সাঈদ আল হাসান শিমুল
সৃষ্টির আদি হতেই মানুষ সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়েছে। ভেলা, ডিঙি হতে শুরু করে এখন মানুষ পর্বতসমান জাহাজ ভাসাচ্ছে উত্তাল সমুদ্রে। মধ্যযুগ হতে ঊনিশ শতক পর্যন্ত দস্যুবৃত্তিতে সমুদ্রযাত্রার নেশায় বুদ ছিল একদল মানুষ। বিশেষ করে ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় সবক’টি দেশ সমুদ্রে জাহাজ ভাসাতে সিদ্ধহস্ত ছিল। আর সে কারণেই এখনও সমুদ্রগর্ভে লুকিয়ে আছে হাজারও জাহাজ। সেসব জাহাজের সঙ্গে ডুবে আছে সে সময়ের ইতিহাস, সভ্যতা। ঠিক সেজন্যই ডুবে যাওয়া জাহাজ নিয়ে মানুষের আজন্ম কৌতূহল। সভ্যতার ইতিহাস খুঁজতে ডুবুরিদের চলছে নিয়মিত অদম্য প্রচেষ্টা। তবে এমন তিনটি জাহাজ আবিষ্কৃত হয়েছে যা সমুদ্রগর্ভে নয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন সমাধিস্থলের মাটি খুঁড়ে। এ জাহাজগুলো উদ্ধারের পর ঐতিহাসিকরা নতুন এক অধ্যায় রচনা করেছেন। সভ্যতার জানা ছিল না, জাহাজ শুধু যাত্রী, পণ্য সরবরাহ আর দস্যুবৃত্তিতে ব্যবহৃত হয়নি। কিছু জাহাজ কফিন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। জাহাজই হয়ে উঠেছে কফিন। অষ্টম শতকের শেষ থেকে শুরু করে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জলদস্যুরা ইউরোপ ও এশিয়ায় রাজত্ব করেছিল। মূলত স্পেন, ফ্রান্স, ওলন্ডাসরা ভারতবর্ষের অমূল্য সব সম্পদ লুণ্ঠনে জীবন বাজি রেখে প্রশান্ত মহাসাগরে জাহাজ ভাসাত। কফিন জাহাজগুলো ঠিক সে সময়েরই তিনটি জাহাজ।
টুনে জাহাজ
এটি ১৮৬৭ সালে খুঁজে পান প্রত্নতত্ত্ববিদ অলুফ রিগ্হ। এতে সমাহিত করা একজন পুরুষের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয় ৯০০ সালের দিকে এই জাহাজ কফিনটি ‘সমাধি টিলা’য় সমাহিত করা হয়েছিল। কঙ্কাল ও সমাধির প্রকৃতি হতে বোঝা যায় সমাধিস্থ ব্যক্তিটি সে সময়ের সম্রাট বা উঁচু পদবীর কেউ ছিলেন। টুনে নামক অঞ্চলে পাওয়া গেছে বলে জাহাজটির নাম টুনে জাহাজ। নরওয়ের টুনে অঞ্চলের রল্ভসয় দ্বীপের একটি কবরস্থানের মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে পাওয়া যায় জাহাজটি। এটি শক্ত ওক কাঠ দিয়ে তৈরি। ধারণা করা হয় অক্ষত অবস্থায় জাহাজটি দৈর্ঘে ৭২ ফুট ও প্রস্থে ১৪.৩ ফুট এবং ৪৬ ফুট তল বিশিষ্ট ছিল। প্রথম দিকে এ জাহাজটি পণ্য আমদানি রফতানিতেই ব্যবহৃত হত। পরে তা সমাধিতে পরিণত হয়।
গোকস্টাট জাহাজ
১৮৮০ সালে নরওয়ের ভেসফোল্ড-এর স্যান্ডার এলাকার একটি কবর টিলার মাটি খুঁড়ে টুনে জাহাজের মতো আরেকটি জাহাজ পাওয়া যায়। কবর টিলাটির নামই গোকস্টাট। এতে বিছানায় শুয়ে থাকা ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সী একজন পুরুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। কঙ্কালটি ৬ ফুট লম্বা। জাহাজটি দৈর্ঘে ৭৮.১ ফুট ও প্রস্থে ১৬.৭ ফুট। প্রায় ৩২ জন এ জাহাজের দাঁড় বাইতো। এতে ১২০০ বর্গফুট আয়তনের পাল লাগানো হত। প্রথমে একে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত করলেও এ জাহাজটি পরে শুধু কফিন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেকের মতে, জাহাজের মালিককেই তার নিজ জাহাজে সমাধিস্থ করা হয়।
ওসেবার্গ জাহাজ
এ জাহাজটি ১৯০৪-০৫ সালে উদ্ধার করা হয়। নরওয়ের প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ হ্যাকন শেটেলিগ ও সুইডেনের গ্যাব্রিয়াল গুস্তাফসন এটি খুঁজে পান। এটিও আবিষ্কৃত হয় নরওয়ের টন্সবার্গের ওসেবার্গ সমাধি ক্ষেত্র হতে। এ জাহাজটি ৭০ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা ও ১৬ ফুট ৮ ইঞ্চি চওড়া। এতে ৯৬৮ বর্গফুট আয়তনের পাল তোলা হতো। ওক কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি। ৩০ জন দাঁড় টেনে একে সমুদ্রে ভাসাত। ৮৫০ সালের দিকে এ জাহাজে দুজন নারীকে দাফন করা হয়। যতদূর জানা যায় এর মধ্যে একজন ছিলেন রানি, অন্যজন তার সেবিকা। তাদের ‘মৃত্যু-পরবর্তী জীবন’-এ সুখ নিশ্চিত করতে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয়েছিল খাবার থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, অলংকার ও নিত্য-ব্যবহার্য জিনিসপত্র। দুই মৃত নারীর জন্য চিরুনিও দিয়ে দেয়া হয়েছিল। খনন কাজের সময় এ জাহাজের সঙ্গে চারটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি পাওয়া যায়। একটি ঘোড়ার কঙ্কালও গাড়িটির সঙ্গে পাওয়া যায়। আরও পাওয়া গেছে বসার টুল ও জুতা। এ তিনটি জাহাজই বর্তমানে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সঙ্গে আরও সংরক্ষণ করা হয়েছে সে সব মৃত ব্যক্তিদের ও তাদেরকে দেয়া উপঢৌকনগুলো। জাদুঘরটির নামই রাখা হয়েছে ‘ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম’। সৌজন্যে : যুগান্তর