতে চেষ্টা করবেন না, বরং এতে তা শ্বাসনালিতে আরো ভয়ানকভাবে আটকে যেতে পারে।
শিশুকে পেছন থেকে ধরে মাথা নিচু করে পেটের দিকে চাপ দিন। এ পদ্ধতিটি হেমলিখ ম্যানুইভার (Heimlich maneuver) নামে পরিচিত।
শিশুটিকে দ্রুত হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।

মনে রাখুন

* শিশু যদি অনবরত কাশে এবং কথা বলতে পারে, তবে বুঝতে হবে শ্বাসনালি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। এ অবস্থায় বেশি কিছু না করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
* যদি শিশু অচেতন হয়ে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ মনে হয়, তবে ট্রেনিং থাকলে কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন বা ‘সিপিআর’ অবলম্বন করুন।
* শিশু যদি অনবরত কাশে বা শ্বাসে শাঁই শাঁই শোনা যায়, শ্বাসকষ্ট বা গিলতে অসুবিধা দেখা যায়, তবে হাসপাতালে নিয়ে যান।
* চার বছরের ছোট শিশুকে গলায় আটকে যেতে পারে এমন খাবার দেবেন না। যেমন-ছোলা, বাদাম। ফল কেটে ছোট করে দিন।
* খাবার সময়ে যেন কথা না বলে বা জোরে না হাসে।
* বোতাম, ব্যাটারি, বেলুন, কয়েন যেন ছোট শিশুর নাগালে না আসে।

মাথায় আঘাত

শিশু বয়সে মাথায় আঘাত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সামান্য হয় এবং মাথার বাইরের দিকে আঘাত সীমাবদ্ধ থাকে। কখনো কখনো হেড ইনজুরিতে মগজেও চোট লাগে, যার তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার প্রয়োজন।
অল্প ইনজুরিতে-মাথার বাইরের দিকে ফুলে যায়, কেটে যায়, দুই বা তিনবার বমি হতে পারে।
মারাত্মক ধরনের ইনজুরিতে-শিশু জ্ঞান হারায়, জখম স্থান বেশি কেটে যায় বা ফুলে যায়, নাক বা কান থেকে তরল বা রক্ত ঝরে, আচরণ অস্বাভাবিক, ঘুম ঘুম ভাব, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, আঘাতের প্রথম ঘণ্টায় তিনবারের বেশি বমি হয় বা জ্ঞান হারায়।

যা করতে পারেন

অজ্ঞান হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে থাকলে ‘সিপিআর’ দিন।
শিশু বেশি ক্লান্ত থাকলে তাকে শুইয়ে দিন এবং ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।

চোখে আঘাত

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চোখের আঘাত তুচ্ছ ধরনের হয়, যেমন চোখে সাবান লাগা বা চোখের পাতার নিচে কাদা-ময়লা আটকে থাকা ইত্যাদি। তবে কখনো কখনো বিশেষত খেলাধুলার সময় শিশু চোখে মারাত্মক আঘাত পেতে পারে।

যা করতে পারেন

সামান্য সমস্যা যেমন ময়লা-কাদা-বালি ইত্যাদি লেগে গেলে চোখে ভালোভাবে পানির ঝাপটা দিন। চোখে পানির ঝাপটা দেওয়ার জন্য আস্তে করে চোখের নিচের পাতা নিচের দিকে টেনে নিন। এরপর হালক গরম পানি দিয়ে ১৫ মিনিট ধরে চোখ ধুয়ে দিন। আর প্রতি ৫ মিনিট পর পরীক্ষা করে দেখুন ওই বস্তু চলে গেছে কি না।
যদি বল বা অন্য কোনো বস্তুর আঘাত সরাসরি চোখে লাগে, চোখ লাল বা খচখচ অবস্থা থেকেই যায়, দেখতে অস্বস্তি, চোখে বা তার চারপাশে ফুলে যায়, ব্যথা হয়, আলোতে গেলে সমস্যা হয়, রক্ত আসে, আঘাত পাওয়ার পর বমি হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে।

দাঁত ও মাড়িতে আঘাত

আঘাতে যদি শিশুর দুধদাঁত পড়ে যায়, তবে তা আর আগের স্থানে বসানো ঠিক নয়। স্থায়ী দাঁত পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা আগের স্থানে বসালে দাঁতটি বসে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেওয়া অবশ্য কর্তব্য।

Child2

যা করতে পারেন

ঠাণ্ডা পানিতে চোবানো গজ দিয়ে রক্তপাতের স্থান চেপে ধরুন, ফোলা কমানোর জন্য বরফ প্যাক ব্যবহার করুন, ব্যথা উপশমে প্যারাসিটামল দিন। যদি স্থায়ী দাঁত পড়ে যায়, তবে সম্ভব হলে ওই দাঁত সংগ্রহ করে দুধ, ডাবের পানি বা স্যালাইনে ডুবিয়ে ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে যান।

পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে

চঞ্চলতার কারণে পড়ে যাওয়া, আঘাত পাওয়া শিশুদের জন্য সাধারণ ঘটনা। ফল হিসেবে চোট, ক্ষত, কেটে যাওয়া, ছড়কে যাওয়া প্রায়ই ঘটে। কোনো কোনো ইনজুরি মারাত্মক ধরনেরও হতে পারে।

যা করতে পারেন

শিশু যদি মাথায়, ঘাড়ে, পিঠে, উরুতে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়, অজ্ঞান হয়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হয়, খিঁচুনি হয়, দুই-তিনবারের বেশি বমি হয়, হাঁটতে না পারে, ভালোভাবে চোখ খুলতে না পারে, তবে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। শিশুকে চিত করে না শুইয়ে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে। এতে তার শ্বাস-প্রশ্বাস সচল থাকবে।
আর আঘাত যদি গুরুতর না হয়, তবে কোথাও ফোলা থাকলে বরফ সেঁক দিন, ব্যথানাশক হিসেবে প্যারাসিটামল দিন, কয়েক ঘণ্টার জন্য তাকে বিশ্রামে রাখুন, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় তার আচার-আচরণে পরিবর্তন হয় কি না, তা লক্ষ রাখুন।

হাড় ভেঙে গেলে

যদি হাড় ভেঙে যায়, তবে কোন হাড় ভাঙল, তা বেশি না কম-এসব না ভেবে, দেরি না করে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণত হাড় ভেঙে গেলে আক্রান্ত স্থান নড়াচড়ায় সমস্যা হয়। ওই স্থান ধরলে বা সরাতে গেলে ব্যথা হয়।

যা করা উচিত

ভাঙা স্থান থেকে কাপড়চোপড় সরিয়ে নিন, বরফ কাপড়ে মুড়িয়ে ওই স্থানে বরফ সেঁক দিন, আক্রান্ত অঙ্গ নাড়াবেন না, নিজেরা হাড় জোড়া লাগানোর চেষ্টা করবেন না। দেরি না করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।

অস্থিসন্ধির বিচ্যুতি

শরীরের দুটি অস্থি পরস্পর সংযুক্ত ছিল, এখন ছুটে গেছে। এ রকম অস্থির চোট শিশু বয়সে ঘটে পড়ে গিয়ে কিংবা স্পোর্টস ইনজুরি হিসেবে বেশি ঘটে, যা বাংলাদেশে জয়েন্ট ছুটে যাওয়া নামে পরিচিত।
সাধারণত অস্থিসন্ধির বিচ্যুতি হলে ওই স্থান ফুলে যায়, লালচে হয়, তীব্র ব্যথা হয়, নড়াচড়ায় সমস্যা হয়ে, নড়াচড়া করলে শব্দ হয়।

যা করতে পারেন

যেভাবে জয়েন্ট আছে সেভাবেই রাখুন, নড়াতে গেলে রক্তনালি, মাংসপেশি, স্নায়ু রজ্জু ছিঁড়ে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। বরফের সেঁক দিন। ব্যথা উপশমের জন্য প্যারাসিটামল দিতে পারেন। নিজেরা জয়েন্ট আগের স্থানে না বসিয়ে ডাক্তারের সহায়তা নিন।

মাংসপেশিতে টান

অল্প বয়সী শিশুর চেয়ে এ ইনজুরি বয়ঃসন্ধিতে বেশি ঘটে। লক্ষণ হিসেবে থাকে জয়েন্ট বা মাংসপেশিতে ব্যথা, ফোলা, আক্রান্ত অঙ্গ নড়াচড়ায় অসুবিধা ইত্যাদি। এ ধরনের ইনজুরি হলে শিশুকে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা বিশ্রামে রাখতে হবে। আক্রান্ত স্থানে বরফ সেঁক দিতে হবে, ব্যান্ডেজও লাগতে পারে, আক্রান্ত অঙ্গ বালিশের সাপোর্ট দিয়ে একটু উঁচু করে রাখতে হবে।

ত্বকে কিছু ঢুকে গেলে

ত্বকে কিছু ঢুকে গেলে তা যত দ্রুত সম্ভব বের করে আনা উচিত। এতে ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। এ জন্য সাবান ও গরম পানি দিয়ে প্রথমে নিজের হাত ও পরে ক্ষতস্থান ধুয়ে নিন। যে বস্তু ঢুকেছে তার এক মুখ বের হয়ে থাকলে যেভাবে ঢুকেছে সেই কৌণিক অবস্থান থেকে টান দিন বা একটু চামড়ায় সেঁটে গেলে চামড়ার মুখ ছাড়িয়ে ওটা বের করে আনুন। কাজ শেষে ওই স্থান আবার ধুয়ে দিন ও ব্যান্ডেজ করুন।
যদি কোনো বস্তু গভীরভাবে ঢুকে যায়, যা বের করা যাচ্ছে না, তবে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

কেটে গেলে

ছুরির মতো ধারালো কোনো জিনিসে বা পড়ে গিয়ে অনেক শিশুর কেটে যায়। কিছু কিছু কাটা আছে, যা বাসায় নিরাপদে সামলে নেওয়া যায়; কিন্তু গভীর কাটা বা ক্ষত, যাতে রক্তপাত বন্ধ নাও হতে পারে-তখনই মেডিক্যাল ব্যবস্থাপনা লাগবে।

ক্ষত যদি গভীর হয়-

* কাটা স্থান পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে দিন ও পরিষ্কার কাপড়, গজ-ব্যান্ডেজ দিয়ে শক্তভাবে চেপে ধরুন।
* যদি ব্যান্ডেজ চুইয়ে রক্ত ঝরতে থাকে, তবে এর ওপরে আরো গজ-ব্যান্ডেজ দিয়ে চেপে রাখুন।
* আক্রান্ত অঙ্গ ওপরের দিকে তুলে রাখুন, তাতে রক্ত কম ঝরবে।
* রিাবার বা রশি দিয়ে বেঁধে দেবেন না। এরপর দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।

পুড়ে গেলে

শিশু মারাত্মকভাবে পুড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করুন। হাসপাতালে নেওয়ার মাঝের সময়টাতে পোড়া অংশ থেকে কাপড়চোপড় সরিয়ে নিন। তবে যেসব কাপড় পুড়ে যাওয়া ত্বকে লেগে যায় তা ছাড়ানোর চেষ্টা করবেন না। ক্ষতস্থানে ঠাণ্ডা পানি ঢালতে থাকুন, তবে বরফ সেঁক দেবেন না। পোড়া স্থানে মলম, ঘি, ডিম বা অন্যান্য কিছু লাগাবেন না। ফোসকা দেখা গেলে তা গেলে দেবেন না।

পশু কামড় দিলে

কামড়ানোর ক্ষতস্থান যত দ্রুত সম্ভব সাবান ও পরিষ্কার জলে ধুয়ে দিন। যদি রক্ত ঝরতে থাকে, তবে জীবাণুমুক্ত গজ পিস বা পরিষ্কার কাপড়ে চেপে ধরুন। রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে গেলে, অ্যান্টিবায়োটিকস অয়েনমেন্ট লাগিয়ে দিন। পুরো ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ বা জীবাণুমুক্ত গজ দিয়ে ঢেকে রাখুন। শিশুকে ব্যথানাশক প্যারাসিটামল ওষুধ সেবন করান। এরপর ডাক্তার দেখিয়ে প্রয়োজনে টিকা নিন। drpranabped@gmail.com সূত্র : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *