মাসুম সায়ীদ
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সবাই যখন ঢেউয়ের মতো উত্তাল আনন্দে দুলে দুলে উঠছিল ঠিক তখনই দাঁড়িয়ে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল সৈকতের রেখাটি উত্তরে কতদূর গেছে? আর উত্তর-পশ্চিমের ওই গভীর সমুদ্রের দ্বীপগুলোতেইবা থাকে কারা? দু-একদিনের জন্য কক্সবাজার ঘুরতে এসে এ রহস্যের কিনারা করা যায় না, আমিও পারিনি। তবে এবার এল সেই সুযোগই।
৭১ টিভির ওয়াইল্ড লাইফ রিপোর্টার হোসেন সোহেলের ‘জঙ্গলবাড়ি’ নামে ফেসবুকে একটা গ্রুপ আছে। জঙ্গলবাড়ি নেচার ক্যাম্পিংয়ের জন্য যাচ্ছে সোনাদিয়া দ্বীপে। এখন সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম দেবে সেখানে। ফাহিমের এমন আমি আর ফরিদী নুমান ভাই ভিড়ে গেলাম সেই দলে। নেতৃত্বে সোহেল ভাই। সঙ্গে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার, দেশের পরিচিত মুখ কুদরত-ই-খুদা কাজল ভাই। সব মিলে দশজনের দল।
রাত ১০টায় কারওয়ানবাজার থেকে আমাদের হাইএস মাইক্রোবাস ছাড়ল। হাতিরঝিল পার হয়ে ইস্কাটনে সোহেল ভাইয়ের বাসার কাছে এসে গাড়ি থামল তাঁবুগুলো নিতে। এখানেই শাম্মী ভাবি গাড়িতে উঠলেন- দলের একমাত্র নারী সদস্য। গাড়ি ছুটে চলল রাজধানী ছেড়ে কক্সবাজার অভিমুখে। বলাই বাহুল্য, বাসের মতো আরাম করে গা ঢেলে হাত-পা ছড়িয়ে বসা গেল না। তবুও গল্পগুজবেই কেটে গেল রাতের বেশিরভাগ সময়।
কক্সবাজার বিমানবন্দর ঘাটের জেটিতে যখন পা রাখলাম তখন বেলা ১১টা ছাড়িয়ে। রাতের খাবার খেয়েছি সেহেরির মতো রাতের শেষের ভাগে। সুতরাং সকালের নাশতা দুপুরে গিয়ে গড়াবে এ আর অসম্ভব কী! হলও তাই। সোনাদিয়া থেকে ট্রলার নিয়ে গিয়াস ভাই আর তার লোকজন সকাল থেকে বসে আছে। দেরি না করে আমরা ট্রলারে উঠলাম। এদিকে এর আগে আসিনি তাই যা দেখছি সবই নতুন। ঘাটে ছোট-বড়-মাঝারি অনেক ট্রলার নোঙর করে আছে। পাশাপাশি গায়ে গা মিলিয়ে। যেন এক খাটে শুয়ে আছে পিঠেপিঠি ভাইবোন। কোনটা সমুদ্র থেকে ফিরছে কোনটা আবার যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাঝে মাঝে শান্ত জল তোলপাড় করে ছুটে যাচ্ছে স্পিড বোট। এত কোলাহল হইচইয়ের মধ্যে জলকবুতরেরা ভেসে আছে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে। জানা গেল মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে মেলা বসেছে। সিদ্ধান্ত হলো মহেশখালী যাওয়ার। রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হবে। মানে মহেশখালী দেখার পাশাপাশি সকাল-দুপুরের খাবারেরও ব্যবস্থা হয়ে যায়।
প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর মহেশখালী কংক্রিটের জেটিতে আমাদের ট্রলার ভিড়ল। মেলা ভাঙার পথে। গতকালই ছিল শেষ দিন। বলে-কয়ে এক দুটো দিনের জন্য দোকানিরা রয়ে গেছে। ভাত বা রুটি পাওয়া গেল না। তবে গরম-গরম গুড়ের জিলাপি, লুচি সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা- ক্ষুধার জ্বালায় খাওয়া মন্দ হলো না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নুমান ভাইও কমে ছাড়লেন না।
পেটের আগুন নিভে যেতেই টের পাওয়া গেল রোদের যন্ত্রণা। সবাই ট্রলারে উঠলাম। খুলে দেয়া হলো ট্রলারের বাঁধন। বাঁকখালীর সঙ্গমস্থলকে পেছনে রেখে চললাম পশ্চিমে। উত্তরে মহেশখালী, দক্ষিণে বিশাল এক ডুবোচর। ট্রলার যাচ্ছে মাঝখানের চ্যানেল ধরে। দিনের সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমের পথে। নোনাজল ছুঁয়ে আসা দূরের শীতল বাতাসের আদুরে স্পর্শ ডেকে আনছিল তন্দ্রাকে। ব্যাক প্যাকের স্তুপে হেলান দিয়ে কেউ-কেউ সত্যি-সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল নিজেদের অজান্তে।
দূরে চ্যানেলের ওপর ব্রিজ দেখে আমরা হতবাক। গিয়াস ভাই বুঝিয়ে বললেন- সোনাদিয়া দ্বীপ পূর্ব ও পশ্চিম দুভাগে বিভক্ত। মাঝে একটা অগভীর চ্যানেল। জোয়ারের সময়ই কেবল পানি ঢোকে। ব্রিজটা পূর্ব সোনাদিয়াকে মহেশখালী থানা সদরের সঙ্গে স্থলপথে সংযুক্ত করেছে। ব্রিজের কাজ শেষ হলেও রাস্তাটি সম্পন্ন হয়নি বলে এ পথে পা দুটোই ভরসা।
পায়ে হাঁটা পথে পূর্বপাড়া সংযুক্ত থাকলেও পশ্চিমপাড়া পুরো বিচ্ছিন্ন। সে কারণে পশ্চাৎপদও। গাঁয়ে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। নেই কোনো ওষুধের দোকান। উন্নয়ন, সরকারি দান-অনুদান পূর্বপাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পূর্বপাড়া থেকেই নির্বাচিত হয় বারবার।
দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম ব্রিজের কাছে। এক সময় ছাড়িয়েও গেলাম। চ্যানেলের দুপাশে ম্যানগ্রোভ বন। বাইন আর করচ গাছই বেশি। মাইলের পর মাইল। এ যেন আরেক সুন্দরবন!
পাকিস্তান আমলে প্রথম বনায়ন শুরু হয় এখানে। সে ধারা এখনো অব্যাহত থাকলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের গাছগুলো প্রাকৃতিক। বনের বিস্তারও হচ্ছে বেশ দ্রুত। চারপাশের দৃশ্যগুলো এতই মনোরম যে ভুলেই গিয়েছিলাম গন্তব্যের কথা। সাগর ছেড়ে চ্যানেল। চ্যানেল ছেড়ে খাল বা নদী তারপর আবার চ্যানেল। এভাবেই এক সময় সোনাদিয়া ঘাটে এসে ভিড়ল আমাদের ট্রলার।
খাড়িতে তখন ভরজোয়ারের দাপাদাপি। কোনো জেটি বা বাঁধানো ঘাট না থাকলেও আমরা মাটির বাঁধানো উঁচু আলে নির্বিঘ্নেই নামতে পারলাম। বাঁধ পেরোলেই মাঠ। মাঠের সঙ্গে একটা টিনশেড দালান। ভাবলাম স্কুলঘর। আমাদের ধারণা ভুল। এটা বন বিভাগের একটা অস্থায়ী অফিস।
পাশেই আর একটা স্থাপনার গ্রেটবিম সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণাধীন স্থাপনাটি বন বিভাগের স্থায়ী অফিস। পশ্চিম সোনাদিয়ার এক মাত্র সরকারি স্থাপনা। পাশে খড়ের একটা ঘর। দোচালার একটাতে কোনো রকম খড়চাপানো হলেও অন্য অংশ পুরো ফাঁকা। এটাই স্কুলঘর। মুসলিম এইডের উদ্যোগে এখানে এক সময় ক্লাস ফোর পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও দু বছর থেকে তা বন্ধ। এখন এখানে মক্তব চলে। গ্রামের মসজিদের ইমাম আরবি শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা অক্ষর চেনানোর কাজটা কোনো রকম চালিয়ে নেন। স্কুলে কোনো চেয়ার-বেঞ্চ নেই। খুদে শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে বস্তা বা ছালা নিয়ে আসে যার-যার বসার জন্য।
আমরা যখন নামলাম ততক্ষণে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। বিকালের রোদ মাথায় করে গ্রামের ভেতর দিয়ে পশ্চিমের বেলাভূমি পার হয়ে সৈকতে এলাম। ‘মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্স’ এখানে কচ্ছপের ডিম সংরক্ষণের জন্য খানিকট জায়গা জাল দিয়ে ঘিরে রেখেছে। ঘেরের ভেতর টহলদারের জন্য একটা ছোট্ট ছাউনি ও একটি টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। পাশেই সাগরলতা আর ঝাউবন আচ্ছাদিত বালিয়াড়ি। পাশাপাশি দুটো বালিয়াড়ির মাঝে একটা চাতাল। এখানে বাতাসের ঝাপটা লাগে না। তাই এখানেই আমরা তাঁবু ফেললাম। দশজনের দশটা তাঁবু! হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যাবে।
ব্যাক প্যাকগুলো তাঁবুতে রেখে ক্যামেরা হাতে পানির কিনারে এসে দাঁড়ালাম। একটা ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল পা। দেখলাম ভেজা বালির সৈকত পড়ে আছে একা উত্তর-দক্ষিণে দিগন্ত ছাড়িয়ে। সমুদ্রের শীতল জল আর বহু দূর থেকে ছুটে আসা বতাসের স্পর্শে পথের ক্লান্তি কোথায় হারিয়ে গেল!
সৈকতে প্রথম সন্ধ্যাটি এল হঠাৎ করেই। আকাশে কোনো মেঘ ছিল না। বিদায়ী সূর্যটার বিদায়ক্ষণটিকে আরো প্রলম্বিত করে দেয়ার জন্য। সৈকত ধরে অন্ধকারে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। আশপাশে শুকনো খড়কুটোর অভাব ছিল না।
তাঁবুগুলোর একপাশে জ্বালানো হলো আগুন। সন্ধ্যে হতে না হতেই শীত পড়তে শুরু করেছে। ঢাকার সঙ্গে তাল রেখে গরম কাপড় সঙ্গে আনেনি কেউই। তাই আগুন ঘিরে বসে পড়ল যে যতটা পারে কাছে। কাল থেকে একটানা চলছে কৌতুক। এবার ক্যাম্প ফায়ারের উত্তাপ আর আটপৌরে জীবন থেকে বেরিয়ে আসার উচ্ছ্বাসে শাম্মী ভাবী গলা খুললেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত। যন্ত্রের কোনো সঙ্গতি নেই, খালি গলায়। কিন্তু কী তার গায়কী গলা! গান নয় যেন মধু ঢালছেন বাতাসে। কবিগুরুর রচনা নয় এ যেন অবরুদ্ধ আবেগ। ছাড়া পেয়ে চঞ্চল করে তুলেছে পৃথিবীর এক প্রান্তের বাতাস আর মৃদু আগুন ঘিরে বসে থাকা কয়েক পথিকের হৃদয়। একটি দুটি করে কখন যেন তারারা নিঃসীম অন্ধকার আকাশের বুকটাকে খইক্ষেত করে তুলেছে।
তারপর ঝাউয়ের শাখার পেছনে একসময় চাঁদ উঠল। ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক দিয়ে রুপালি জোছনা চুয়ে-চুয়ে পড়ছে। আর ঝাউগাছগুলো যেন বৃষ্টিতে ভেজা কিশোরী। চুল ছড়িয়ে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে চাইছে বছরের প্রথম বৃষ্টিকে। হায় জীবননান্দ- ‘আমি যদি হতাম বন হংস!’। চাঁদের হাসি বালিয়াড়িতে স্থির হয়ে থাকলেও নীল সমুদ্রের উত্তাল জলে পানসি নায়ের মতো দুলতে থাকল।
রাত হয়েছে ঢের সোনদিয়ায়! আমরা ঢুকে গেলাম তাঁবুতে। ঝাউবনে পাতার বাঁশি আর সৈকতে সমুদ্রের গর্জন শাম্মী ভাবির গানের মতোই কানে বাজতে থাকল। নরম বালির বিছানায় বালিয়াড়িকে পাশবালিশ বানিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
কীভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে কক্সবাজার। কক্সবাজারের মহেশখালী ঘাট থেকে স্পিডবোটে মহেশখালী। তারপর মহেশখালী থেকে ট্রলারে সোনাদিয়া। থাকার জন্য তাঁবু নিতে হবে। নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট ও ড্রাই প্যাক রাখা ভালো। ১০ জনের একটি দলের তিন দিনে জনপ্রতি ৬০০০-৬৫০০ টাকা খরচ হবে। সৌজন্যে : দেশের খবর