Skip to content

শুধুই মিথ

তানভীর আহমেদ
কথায় কথায় অনেক কথা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বছরের পর বছর এসব কথা এতটাই আলোচিত হয় যে, সেটি সত্যি বলেই স্বীকৃতি পেয়ে যায়। যদি এগুলোর শেকড় খুঁজে দেখেন তখন জানা যাবে আসলে এই কথাগুলোর সবটা সত্য নয়। বেশির ভাগই ভুল ধারণাপ্রসূত, মিথ। এসব মিথ পৃথিবীতে যুগে যুগে ছিল, এখনো আছে। এই মিথের ভিত্তি এতটাই মজবুত যে, এগুলোর কোনোটি ভুল জানতে পারলেও খটকা লাগতে পারে। তাই বহুদিনের জানা কিছুকে শুধুই মিথ জানার পর বিস্মিত হতেই পারেন।

Myth

নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল

মধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনকে বিজ্ঞান জগতে অমরত্ব দিয়েছে। মানুষ যুগ যুগ ধরে এই আবিষ্কারের সুফল ভোগ করছে। নিত্য-নতুন আবিষ্কারেও নিউটনের সূত্রের ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু নিউটনের সঙ্গে মধ্যাকর্ষণ-বিষয়ক সূত্রই শুধু নয় আপেল ফলটিও জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা মিথ এটি। নিউটন একটি আপেল গাছের নিচে বসেছিলেন। তারপর হঠাৎ তার মাথায় একটি আপেল পড়ল। তিনি ভাবতে থাকলেন কেন আপেলটি উপরের দিকে না গিয়ে নিচের দিকে পড়ল। তিনি অবশেষে আবিষ্কার করলেন মধ্যাকর্ষণ সূত্র। কিন্তু এই গল্পটি লিখেছিলেন নিউটনের বন্ধু উইলিয়াম স্টাকলি। তিনি ১৭৫২ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটনের জীবনী নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এটিই হয়তো নিউটনের ওপর লেখা প্রথম জীবনী। তার এ লেখাটিই পরে মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। সবাই এই মিথটিকে সত্যি বলে ধরে নেন। সত্যিই একটি আপেল গাছ থেকে কারও মাথায় পড়েছিল বলে ধরে নিলেও সেই ব্যক্তিটি নিউটন ছিলেন এমনটি ভাবলে ভুল করবেন। নিউটনের এই আবিষ্কারের পেছনে আপেল নয় বরং রয়েছে দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানী গবেষণা। গবেষণার ফলে তিনি মধ্যাকর্ষণ নিয়ে চমৎকার একটি ধারণা পান। পৃথিবী, সূর্য, চাঁদসহ মহাকাশের গ্রহগুলোর আকর্ষণশক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে পান।

মানুষ মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে

এটা বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত একটি মিথ। প্রায়শই অনেকে বলে থাকেন, মানুষ তার ব্রেন বা মস্তিষ্কের মাত্র ১০ ভাগ ব্যবহার করতে পারে। না, অনেকে তো ভাবেন এই ১০ ভাগও ব্যবহার করতে পারলে মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পেঁৗছে যেতে পারবে। গড়পরতা ২ থেকে ৪ শতাংশ ব্রেন ব্যবহার করি আমরা। আসলে এই ধারণা পুরোটাই ভুল। মানুষ ১০ শতাংশের বেশি মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারে। মস্তিষ্ক সম্পর্কে সাধারণের জানার অভাবই আসলে এই মিথের জন্ম দিয়েছে। বর্তমান কেন, বহু প্রাচীনকালেও মানুষের এই বিশ্বাস ছিল। তবে এটা ঠিক, ব্রেনের বড় একটি অংশই মানুষের অব্যবহৃত থেকে যায়। মানুষের মস্তিষ্কের ওজনও খুব বেশি নয়। তবে মানুষের ব্রেন প্রাণিজগতের অন্যতম বিস্ময় জাগানো উপাদান। মানুষ আসলে ১০ শতাংশের বেশি মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে সক্ষম। গভীর মনোযোগের সঙ্গে চিন্তার সময় এমনকি বড় ধরনের বিটদের সময়ও মানুষ ১০ শতাংশের বেশি মস্তিষ্ক ব্যবহার করে থাকে। মস্তিষ্ক নিয়ে এই মিথ শক্তিশালী হয় ১৮০০ সালের দিকে। উইলিয়াম জেমস যে পদ্ধতিতে দেখিয়েছিলেন মানুষ মাত্র ১০ শতাংশ মস্তিষ্ক ব্যবহার করে তাতে নির্দিষ্ট একটি অবস্থা বিবেচনা করা হয়েছিল। মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার মস্তিষ্ককে আরও বেশি কাজে লাগায়। বিজ্ঞানী বা গবেষকরা ১০ শতাংশের বেশি মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে থাকে।

চাঁদের কলঙ্ক আছে

যার কোনো কিছুতেই কলঙ্ক নেই তাকেও দোষী বোঝাতে মানুষ প্রায়শ একটি মিথের আশ্রয় নিয়ে থাকে। কেউবা ছোট একটি ভুল করেছে তখনো মুখের ওপর বলে দেন- চাঁদেরও কলঙ্ক আছে! চাঁদ রাতের আকাশের রাজা। নিজের আলো না থাকলেও সূর্যের আলোতে চাঁদের রূপের বর্ণনাতেও কবি-সাহিত্যিকরা মানুষের মন ভরিয়েছেন। পূর্ণিমাতে রুপালি আলোতে ঝলমল চাঁদের কলঙ্ক তবে কী জিনিস? চাঁদের কলঙ্ক বলতে বোঝায়, চাঁদের আলোর বিপরীতে থাকা অন্ধকার অংশকে। সহজে বলতে, অনেকেই চাঁদের পেছনের অংশ যেটা কার্যত দৃশ্যমান নয় সেই অংশের কথাই বলে থাকেন। সবারই ধারণা, চাঁদের ওই অংশটি কালো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাঁদের কলঙ্কের মিথ আরও শক্তিশালী হয় মানুষ যখন অমাবস্যা দেখে। আসলে সূর্যের আলো চাঁদের পুরোটাতে পড়ে। যদিও মাত্র অর্ধেক অংশ পৃথিবী থেকে দেখা যায় তাতে মনে হতে পারে বাকি অংশে সূর্যের আলো নেই এবং সেটুকুই চাঁদের কলঙ্ক। তবে কখনো কখনো চাঁদের অর্ধেক অংশে সূর্যের আলো পড়ে থাকে। যখন চাঁদের সবটুকুই আলোর ব্যবহার তখন আমরা পূর্ণিমা উপভোগ করি। সত্যিই যদি চাঁদের অন্ধকার ভাগ বা কলঙ্ক থাকত তবে পূর্ণিমা দেখা যেত না। চাঁদে সূর্যের আলো পড়ার তারতম্যের কারণেই চাঁদের আলোরও তারতম্য হয়ে থাকে। তাই চাঁদের সত্যিই কলঙ্ক আছে ভেবে থাকলে হতাশ হতে হবে।

গোল্ডফিশের স্মৃতি মাত্র ৩ সেকেন্ড স্থায়ী

সাধারণ মানুষ তো বটেই বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী, লেখক, বিতার্কিকরাও প্রায়ই মানুষের ভুলোমন নিয়ে বলতে গিয়ে গোল্ডফিশের দুর্বল স্মৃতিশক্তির উদাহরণ টেনে দেন। গোল্ডফিশের স্মৃতি মাত্র তিন সেকেন্ড স্থায়ী। না, এটি মোটেও ঠিক নয়। স্রেফ একটি জনপ্রিয় মিথ। উল্টো গোল্ডফিশের স্মৃতির অবস্থা বেশ ভালো। গোল্ডফিশ ছাড়াও অনেক মাছ কমপক্ষে পাঁচ মাস স্মৃতি ধরে রাখতে পারে। এমনকি গোল্ডফিশকে রং, আলো, সুর এবং অনুভূতিসৃষ্টিকারী তরঙ্গের মাধমে শেখানোও যেতে পারে। তাই ৩ সেকেন্ডের স্মৃতি বলে গোল্ডফিশকে খ্যাপানোর আগে জেনে নিন ঠিক তথ্যটি।

চুল কাটলে দ্রুত বাড়ে

বাচ্চাদের চুল কাটায় বেশ অনীহা দেখে প্রায়শই শোনা যায়, মা-বাবা বলছেন, চুল যত বেশি কাটবে সেটি তত ঘন হবে, দ্রুত বড় হবে। মাথার চুল পাতলা হয়ে আসছে এমন কাউকে দেখলেও এ কথাটি বলতে শোনা যায়। আসলে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং প্রমাণ রয়েছে এটি একটি মিথ ছাড়া আর কিছু নয়। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ও স্যান ফ্রান্সিসকোর কয়েকজন অধ্যাপক দেখিয়েছেন, মানুষের চুল স্বাভাবিকভাবে প্রতি মাসেই এক ইঞ্চির চারভাগের একভাগ বড় হয়। এর সঙ্গে বেশি বেশি চুল কাটার কোনো সম্পর্কই নেই। আসলে চুল কাটলে ফেটে যাওয়া ও ভেঙে যাওয়া চুল সরিয়ে দেওয়া হয়। এতেই চল ঘন হয়েছে বলে মনে হলে কি আর করার।

একমাত্র চীনের মহাপ্রাচীর মহাশূন্য থেকে দেখা যায়

চীনের মহাপ্রাচীর বা গ্রেট ওয়াল অব চায়না পৃথিবীর সেরা স্থাপত্যশৈলীর একটি। চীনের মহাপ্রাচীর নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত মিথ- এটি মহাকাশ থেকে দেখা যাওয়া পৃথিবীর একমাত্র স্থাপত্য। অনেকে দাবি করেন, এটি চাঁদ থেকে দেখা যাওয়া পৃথিবীর একমাত্র স্থাপত্য। কিন্তু বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ জেনে হতাশ হতে হবে। এটি যদিও বিশাল তবু এটির রং ফিকে হয়ে যায়। মাত্র ১৮০ মাইল উপর থেকেই এটি দেখা যায় না। নাসার লুনার থেকে পাওয়া অনেক ছবিতেই চীনের মহাপ্রাচীরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। তাই এই মিথ বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে এ সময়ে এসে। এ ছাড়া কতটুকু উচ্চতা থেকে স্পেস বা মহাশূন্য শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও বিতর্কের বিষয়। কিন্তু তাই বলে চীনের মহাপ্রাচীরের গৌরব কমে আসছে না। এটি পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়। আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে রোমান শাসক হাড্ডিয়ান অসভ্য ভ্যান্ডাল এবং গথদের আক্রমণ-অত্যাচারের হাত থেকে রাজ্যের নিরাপত্তা ও প্রজাদের সুখ-শান্তি অব্যাহত রাখার জন্য আড়াআড়িভাবে কয়েকশ’ মাইল দীর্ঘ বেশ উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করেন। এটির দীর্ঘ ২৬৯৫ কিলোমিটার বা প্রায় ১৬৮৪ মাইল। উচ্চতা ৪.৫৭ থেকে ৯.২ মিটার।

রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল

সম্রাট নিরো ও তার বাঁশি। ১৮ জুলাই ৬৪ খ্রিস্টাব্দ। সেদিন রাত রোমের সওদাগরী এলাকা আগুনে জ্বলতে দেখা যায়। সে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। সম্রাট নিরো তখন উদ্বেগশূন্য। পৃথিবীর অন্যতম সেরা মিথের জন্ম তার এই উদাসীনতায়। বলা হয়, রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। আসলেই কি নিরো বাঁশি বা ভায়োলিন জাতীয় কিছু বাজাচ্ছিলেন? মোটেই তা নয়। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, এটি শুধু নিরোর উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতার প্রবাদ। নিজের রাজ্য নিয়ে তার দায়িত্বহীনতার সম্পূরক বাক্য এটি। নিরো ভায়োলিন বা বাঁশি জাতীয় কিছু বাজাননি। হগটন মিফলিন কোম্পানির এক প্রকাশনায় এ নিয়ে বিস্তারিত জানা যায়। এটিও বেরিয়ে এসেছে রোমে নিরোর রাজত্বকালের বহু পরে ভায়োলিনের আবিষ্কার হয়েছে। তাই রোমের আগুন লাগার সময় বাঁশি বাজানোর ব্যাপারটি আসছে না। তবে আরেকটি দলের মতে, নিরো সেতারা বা বীণা জাতীয় কোনো সংগীতযন্ত্র বাজাচ্ছিলেন তবে তিনি জানতেন না তার প্রাসাদ থেকে ৩০ মাইল দূরে তখন আগুন লেগেছিল। তাই রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন- কথাটি উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতারই প্রবাদবাক্য মাত্র। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *