Skip to content

সভ্যতার কলঙ্ক

Hirosima8

তানভীর আহমেদ

মুহূর্তেই হিরোশিমায় সব ছাই হয়ে যায়

হিরোশিমা জাপানের একটি শহর। এটি হিরোশিমা জেলার প্রশাসনিক রাজধানী এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় হুনশু দ্বীপপুঞ্জের ছুগোকু অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর। এ ছাড়া হিরোশিমা জাপানের সবচেয়ে বৃহৎ দ্বীপ। জাপানের বর্তমান রাজধানী টোকিও থেকে ৫০০ মাইল দূরত্বের শহর এটি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পরমাণু বোমার বিধ্বংসী পরীক্ষা চালানো হয় এ শহরটির ওপর।

তবে লক্ষ্য শুধু পরীক্ষাই ছিল না, পাশাপাশি গণনাতীত সংখ্যক মানুষকে হত্যার জন্যও বোমাটি ফেলা হয়েছিল।

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দেওয়া নামে নামাঙ্কিত পরমাণু বোমা ‘লিটল বয়’ হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয় হিরোশিমার ওপর। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমাবাসীর ওপর নেমে আসে এক মহাদুর্যোগ। এ দিনেই পৃথিবীতে প্রথম পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হয়েছিল। জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা পথে নিরপরাধ লাখো মানুষের জীবনাবসান ঘটতে যাচ্ছে- এ খবর কেউ জানত না। প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষেপ ইতিহাস সৃষ্টি করল।

লিটল বয়ের দৈর্ঘ্য ছিল তিন মিটার। বোমাটির মাথায় ছিল সাড়ে ১২ কিলোটন টিএনটি এবং এর ওজন ছিল ৩ হাজার ৬০০ কিলোগ্রাম। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ তিনিয়ান থেকে ইউএস বি২৯ (এনোলা গে) বিমানটি ব্যবহার করা হয়েছিল বোমা ফেলার জন্য। বিমানটির পাইলট হিরোশিমার ঘুমন্ত মানুষগুলোর মাথার ওপর দিয়ে প্যারাসুটে বেঁধে একটি বোমা নামিয়ে দিয়েছিল।

লিটল বয় মাটিতে পড়ার আগেই ভূমি থেকে ৫৮০ মিটার উঁচুতেই এটি বিস্ফোরিত হয়। ঠিক যখন বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তখন চতুর্পাশের তাপমাত্রা মুহূর্তের মধ্যে হয়েছিল ৭ মিলিয়ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি। বোমা বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে ওই তাপমাত্রা ছড়িয়ে যায়, আর ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকা যাবতীয় সবকিছু মুহূর্তে গলে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্মমতার কথা জাপানিরা কোনো দিন ভুলতে পারবে না। যেখানে লিটল বয় বিস্ফোরিত হয়েছিল সেটি সমতল জায়গা। নানা ধরনের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক দালান ছিল অগণিত। চতুর্পাশের প্রায় পাঁচ বর্গমাইল এলাকা চোখের পলকে ছাই হয়ে যায়। হিরোশিমায় বোমা হামলার প্রাথমিক ধাক্কাতেই কেবল ৭৬ হাজার দালান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরমাণু বোমার প্রত্যক্ষ আঘাতে প্রাথমিকভাবেই প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। যদিও বেসরকারি তথ্য মোতাবেক মৃতের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৮ হাজার ৬৬১। ১৯৪৬ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত প্রত্যক্ষ মৃত্যুর হিসাব রাখা হয়েছিল। এরপর হিরোশিমায় বোমার পরোক্ষ কারণে আরও লক্ষাধিক মানুষকে মরতে হয়েছে, যার সঠিক হিসাব দেওয়া কঠিন।

Hirosima2হিরোশিমা ট্র্যাজেডির ৭০ বছর পালিত হলো এ বছর। প্রতি বছরের মতো এবারও জাপানিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মর্মান্তিক ওই দিনটিকে স্মরণ করছে। দিনটি উপলক্ষে হিরোশিমার মেমোরিয়াল পার্কে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন দেশটির হাজারো বাসিন্দা। মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হয়ে রয়েছে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার ব্যবহার। মানুষ মারার এই অকল্পনীয় হাতিয়ার নিষিদ্ধকরণে সোচ্চার সচেতন মানুষরা। পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে থাকবে হিরোশিমা।

‘ফ্যাটম্যান’ নিশ্চিহ্ন করে দেয় নাগাসাকিকে

নাগাসাকি জাপানের একটি শহর। ১৬ শতকে পর্তুগিজ নাবিকরা জাপানি মৎস্যজীবী অধ্যুষিত এই দ্বীপে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন ঘটায়। ১৫৪৩ সালে নাগাসাকি দ্বীপটিতে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে পর্তুগিজদের পা পড়ে। ১৮৫৯ সালে নাগাসাকিকে উন্মুক্ত বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বন্দরনগরী নাগাসাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে পরিণত হয়। কারণ, এ দ্বীপটিতে জাপানের রাজকীয় নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ নির্মাণ কারখানা ছিল।

১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট বেলা ১১:০২ মিনিটে মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি বিমান থেকে ফ্যাটম্যান নামের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। যার ফলে শহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ধারণা করা হয়, এতে ৭০ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়। নাগাসাকি কর্তৃপক্ষের হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল ৭৩ হাজার ৮৮৪ জন। যার মধ্যে ২০০০ হাজার জন কোরিয়ান শ্রমিক ছিল।

মাত্র তিন দিন আগে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের যে কলঙ্ক লেপন হয়েছিল মানব সভ্যতায়, তার সঙ্গে আরেকটি কলঙ্ক যোগ হয় এতে। ফ্যাটম্যানের কাছে অসহায় মানুষ আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু পারমাণবিক বোমা কাউকে ক্ষমা করেনি। আকাশ থেকে ছুড়ে দেওয়ার পর মাটির কাছাকাছি আসতেই এটি বিস্ফোরিত হয়। আকাশ ফুঁড়ে ধোঁয়া ওঠে। মেঘ পেরিয়ে যাওয়া সেই বিস্ফোরণের দৃশ্য যে কাউকে আতঙ্কে নির্বাক করে দেবে।

অনুমান করা হয়, ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যায়। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার লোক মারা যায় এবং পরবর্তীতে এ দুই শহরে বোমার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরও ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। জাপানের আসাহি শিমবুন পত্রিকার করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২ লাখ ৩৭ হাজার এবং নাগাসাকিতে ১ লাখ ৩৫ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।

নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণের পর জাপান বাধ্য হয় যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে নিতে। জাপানের আত্মসমর্পণের পেছনে এই বোমাবর্ষণের ভূমিকা এবং এর প্রতিক্রিয়া ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে অধিকাংশের ধারণা এই বোমাবর্ষণের ফলে যুদ্ধ অনেক মাস আগেই সমাপ্ত হয়, যার ফলে পূর্ব-পরিকল্পিত জাপান আক্রমণ ‘ইনভেশন’ সংঘটিত হলে উভয় পক্ষের যে বিপুল প্রাণহানি হতো, তা আর বাস্তবে ঘটেনি। অন্যদিকে জাপানের সাধারণ জনগণ মনে করে এই বোমাবর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। বিশেষ করে জাপানের বেসামরিক নেতৃত্ব যুদ্ধ থামানোর জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণের সুদূরপ্রসারী ফল দেখতে পায় পুরো বিশ্ব।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায়। নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার স্মরণে নির্মিত হয়েছে নাগাসাকি পিস পার্ক। পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরতা কমানোর অঙ্গীকার নিয়ে নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার বার্ষিকী প্রতি বছর পালন করে জাপানিরা। পিস পার্ক স্থানটির কাছেই ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমা হামলা হয়েছিল। সেই মহাদুর্যোগের সাক্ষী এটি।

আমেরিকা কেন এই হামলা করেছিল?

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট পৃথিবী দেখল নির্মমতার চূড়ান্ত দৃশ্যটি। বিশ্বে প্রথমবারের মতো মানুষের ওপর ফেলা হয় পারমাণবিক বোমা। পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা ছিল কল্পনাতীত। জাপানের হিরোশিমা শহরে সকাল সাড়ে ৮টায় যখন বোমারু বিমান থেকে ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমাটি ফেলা হয় তখন চোখের পলকে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা শহর। ঘরবাড়ি, পথঘাট নিমিষে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর তিনদিন পর দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা ‘ফ্যাটম্যান’ পড়ে জাপানের আরেক শহর নাগাসাকির ওপর। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। দুটি বোমার আঘাতে সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। জাপান বাধ্য হয় আত্মসমর্পণ করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। পারমাণবিক বোমা হামলার বিপক্ষে সারা পৃথিবীর মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠলে এখনো এ নিয়ে তর্ক রয়েছে আমেরিকা কেন পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করল।

Hirosima3

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হয়ে রয়েছে। সেখানে কলঙ্কের তিলকটি যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া এ দুটি পারমাণবিক বোমা। কৌতূহলের বিষয়, আমেরিকা কেন এই হামলা করেছিল। এ নিয়ে বিশ্লেষকদের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।

প্রথমেই বলা হয়, যে কোনো মূল্যে যুদ্ধ জয়। দ্বিতীয়ত, বিশ্বযুদ্ধের পরিসর ও বিস্তৃতি এতটাই বিশাল ছিল যে, সেখানে যুদ্ধের পরিধি সারা বিশ্বই। প্রতিটি রাষ্ট্রই এ যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। এই যুদ্ধ থামানোর বিকল্প কোনো উপায়ও ছিল না। কোনোভাবেই একপক্ষকে পরাজিত করা সম্ভব নয় বলেই এমন একটি নির্মম পথ বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। অল্প সময়ে নিজেদের বড় কোনো ক্ষতি ছাড়াই বিশ্বযুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয়ের বিকল্প কোনো উপায় না পেয়ে পারমাণবিক বোমা হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমেরিকা।

পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেওয়া। পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের সুদূরপ্রসারী প্রভাব কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। যে কারণে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোকে আলাদা মর্যাদায় দেখা হয়ে থাকে। সেনাবাহিনীর শক্তি ছাড়াও এমন একটি অস্ত্র আমেরিকা বেছে নেয় যা শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রতিপক্ষকে ভয়ে কাবু করে রাখবে।

আরেকটি কারণ হিসেবে বলা হয়, আমেরিকা চেয়েছিল এমন বড় আকারের আঘাত করতে, যাতে প্রতিপক্ষ শুধু নিশ্চিহ্নই হবে না আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পথ খুঁজে পেতেই এই অমানবিক ও কলঙ্কজনক পথ বেছে নিয়েছিল আমেরিকা।

লিটল বয় আর ফ্যাটম্যানের ধ্বংসলীলা

Hirosima5১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে চমৎকার ঝকঝকে শহরটি পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। লিটল বয় শীর্ষক বোমাটির ওজন ছিল ৬০ কেজি। নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছতে এটি সময় নেয় ৫৭ সেকেন্ড। এই সময়ে এটি অতিক্রম করে ৬০০ মিটার দূরত্ব। এ বিস্ফোরণটি ঘটে ১৩ কিলোটন (tnt)-এর সমান এবং সে সময় তাপমাত্রা হয়েছিল ৩৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বিস্ফোরণের পর এক মাইল ব্যাসার্ধের এলাকাজুড়ে ধ্বংসলীলা শুরু হয় এবং হিরোশিমার প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনার পর ওই দিন বেলা ১১টায় হিরোশিমা শহরে দেখা গেল অসংখ্য মানুষের লাশ আর আহতদের চিৎকার?

বোমা নিক্ষেপকারী পাইলট টিবেটস বিমান থেকে শহরের ভয়াবহ ধ্বংসের দৃশ্য দেখে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, হায় ঈশ্বর এ কি করলাম!

হিরোশিমার ভয়াবহতার কারণ বুঝে ওঠার আগেই এর ঠিক তিনদিন পর জাপানেরই নাগাসাকি শহরে দ্বিতীয় বোমা ‘ফ্যাট ম্যান’-এর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই কলঙ্কজনক ঘটনার নেপথ্যে ছিল অস্ত্রের উন্নয়নে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রত্যাশায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্লজ্জ অমানবিক প্রতিযোগিতা। আণবিক অস্ত্রের জন্ম হয়েছিল এই ভীতি থেকে যে, হিটলারের জার্মানি একচেটিয়া অধিকারী হয়ে গোটা বিশ্বে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়, জার্মানিতে এ ধরনের বোমা তৈরিতে শুধু একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া ছাড়া কোনো কার্যকর উদ্যোগ আদতেই নেওয়া হয়নি।

হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী ড. লিও জিলার্ড সর্বপ্রথম বোমা তৈরির উদ্যোগ নেন। এ বোমার মানবতাবিরোধী ভয়ঙ্কর ভয়াবহতার কথা বিবেচনা না করেই বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সমর্থন জোগান জিলার্ডকে। এরা দুজন যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে এ বোমার কার্যকারিতা উল্লেখ করে জানান, তখনো বিষয়টি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে গুরুত্ব পায়নি বিশেষভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অস্ত্রকেই বেছে নিলেন তারা। আর মানবতা হার মানলো সেই পৈশাচিক বর্বরতার কাছে।

১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে আনুমানিক প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যায়। নাগাসাকিতে এই সংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়ে দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরও ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। জাপানের আসাহি শিমবুন-এর করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট নানান রোগে হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২ লাখ ৩৭ হাজার এবং নাগাসাকিতে এক লাখ ৩৫ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীর অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক লোকজন। নাগাসাকি আক্রমণের ৬ দিন পর ১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় জাপান।

একনজরে দুই পারমাণবিক বোমা

Hirosima4
অ্যাটমিক বম্ব ডোম

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের এই বোমা ফেলে এবং এর তিনদিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
ধারণা করা হয়, ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। ভিন্ন সময় হিরোশিমা আর নাগাসাকির সেই ভয়াল বিস্ফোরণের পর গোলাকার স্তম্ভের একটা বিল্ডিং ঠিক রইল। তখন অনেকেই অবাক হয়েছিল। গোলাকার স্তম্ভের বিল্ডিংটার নাম অ্যাটমিক বম্ব ডোম।

অ্যাটমিক বম্ব ডোম আসলে একটা নামকরা প্রেক্ষাগৃহ ছিল। যার চূড়াতে ক্ষেপণ করা হয়েছিল বিশ্ব মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, সোমবারের সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে। মাইলের পর মাইল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলেও এই প্রেক্ষাগৃহের কাঠামোটি কোনোরকমে টিকে থাকে। কারণ, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে, মূল কেন্দ্রটিকে তুলনামূলকভাবে অক্ষত রেখে। একেবারে কেন্দ্রে থাকার কারণই বেঁচে যায় প্রেক্ষাগৃহটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান

Hirosima6১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত একনাগাড়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা আর চুক্তি সম্পাদনার মাধ্যমে জার্মানি ইতালির সঙ্গে একটি মিত্রজোট গঠন করে এবং ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল নিজের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়। ১৯৪১ সালের জুনে ইউরোপীয় অক্ষশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে যার ফলশ্রুতিতে সমর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ রণাঙ্গনের অবতারণা ঘটে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান অক্ষশক্তিতে যোগ দেয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো আক্রমণ করে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করতে সক্ষম হয়। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির সঙ্গে যোগ দেয়। মূলত জার্মানি এবং জাপান দুই অক্ষশক্তিই যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করার মাধ্যমে একে যুদ্ধে ডেকে আনে।

হিবাকুসা!

হিবাকুসা। খাঁটি জাপানি শব্দ। অর্থাৎ বিস্ফোরণ আক্রান্ত মানুষজন। যন্ত্রণা আর চোখের জলই যাদের একমাত্র অবলম্বন। মার্কিন বর্বরতার নৃশংসতম ক্ষতচিহ্ন বহন করছেন এই ‘হিবাকুসারা’।

Hirosima7

হিরোশিমা-নাগাসাকির বীভৎসতার সময় থেকে পরবর্তী বংশ পরম্পরায়। কারা এই ‘হিবাকুসা?’ সংজ্ঞা নির্ধারিত ‘দ্য অ্যাটমিক বোম্ব সারভাইভারস রিলিফ’ আইনে। যারা বোমা বিস্ফোরণস্থলের সামান্য কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ছিলেন। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের দুই সপ্তাহের মধ্যে যারা বিস্ফোরণস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ছিলেন। যারা বিস্ফোরণ নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত। এ তিন অবস্থার মধ্যে থাকা গর্ভবতী মহিলারা। জাপানে এরাই আইনমতে হিবাকুসা। মার্চ, ২০০৫ এরা সংখ্যায় ছিলেন ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৮। এদের বড় অংশই জাপানের। কয়েক হাজার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কোরিয়া ও তার আশপাশে। তথ্য জাপান সরকারের।

হিবাকুসারা পেয়ে থাকেন সরকারি সহায়তা। অনুদান হিসেবে কিছু অর্থ দেওয়া হয় প্রতি মাসে। প্রতি বছর বিস্ফোরণের বার্ষিকীতে স্মরণ করা হয় নিহতদের। প্রতি বছর বিগত বছরে নিহত ‘হিবাকুসা’দের নাম লিখে দেওয়া হয় হিরোশিমা নাগাসাকির বুকে। মার্কিন বোমার তেজস্ক্রিয়তায় ঝলসে যাওয়া নিহতদের স্মৃতিফলকে। দীর্ঘ হয়ে ওঠা এ তালিকা হিবাকুসাদের মতোই বহন করে চলেছে মার্কিনি ‘সভ্যতা’র কুৎসিত ক্ষতচিহ্ন। উল্লেখ্য, আগস্ট ২০০৫-এ হিরোশিমায় নিহত ‘হিবাকুসা’দের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৩৭ এবং নাগাসাকিতে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৯।

‘হিবাকুসা’দের জবানবন্দিতে এভাবেই উঠে এসেছে হিরোশিমা মার্কিনি নারকীয় পরমাণু বিস্ফোরণের সে দিনের কথা। ‘হিবাকুসা’দের এই নিদারুণ জীবন যন্ত্রণা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ-ধিক্কার ঘৃণায় পরিণত হয়ে চিরদিন দংশন করে চলবে মার্কিন বিবেককে। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *