Skip to content

সাগরতলে হাঁটাহাঁটি

:: সিদ্ধার্থ মজুমদার ::

অক্সিজেন ভরা হেলমেট পরে সমুদ্রের তলদেশে হাঁটাহাঁটি রোমাঞ্চকর ব্যাপার বটে। উপসাগরের শক্তিশালী লোনা বাতাসের ধাক্কা সামলাতে আমরা ব্যতিব্যস্ত। বাতাস আর লবণাক্ত পানির ছাটে চোখ জ্বলে ওঠে। থাইল্যান্ড উপসাগর উত্তাল হয়ে আছে। গাঢ় নীল সাগর এখানে খানিকটা কালচে। দ্রুতগামী ফেরি পাতায়া বন্দর থেকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে কোরাল আইল্যান্ডে।

একসময় বাতাস পড়ে যায়। চোখের সামনে দ্বীপটা একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই কোরাল আইল্যান্ডের আশপাশে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা দ্বীপ। এই দ্বীপপুঞ্জে একটাই বন্দর। গোটা দ্বীপটাই পাহাড় আর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনে ঢাকা।

ফেরিঘাট থেকে হেঁটে দ্বীপের ভেতরে ঢুকে পড়ি। আমরা চার ভাইবোন ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকি দ্বীপে। স্থানীয়রা রোমাঞ্চকর সব প্যাকেজের ফিরিস্তি দেয়। আমার বোন পারিজাত যে প্যাকেজ দেখে সেটাই তার পছন্দ হয়ে যায়। কোন প্যাকেজে, সাগরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে প্যারাসুটে বেঁধে ছেড়ে দেবে। শক্তিশালী স্পিডবোট যখন প্যারাসুটের দড়ি নিয়ে ছুটে যাবে খোলা সমুদ্রে, তখন এক টানে প্যারাস্যুটের সঙ্গে আকাশে উড়ে যাওয়া যাবে। আকাশে ভেসে দেখা যাবে সমুদ্র আর দ্বীপ। ব্যানানা বোট নামে একধরনের নৌকা আছে। দেখতে কলার মতো বলেই এমন নাম। ব্যানানা বোটে চড়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার একটা রাইড আছে। আছে দ্রুতগামী ওয়াটার ট্যাক্সি। পানি ছিটিয়ে ছুটে যাওয়া যায় ইচ্ছেমতো।

অদ্ভুত আরেকটা ব্যাপার আছে এখানে, স্থানীয়রা বলে ‘সি ওয়াক’। এই প্যাকেজে মাথায় অক্সিজেন ভরা হেলমেট পরে সমুদ্রের তলদেশে নেমে যাওয়া যায়। সমুদ্রের তলায় গিয়ে কোরাল রিফের পাশে হেঁটে বেড়ানোর একধরনের বিচিত্র ব্যবস্থা আছে! সমুদ্রের তলায় চলে যাওয়া খানিকটা বিপজ্জনক বিধায় এই প্যাকেজটা আমরা বাদ দিয়ে রাখি। ফেরিতে আসা লোকগুলো দ্বীপে পা দিয়েই হুড়মুড় করে এদিক–সেদিক ছুটে যায়। লোক একটু কমে গেলে প্যাকেজের দাম পড়ে যায় হু হু করে। এবার দরদাম করে আমরা একটা প্যাকেজ নিয়ে নিই এবং একসময় অবাক হয়ে আবিষ্কার করি টাকা খরচ করে আমরা তুলনামূলক বিপজ্জনক প্যাকেজ ‘সি ওয়াক’ অর্থাৎ সমুদ্রতলে হাঁটতে যাচ্ছি!

আমার কাকা মনজ মজুমদার, থাইল্যান্ডে তিনিই প্রধান অভিভাবক। পইপই করে বলে দিয়েছেন, ‘একদমই সমুদ্রে নামবে না। যদি একান্তই নামতে ইচ্ছে করে তবে সর্বোচ্চ হাঁটুপানি পর্যন্ত।’ কোথায় হাঁটু কোথায় মাথা, আমরা তো নেমে যাচ্ছি সমুদ্রের নিচে। কথা না শোনায় আমাদের খানিকটা অপরাধবোধ হতে থাকে কিন্তু ততক্ষণে আমাদের নিয়ে আরেকটা স্পিডবোট ব্যানানা বিচ থেকে সমুদ্রের মধ্যে যেতে থাকে। উত্তেজনা একসময় শঙ্কায় রূপ নেয়। বোট থেকে এবার আমাদের ছোট একটা জাহাজে তুলে নেয়। আমাদের প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু হয়ে যায় দ্রুত। বিচিত্র ইংরেজিতে কাঠখোট্টা প্রশিক্ষক আমাদের যা বললেন, তার সারমর্ম মোটামুটি এমন: ‘সমুদ্রের নিচে কোনো পরিস্থিতিতেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না। নিচে নেমে যাওয়ার পর সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে হাত দিয়ে ওকে সাইন দেখাতে হবে। অসুস্থ বোধ করলে ওপরে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে নির্দিষ্ট একটা সাইন দেখাতে হবে।’

সমুদ্রের নিচে পানির প্রবল চাপে কান বন্ধ হয়ে যায়, কান যাতে বন্ধ না হয়, তার কৌশলও শেখালেন তিনি। এবার জাহাজের পেছনে সমুদ্রের দিকে ঝোলানো সিঁড়ির কাছে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। সিঁড়ি দিয়ে গলা পর্যন্ত পানিতে নেমে যাই, ওপরে বসে থাকা ট্রেনার মাথায় একটা হেলমেট বসিয়ে দেন। এবার নিচ থেকে আরেকজন স্কুবা ডাইভার হাত ধরে পানির নিচে নামিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। আমরা নিচে নামতেই থাকি, নামতেই থাকি। একসময় মনে হয় দম বন্ধ হয়ে সম্ভবত মারা যাচ্ছি। নিজেকে সান্ত্বনা দিই, উত্তেজিত হওয়া যাবে না, কিছুতেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না। আস্তে আস্তে শ্বাস নিতে শুরু করি। হেলমেটের ওপরে সূক্ষ্ম নল থেকে তাজা অক্সিজেনের একটা প্রবাহ চালু হয়। আতঙ্ক এবার বিস্ময়ে পাল্টাতে থাকে। কয়েক হাত দূর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ সাঁতরে যায়। একে একে আমরা চার ভাইবোন পানির নিচে চলে আসি। চার ভাইবোন এবার হাত ধরাধরি করে ডাইভারের দেখানো পথে হাঁটি। দুজন স্কুবা ডাইভার আমাদের সঙ্গে কৃত্রিম ফ্লিপার লাগিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে মাছের মতো সাঁতরাতে থাকে। কোরাল দেখে দেখে আমরা হেঁটে আগাই। কী বিচিত্র তার রং। কী অদ্ভুত তার গঠন। কোরালে হাত দেওয়া নিষেধ। কোনো কোনো কোরাল বিষাক্ত হয়। আবার কোরালের ধারালো প্রান্তে হাত কেটে গেলে আরও বিপদ। বহুদূর থেকেই সামুদ্রিক প্রাণীগুলো রক্তের গন্ধ পায়। কোরাল রিফ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। এই কোরাল রিফের পাশে ভেসে বেড়ায় রঙিন সব মাছের ঝাঁক।

ডাইভাররা আমাদের হাতে পাউরুটি ধরিয়ে দেয়। আমরা একটু একটু করে পাউরুটি ছড়াতে থাকি। শত-সহস্র মাছ আমাদের ঘিরে ধরে। স্কুবা ডাইভাররা একসময় দূরে সরে যায়। আমরা মাছের সঙ্গে খেলি। হঠাৎ একসময় মনে হয় ঘন কালো একটা ছায়া খুব ধীরে আমাদের দিকে আসছে। বুক ধক করে। একটু পরেই চোখের সামনে থেকে বড় একটা কচ্ছপ আমাদের ঘা ঘেঁষে চলে যায়। সময় গড়ায়। রাতের টানও বাড়ে। পানির নিচের অচিন্তনীয় চাপে শরীর একসময় বিদ্রোহ শুরু করে। ‘থাম্বস আপ’ দেখালে সঙ্গের স্কুবা ডাইভার পথ দেখাতে শুরু করে। মাছের রাজ্য থেকে ফিরে চলি চিরচেনা ডাঙায়। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *