মাসুম সায়ীদ
রুইলুই পাড়া, সাজেক
১২.০৬.২০১৫, রাত
নদী
রাতে তো ঢাকা ছাড়লাম। খাগড়াছড়িতে কখন পৌঁছলাম জান? ভোর বেলায়। এটা পর্যটন শহর। তাই ভোর থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানবার জন্য।
মনে দোটানা ভাব ছিল বলেই বোধহয় মনটানাতেই ঢুকলাম। তেলে ভাজা কড়কড়ে পরটা কড়া চায়ে রাতের ক্লান্তি দূর হলো কিছুটা। দলনেতা ফেইস বাংলাদেশের শাহিন ভাই তাড়া দিলেন-‘ত্বরা করে গাড়িতে ওঠেন! জিপ রেডি ছিল। ব্যাকপ্যাকগুলোর স্থিতি করে আমরা রইলাম ঝারা হাতে; শহরটা পেরোলেই ছাদে উঠব বলে।
দোটানার কারণটা বলি, ক্যামেরাটা খারাপ। এর মধ্যে শাহিন ভাইয়ের ডাক সাজেক যাওয়ার। ব্রাজক দলের কর্ণধার নুমান ভাই সাথে ব্রাজক মাসুদ ভাই এক পায়ে খাড়া হয়ে গেলেন। অগত্যা আমিও মধুসূদন!
আমাদের গন্তব্য সাজেক। সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। এটা রাঙামাটির বাঘাই ছড়িতে পড়লেও খাগড়াছড়ির সাথেই এর যোগাযোগ সহজ ও কাছে। রাস্তাটাও মনোরম আর মসৃণ। এখানে এলে রাস্তার প্রেমে পড়ে যেতে হবে। পুলিশ ক্যাম্পে রিপোর্ট কারার জন্য গাড়ি থামল। এই ফাঁকে নুমান ভাই, হিমেল মাসুদ আর আমি উঠে গেলাম চান্দের গাড়ির চান্দিতে। জিপ আবার নড়ে উঠল। দূরত্ব বেশি নয়- ৬৬ কিলোমিটার। স্বল্প দূরত্বের এই পথে এত শোভা এত শিহরণ! না, বলে বোঝানো যাবে না পুরোটা।
বাঘাইছড়ি বাজারের মুখে একটা চায়ের দোকানে জিপ থামিয়ে চা বিরতি দিলেন ড্রাইভার জুম্মন। ছাদের ধাতব আসন আর রোলার কোস্টারের দুলনি- যদিও ঢের দুলনি বাকি ছিল সামনে- শরীরের কলকবজাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এককাপ চায়ে শরীরটা চাঙ্গা হয়ে গেল।
আবারও আসন নিলাম। সেই ধাতব বিছানাতেই। বাজার ছাড়ল গাড়ি। কৌত‚হলী মানুষের চোখের স্পর্শ যে কী -তা তো তুমি জানই নদী? বাজারের পর পথে পড়ল একটা ব্রিজ। বর্ষার পাহাড়ি নদীতে ঘোলা জলের ঘূর্ণি। হাতের বাঁ দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম- নদীতে ওয়াই জংশন। রুমা আর থানচির পথে ওয়াই জংশন আছে সড়কে, আর এখানে নদীতে। পরে জানলাম জায়গাটার নাম গঙ্গারাম মুখ। নদীর নাম কী জান? ভারী সুন্দর নাম!- কাচালাং। কি সুন্দর না? পাহাড়ি ভাষার শব্দ। বাংলায় এর কী অর্থ হয় কে জানে? নিশ্চয়ই সুন্দর কোনো অর্থই হবে। বাংলাদেশের কোনো নদীর নামই তো খারাপ না। পদ্মা-মেঘনা যমুনার কথা বাদই দিলাম। মধুমতি, আত্রাই, পুনর্ভবা শাঙ্গু, কর্ণফুলী- আর কতশত নাম! আমার তো শুধু নদীর নামগুলোর জন্যই এ দেশটাকে আরও বেশি করে ভালবাসতে ইচ্ছে করে। দেশটা আর তুমি মিলেমিশে যাও এক রেখায়; নদীর সীমানায় এসে।
বাঘাইহাট পেরিয়ে মাচালাং বাজার। এখান থেকে সাজেক আঠারো কিলোমিটার। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে এখানে। এই পথটুকুর কথা কী আর বলব! তাকিয়ে দেখছিলাম চোখ বড় বড় করে। শুধু পাহাড় আর পাহাড়! যতদূর চোখ যায়। আর রাস্তা! না, এবড়ো-খেবড়ো নয় পিচঢালা কালো মসৃণ পথ। আঁকাবাঁকা। সাপের মতো। ইউ টার্ন, এস টার্ন, এলবো- কী নাই এখানে? এই মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার মতো ঢালু তো পরক্ষণেই পিঠ উলটে চিতপটাং হওয়ার মতো খাড়া। আমাদের জিপটা আহা, বেচারা!
দুুপুর বেলায় আমরা উঠে পড়লাম সাজেক পর্বতের চূড়ায়। আসলে সাজেক নামে সে অর্থে কোনো পাড়া বা গ্রাম নেই এখানে। এ পাড়াটার নাম রুইলুই পাড়া। লাল থং নামের একজন লুসাই এখানকার হেডম্যান। এর পুত্রবধূ মারুতি এ পাড়ারই মেয়ে- সে একটা দোকান চালায়। অভ্যাগতরা বললে চাহিদামতো খাবারও রেঁধে দেয়। আমাদের হেডম্যান- মানে শাহিন ভাই আমাদের গড়িতে বসিয়ে গেলেন খাবারের বন্দোবস্ত করতে। পাড়াটা ছোট্ট। তবে বেশ পরিপাটি। এ পাড়ায় লুসাই, পাংখোয়া আর ত্রিপুরাদের বসবাস। লুসাইরা খ্রিস্টান। ত্রিপুরারা হিন্দু। বেশিক্ষণ লাগল না ফিরে আসতে শাহিন ভাইয়ের। পাড়ার শুরুতেই ত্রিপুরাদের বসতি। এখানে একটা শিবমন্দির আছে। যুগল বট-পাকুড় গাছের তলায়। এ যুগলের আবার বিয়ে হয়েছে। গোড়ার বেদিটা সাদা টাইলসে মোড়া। রুইলুই পাড়া পেছনে রেখে আমরা চলে গেলাম সাজেকের জিরো পয়েন্টে।
দুপুরের খাবার খেতে খেতে প্রায় বিকাল। মারুতি দিদির রান্না বেশ মজার। জুমের চালের আঠাল ভাত। তারচেয়ে বড় কথা পেট বোঝাই ক্ষুধা। খাওয়াটা লিমিট ছাড়িয়ে গেল সবারই। শরীর জুড়াবার জন্য এসে বসলাম বটতলার বাঁধানো বেদিতে। শুধু বসা নয়, গড়াগড়ি। মাসুদ ভাই আর রেজুয়ান ভাই আবার উঠে পড়লেন গাছে। শাখামৃগদের উত্তরসূরি কিনা!- রসিকতা করলেন নুমান ভাই।
নদী, জায়গাটা অদ্ভুত! মনভুলিয়ে দেবার মতো। ওমর খৈয়ামের সেই রুবাইয়াতটা মনে পড়ছিল বারবার-
‘এই খানে এই তরুতলে
তুমি আমি কুতূহলে
আর কটা দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে
সঙ্গে রবে সুরার পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আর একখানি কাব্য হাতে নিয়ে। ’
নদী, সত্যি সত্যি আমি যদি কবি হতাম তাহলে কবিতার বন্যা বয়ে যেত বোধহয় এখানে। এক দিকে তো পাড়ার বাকি অংশ। অন্য তিন দিকে উপত্যকার গভীর খাদ। তারপর সার সার পাহাড় শ্রেণী। বহুদূর থেকে ছুটে আসা নির্মল বাতাসে জুড়িয়ে গেল মন। দুচোখে নেমে এল তন্দ্রা। আলস্য আরও বাড়ল দলনেতা যখন ঘোষণা করলেন, ‘আজ আমরা ফিরে যাব না। রাতটা কাটিয়ে দেব এ পাড়াতেই।’
বিকেল গড়িয়ে গেল এখানেই। হেডম্যান কীটনাশক ছিটানোর মেশিন পিঠে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। তিনি হাসলেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। তারপর ঢাল বেয়ে নেমে গেলেন নিচে। কিছুক্ষণ পর আমরাও অনুসরণ করলাম তাকে। কয়েকশ ফুট নেমে ফিরতি পথ ধরলাম আবার। জিরোপয়েন্টে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখব বলে।
বেশ কয়েকটা দল এসেছে সাজেকে রাত কাটানোর জন্য। আমরা নিরিবিলি একটা জায়গায় গিয়ে বসলাম ঘাসের ওপর। সূর্য হারিয়ে গেল ত্রিপুরার কোনো এক পাহাড়ের আড়ালে। কিন্তু মস্ত শূন্য আকাশতলার এই পহাড়চূড়া সহজেই অন্ধকারের আঁচলে বন্দি হতে চায় না। সবাই তাকিয়ে আছে ত্রিপুরার পাহাড়শ্রেণীর দিকে। কী মনে করে আমি তাকাই পেছনে লুসাই পাহাড়ের দিকে। সে কী দৃশ্য! বড় একটা মেঘ চলতে চলতে হঠাৎ যেন ঘুমিয়ে পড়েছে পাহাড় চূড়ায়। নীলাভ পাহাড়ের গাঁয়ে সাদা মেঘ! হঠাৎ মনে হলো মেঘের ভেতর থেকে সাদা আঁচল উড়িয়ে বেরিয়ে এলে তুমি। তারপর খালি পায়ে দৌড়ে নেমে এলে ঢাল বেয়ে। চমকে উঠলাম আমি! স্পষ্ট পায়ের নূপুরের শব্দটাও যেন শুনলাম! ক্যাম্পের মসজিদে আজান শুরু হলো তখন। আমরা মসজিদের পথ ধরলাম।
সাজেকের পরিপাটি বাংলোর একটি হলো রুনময়, যার অর্থ সুন্দর ঘর। স্টিলফ্রেমের আধুনিক স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন সন্দেহ নেই; তবে রংটা গোলাপি লাল। চোখে পড়ে। পাহাড়ের গায়ে ধক্ধকে ক্ষত চিহ্নের মতো। এটার পাশেই ক্যান্টিন। টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে। ঝুলবারান্দায় কয়েকটা টেবিল পাতা। আলো-আঁধারিতে বসে আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চা খেতে-খেতে খুব করে অনুভব করছিলাম তোমাকে। কটেজে ফিরলাম বেশ রাত করে। সাড়ে দশটাতেই ঘুমবুড়ি এলিয়ে দিল খোঁপা।
রাজু বোডিং, খাগড়াছড়ি
১৩.০৬.২০১৫, বিকাল
নদী
ফজর পড়েই বেড়িয়ে পড়েছি পাখির সন্ধানে। পাহাড়ি এ পল্লীবাসীও জেগে ওঠে ভোরে ভোরে। মেয়েরা কলসি নিয়ে যায় ঝিরিতে। পুরুষরা পিঠে ঝুড়ি আর হাতে দা নিয়ে জুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। বাঁশের চুঙ্গায় তামাক খায় দাওয়ায় বসে।
নদী, আমরা হাঁটছি জঙ্গল পরিষ্কার করা ন্যাড়া এক পাহাড়ের পাশ দিয়ে। পাহড়টা খোড়াখুড়িতে ক্ষতবিক্ষত। জুমের জন্য। পোকামাকড় খেতে পাখি আসার কথা কিন্তু কোথাও একটি পাখির টিকিটি নেই। নুমান ভাই ধরে ফেললেন ব্যাপারটা। ওস্তাদ মানুষ তো! বললেন, ‘চলেন, পাখি আজ আসবে না, কাল বিষ ছিটানো হয়েছে এদিকে’ । চারদিকে অসংখ্য জুমঘর। সকালের হালকা আলোতে চকচক করছে চালা। এক জাতীয় কেমিক্যাল পাহাড়িদের হাতে এসে গেছে, যা পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করলে ঝোপঝাড় লতাগুল্ম মরে যায়। কষ্ট করে কেটে পরিষ্কার করতে হয় না। পাহাড়ের শোভা এই লতাগুল্ম না থাকলে পাহাড় থাকবে কী করে? নদী, তুমিই বলো?
দিগন্তে এক ঝলক আলো দেখা দিয়েই হারিয়ে গেল কোথায়! ঘুমন্ত মেঘেরা জেগে উঠেছে দলে-দলে। দুএকটা আড়মোড়া দিয়ে খানিকটা হালকা হলো যেন। আমরা মাথার ওপর মেঘ নিয়ে নামতে শুরু করলাম। মানে ফিরতি যাত্রা শুরু হলো আমাদের। আমি গতকালের মতো আজও ছাদে। নদী-পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামাটাই বেশি রোমাঞ্চকর। গতকাল দৃষ্টি ছিল চারদিকে ছড়ানো। আজ পথের দুধারে। আজ ভুল করিনি। পকেটে চকলেট নিয়ে উঠেছি। হাত নেড়ে বিদায় দেয়ার জন্য যে শিশুটাই বেরিয়ে আসছিল ঘর থেকে আমি চকলেট ছুড়ে দিচ্ছিলাম। একটা সামান্য ক্যান্ডি পেয়ে কী যে খুশি হচ্ছিল!
পাহাড়ের এখন ভর-যৌবন। যেদিকেই তাকাই ফুল আর ফুল- নয়নতারা, ঝুমকো লতা, লজ্জাবতী- এখানে ওখানে কৃষ্ণচূড়াও আছে। আছে বনজারুল। আরো নাম না জানা কত ঘাস ফুল!
পাখিও প্রচুর। এই তো কাচালাং নদীর ব্রিজের মুখে একটা নীলকান্ত রাস্তা পার হলো। অসংখ্য বুলবুল, শালিখ, নীলকান্ত মনি চোখে পড়ল রাস্তায়। কেশরাজ ফিঙেও দেখলাম। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে স্ত‚প করে রাখা হয়েছে কাঁঠাল, আম আর আনারস। কাচালাং, মাচালাং পাহাড় আর ছড়া পেরিয়ে আমরা সকাল দশটার আগেই চলে এলাম খাগড়াছড়ি। মনটানাতেই ঢুকলাম আবার। শাহিন ভাই বিদায় নেবেন। তার শুরু হবে দোসরা সফর বান্দরবানের পথে। এখন দলনেতা নুমান ভাই। নতুন দলপতির পক্ষ থেকে এল নাস্তা প্লাসের ঘোষণা। দুপুরে কখন ফিরব কে জানে তাই। এবার যাত্রা অন্যপথে। সে গল্প আর এক দিন শোনাব তোমাকে, কী বলো, নদী?
ইতি,
আবার কে? -আমি।