Skip to content

সন্ধ্যার আলোয় পাতাল সুড়ঙ্গে

:: আবুল হোসেন আসাদ ::
পাহাড়ের পর পাহাড়ের ছড়াছড়ি আর তার ভাজে খাগড়াছড়ি। খাগড়াছড়ি শহর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে মাটিরাংগা উপজেলার আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র- এ রয়েছে এক রহস্যময় গুহা বা সুড়ঙ্গ। মাতাই হাকর বা দেবগুহা নামে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে যার পরিচিতি সেটি এক রহস্যময় পাহাড়ি সুড়ঙ্গ। আলুটিলা সুড়ঙ্গ। নাম টিলা হলেও আলুটিলা কিন্ত মোটেও টিলা নয়। বরং আলুটিলা খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। আলুটিলার আগের নাম ছিল আরবারী পর্বত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খাগড়াছড়িতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাদ্যের অভাব প্রচণ্ডভাবে দেখা দিলে এলাকার মানুষজন খাদ্যের সন্ধানে এই পর্বত থেকে বুনোআলু সংগ্রহ করে তা খেয়ে বেঁচে ছিল। সেই থেকে পর্বতটির নাম হয়ে যায় আলুটিলা।

এই পর্বতের সীমানা বেশ বড়। উত্তরে মাহজনপাড়া, দক্ষিণে তইকাথাং মৌজা, পুর্বে মালছড়া ও ঠাকুরছড়া গ্রাম এবং পশ্চিমে সাপমারা পর্বতশ্রেণি। আলুটিলার উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে তিন হাজার ফুট। মং সার্কেলের অধীনে এই আলুটিলা। রহস্যময় গুহা বা সুড়ঙ্গে যেতে হলে প্রথমেই দরকার হবে পর্যটন কেন্দ্রের নির্ধারিত মুল্যের টিকিট কাটা। টিকেটের মুল্য ১০ টাকা। এরপর নিতে হবে মশাল। মশালের মূল্য ১০ টাকা। ভিতরে প্রবেশের শুরুতেই দেখা যায় গেটের দুইপাশে শতবর্যী দুটি বিশাল বটগাছ ঠায় দাঁড়িয়ে। এ যেন দর্শনার্থীদের স্বাগত জানানোর প্রকৃতির পদ্ধতি। পর্যটন কেন্দ্রের মূল গেটের ভিতরে ডান ও বাম দুই দিকে, দুটি রাস্তা গেছে। বামদিকের রাস্তার শেষ প্রান্তে কাঙ্ক্ষিত আলু টিলা সুড়ঙ্গ। আর ডানদিকের রাস্তা দিয়ে কিছুটা সময় হাটলে চোখে পড়বে সরু একটি পাহাড়ি পথ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এই পথটি নিচের দিকে নেমে গেছে। এই পথ বেয়ে আরেকটু নিচে নামলেই রয়েছে এক অপূর্ব ঝরনা। ঝর্নার পানি নেমে যাচ্ছে ঝিরি বরাবর। অবশ্য এই জায়গাতে একটি বাঁধ দিয়েছে পাহাড়ি লোকজন। ঝরনার পানি আটকে রাখার জন্য। ঝরনার পানি তারা খাবার ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে।

পর্যটনকেন্দ্রের মুলগেট হতে বামদিকের ঢালু রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে আলুটিলা সুড়ঙ্গ বা গুহার। গুহাতে যাওয়ার আগেই আছে বিশ্রামের জন্য বসার স্থান এবং এক পলকে পুরো খাগড়াছড়ি দেখার জন্য পর্যবেক্ষণ টাওযার। বিশ্রামাস্থান এর সামনে দিয়ে সোজা এই রাস্তাটি চলে গেছে আলুটিলা গুহার দিকে। গুহায় যাওয়ার জন্য আগে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে হতো। এখন পর্যটন করপোরেশন পাকা রাস্তা করে দিয়েছে। ফলে সহজেই হেটে চলে যাওয়া যায় গুহার মুখে। পাকারাস্তা শেষ হলে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে হয়। পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রায় ২৬৬টি সিঁড়ির নিচে পাহাড়ের পাদদেশে পাথর আর শিলা মাটির ভাজে গড়া এই কাঙ্ক্ষিত আলুটিলা গুহা। গুহা মুখের ব্যাস প্রায় ১৮ ফুট আর দৈঘ্য প্রায় ২৮০ ফুট। গুহার ভেতরে কোনোভাবেই সুর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। তাই গুহাটি ঠান্ডা এবং যথেষ্ট অন্ধকারাচ্ছন্ন। হাতে বাশের চোঙায় মশাল জ্বালিয়ে দর্শনার্থীরা গুহায় প্রবেশ করে।

গুহায় প্রবেশ করলে মনে হয় কোনো এক স্বপ্নপুরীর দেশে যাচ্ছি। গা ছম ছম করে ওঠে। শরীরে শিহরণ জাগায়। পথ চলতে পায়ে ঠান্ডা হাওয়া লাগে। শব্দ করলে তা পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে।এটি একেবারেই পাথুরে গুহা। গুহার তলদেশ পিচ্ছিল এবং পাথুরে।তাই পিছলে যায় এমন জুতা বা স্যান্ডেল পরা যাবে না। এর তলদেশদিয়ে একটি ঝরনা প্রবাহমান। ভিতরে পানি জমে আছে জায়গায় জায়গায়। আছে বড় বড় পাথর। পাথরগুলো যথেস্ট পিচ্ছিল। তাই খুব সাবধানে পা ফেলে সামনে এগুতে হয়। পা ফসকে গেলেই আহত হতে হবে। তবে অন্যকোন ভয় নেই। গুহাটি অনেকটাই নিরাপদ। গুহার মুখে প্রবেশের আগে মশাল জ্বালিয়ে নিতে হয়। মশালগুলো সোজাকরে ধরতে হবে তা না হলে কেরোসিন তেল সব পড়ে যাবে এবং গুহার মাঝপথে গিয়ে মশাল নিভে যাবে। অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য টর্চলাইট কিংবা মোবাইল টর্চ নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য অনেকেই মাথায় হেডলাইট ওয়ালা ক্যাপ পরে নেয় গুহার ভেতর যাওয়ার সময়। গুহার ভিতরের পথ ধরে কিছুটা এগোলে দুদিকে দুটি রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে একটি রাস্তা বন্ধ। ইচ্ছে করলে এই বন্ধ রাস্তা দিয়েও ঘুরে আসা যায়। গুহার ভেতর সোজা যে রাস্তাটি সেটি ধরেই এাগাতে হয় গুহামুখের বের হওয়ার পথের দিকে। আলো-আঁধারির মাঝে এবড়োথেবড়ো পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। গুহার মাঝপথে উচ্চতা স্বাভাবিকের চাইতে কম হওয়ায় দর্শনার্থীদের মাথা নুইয়ে চলতে হয়।

গুহার ভেতর প্রবেশ করার পর যে কারোরই মনে ভয় লাগতে পারে। এই গুহার বুঝি শেষ নেই। এই অন্ধকার পাতালের বুঝি শেষ নেই। কিন্ত আরো কিছুদুর এগিয়ে যাওয়ার পর যখন আলোর রেখা দেখা যাবে তখন মনে হবে। আহা জীবনটা কতই না রোমাঞ্চের। কতই না আনন্দের! আতঙ্ক, আনন্দ. রোমাঞ্চ এর মিশ্র অনুভূতির এক অপূর্ব আনন্দচ্ছটা পেতে প্রবেশ করতে হবে আলুটিলার এই পাতাল সুড়ঙ্গে।

উপমহাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ এটি। এ রকম প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ পথের নজির পৃথিবীতে খুব বেশি নেই বললেই চলে।পাহাড়ি সুড়ঙ্গ পথ বেয়ে গা ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে অন্ধকার পাতালে নেমে যাওয়া স্বপ্নের মতো মনে হলেও আলুটিলার সুড়ঙ্গপথ- স্বপ্ন যেন সত্যি হলো এর মতো করে ধরা দেয় বাস্তবে। অনুভবে।

আলুটিলা গুহায় যেতে চাইলে প্রথমে ঢাকা কিংবা দেশের যেকোনো স্থান থেকে যেতে হবে খাগড়াছড়ি শহরে। খাগড়াছড়ি যাওয়ার জন্য এসি ও ননএসি অনেক বাস রয়েছে। শামলী হানিফ শান্তিসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস নিয়মিত খাগড়াছড়ি যাতায়াত করে। শ্যামলী পরিবহন ছাড়ে রাত ১০টা ও ১১টায় ফকিরাপুল থেকে। খাগড়াছড়ি পৌঁছে সকাল ৭টায়, ভাড়া ৫২০ টাকা। হানিফ এসি বাস ছাড়ে রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে, খাগড়াছড়ি পৌঁছে সকাল ৬টায়, ভাড়া ১০০০ টাকা। সেন্টমার্টিন পরিবহন ছাড়ে রাত ১১টায়, পৌছে সকাল ৯টায়। ভাড়া এক হাজার ৫০০ টাকা। শান্তি পরিবহনের বাস ছাড়ে সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকার গাবতলী থেকে। খাগড়াছড়ি পৌঁছায় দুপুর আড়াইটায়, ভাড়া ৫২০ টাকা। এ ছাড়া সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে কিছু সময় পর পরই রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত শান্তি পরিবহনের গাড়ি রয়েছে। শান্তি পরিবহনের এসি বাসের সিট ভাড়া এক হাজার টাকা এবং ছাড়ে রাত সাড়ে ৯টার সময় গাবতলী থেকে। তারপর বাস, ট্যাক্সি, চান্দের গাড়ি কিংবা লোকাল বাসে চড়ে যেতে হবে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে। এরপর সেখান থেকে হেঁটে ঘুরে আসতে হবে গুহা। তবে সন্ধ্যার আগেই বেড়ানো শেষ করে শহরে ফিরে আসাই ভালো। পাহাড়ি আকাবাঁকা রাস্তায় দুর্ঘটনার ভয়ে সন্ধ্যার পর তেমন একটা যানবাহন পাওয়া যায় না এখানে।

একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষনীয় তাহলো যথেচ্ছা মশালের ধোয়ায় পুরো সুড়ঙ্গ পথটিই কালচে হয়ে গেছে এবং যেখানে সেখানে মশালের বাশের টুকরায় আবর্জনার স্তূপ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সুড়ঙ্গের পানিতে কেরোসিন তেলে একাকার। তবে বর্তমানকালের শক্তিশালি টর্চলাইটগুলোর আলোয় সুড়ঙ্গপথ পাড়ি দেওয়া যায় অনায়াসেই। সৌজন্যে: এনটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *