পিনাকি দাসগুপ্ত ও আব্দুর রহমান
সাগর পথে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া পৌঁছানো যায়– এ পথ দেখিয়েছিল মিয়ানমারের নাগরিক আইয়ুব আলী মাঝি। শুরু করেছিল
সেই ২০০০ সালের শেষ দিকে। সে সময় পাচারের রুট ছিল বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড। শুরুতে খুব কম সংখ্যক লোকই এ
রুটে মালয়েশিয়া পৌঁছেছে। এদের অনেকেই ‘সফলতার’ মুখ দেখেছে। আর তাদের দেখে ও তাদের সফলতাকে উপস্থাপন করে
আইযুব আলী মাঝি চক্র মানব পাচার ‘বড় আকারে’ শুরু করে।
প্রথমদিকে মানব পাচার চক্রের প্রলোভনে পড়ে যারা মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে তাদের মধ্যে ছিল চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা
রোহিঙ্গা ও কক্সবাজারসহ আশপাশ এলাকার বাসিন্দা। তবে রুট পরিবর্তন ২০০৩ সালে (বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া)। মানব
পাচারের পরিধি যত বাড়তে থাকে ততই বড় হতে থাকে দালাল চক্রের আকার। তবে দালাল চক্রের সিংহভাগই নৌ ডাকাত ও নৌ
মাঝি– এ তথ্য জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আতাউর রহমান খোন্দকার। এ দিকে থাইল্যান্ডের
জঙ্গলে গণকবরের খবর জানাজানি হবার পর থেকে গোটা কক্সবাজার এলাকায় মানব পাচার দালাল গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান শুরু
করে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে কক্সবাজার এলাকায় বিশেষ
অভিযান চলছে। পাশাপাশি মানব পাচারের সঙ্গে কারো কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে
আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে মানব পাচার রোধ করা সম্ভব না। এ
জন্য প্রয়োজন জনসচেনতা বৃদ্ধি। পুলিশের পাশাপাশি জনসচেনতা বৃদ্ধি করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া
হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আইয়ুব আলী মাঝি ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে
আসে। প্রথম দিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করলেও পরবর্তীতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। রোহিঙ্গা ও
বাংলাদেশি বিশেষ করে নৌ ডাকাত ও নৌ মাঝিদের নিয়ে গড়ে তোলে তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। ২০০০ থেকে শুরু করে ২০০৬
সাল পর্যন্ত সমুদ্র পথে মানব পাচারের মূল নেতৃত্বে ছিল আইযুব আলী মাঝি। পরবর্তীতে বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে
আসলে আইযুব আলী মাঝি লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, পরিচয় গোপন করে বর্তমানে চট্টগ্রামের কোন
এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছে সে। আর তার দেখানো পথ ধরেই মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ে কয়েকশ’ দালাল।
২০১৪ সালে পুলিশ সদর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্র উপকুল দিয়ে মানব পাচারের
সঙ্গে জড়িত রয়েছে ২৪১ দালাল। এই দালালদের মাধ্যমে ২০১৪ সালে দেশের ৩৮টি জেলার ৫৫টি স্থানের ২০ হাজার মানুষ
থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া পাচার হয়েছে। আর টেকনাফ কেন্দ্রিক ৩০ জনের একটি হুন্ডি চক্র মানব পাচারের টাকা লেনদেন করে
থাকে।
জলদস্যু থেকে মানব পাচার চালাল : গত শুক্রবার ভোরে টেকনাফের মহেশখালী পাড়া সৈকতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত
হয় মানব পাচারকারী চক্রের তিন দালাল। টেকনাফে মানব পাচারকারী ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত হবার প্রথম ঘটনা এটি। তবে ১১ মাসে
টেকনাফে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একাধিক ‘বন্দুক যুদ্ধের’ ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। এরা সবাই স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত।
নিহত মানব পাচারকারী ধুলু হোসেনের ব্যাপারে টেকনাফ মডেল থানার ওসি জানান, শাহপরীরদ্বীপ বাজার পাড়ার এলাকার মৃত
সোলতান আহমদের ছেলে ধুলু। ২৫ বছর নৌকার মাঝি ( ট্রলার শ্রমিক) ছিল। ২০১১ সালের দিকে জড়িয়ে পড়ে মানব পাচারের
সঙ্গে। গড়ে তোলে জলদস্য বাহিনী। গত বছর ২৮ ডিসেম্বর পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় ধুলু। এক বছর জেলখাটার পর গত মাসে
জামিনে মুক্তি পায়। আবার শুরু করে মানব পাচার। নিহত অপর দুই মানব পাচারকারী জাহাঙ্গীর আলম ও জাফর আলম এক সময়
ছিল জল দস্যু। ওসি জানান, নিহত তিনজনের বিরুদ্ধেই মানব পাচারের একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের অপর সহযোগীদের
গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মানব পাচারকারী চক্রের দালালরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আর্শীবাদপুষ্ট হওয়ায় পুলিশ তাদের গ্রেফতারে
আগ্রহ দেখায়নি।
অভিযান শুরু : থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবরের খবর জানাজানির পর থেকে প্রশাসনের টনক নড়েছে। গত ৫ মে থেকে
কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকায় শুরু হয়েছে মানব দালাল চক্র গ্রেফতার অভিযান। পাশাপাশি শুক্রবার পুলিশের গুলিতে তিন
মানব পাচারকারী নিহত হবার ঘটনায় দালালদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফের একজন
বাসিন্দা জানান, পুলিশের এ অভিযান আগে শুরু করলে মানব পাচার অনেকটা কমানো সম্ভব হতো। সূত্র : ইত্তেফাক