Skip to content

সাত পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ সেই গ্রাম

:: সৈয়দ আশিক রহমান ::

জার্মান রেডিও ডয়চে ভেলের আমন্ত্রণে বন-এ গিয়েছিলাম তিনদিনব্যাপী দশম ‘গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম’ কনফারেন্সে অংশ নিতে। এই কনফারেন্সে ১৩০টি দেশের ৬৫০ জন সাংবাদিক এবং ৭৫০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২,০০০ প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন গণমাধ্যম, একাডেমিয়া, রাজনীতি, এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সদস্য। খুবই প্রাণবন্ত ছিল এ কনফারেন্স। গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের এবারের স্লোগান ছিল ‘অভিন্নতা ও বৈচিত্র্য’। ডয়চে ভেলের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলাম আরটিভি থেকে আমি, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালেদি, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, দৈনিক নিউএইজ সম্পাদক নূরুল কবীর, বাংলা ট্রিবিউন সম্পাদক জুলফিকার রাসেল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. সাজ্জাদ বকুল।

প্রতিদিন কনফারেন্স শেষে আমরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়তাম শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে। তেমনি একদিন ডয়চে ভেলের দক্ষিণ এশিয়ার দায়িত্বে থাকা ডিস্ট্রিবিউশন এক্সিকিউটিভ টাবাস গ্রোট-বেভারবোর্গ ‘র নেতৃত্বে রওনা হলাম রাইন নদীর তীরে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত শ্লোস ড্রেচেনবুর্গ প্রাসাদ দেখতে। ড্রেচেনবুর্গ মানে ‘ড্রাগন ক্যাসল’। জার্মানির এক বিখ্যাত ব্যাংকার ও স্টকব্রোকার ব্যারোনে স্টিফেন ভন শর্টার (১৮৩৩-১৯০২) বসবাসের জন্য এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। শুনলাম বিশাল এই দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদটি নির্মাণ করতে তিন বছরেরও কম সময় লেগেছিল!

আমরা যেদিন ভ্রমণে বের হলাম সেদিন বেশ গরম পড়েছিল, তবে সহনীয়। সকালে তৈরি হয়ে হোটেল থেকে আমরা ৩০-৩৫ জনের একটি দল বিশাল এক ট্যুরিস্ট বাসে রওনা দিলাম। প্রশস্ত বাসে জুটি বেঁধে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম সবাই। বাস ছাড়লো। ঘণ্টাখানেক শহরের মধ্য দিয়ে চলবার পর একসময় আমরা ফেরিতে উঠলাম।

এটা রাইন নদী। লুসাই পাহাড় থেকে যেমন আমাদের কর্ণফুলী নদী নেমে এসেছে তেমনি সুইস পাহাড় আল্পস থেকে নেমে এসেছে রাইন নদী এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলে গিয়েছে জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ পশ্চিম হল্যান্ডের মধ্য দিয়ে উত্তর সাগরে। রাইন নদীতে রোদের ঝিকিমিকি। দূরের উঁচু পাহাড়গুলো আমাকে ডাকছে। রাইন নদীর ওপারেই আমাদের গন্তব্য। নদীটা খুব চওড়া নয়। তবে পানি দূষণমুক্ত এবং স্বচ্ছ। ঢাকার বুড়িগঙ্গা বা তুরাগ নদীর মতো রাইনকে জার্মানিরা বর্জ্য ফেলবার ভাগাড় বানায়নি। নদীর দুপাশে ঘন সবুজ অরণ্যে ছাওয়া উঁচু উঁচু পাহাড় ধ্যানস্থ মৌনতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাইন নদী পার হয়ে আমাদের বাস ছুটলো ড্রেচেনবুর্গ-এর পথে।

একসময় এসে পৌঁছলাম ট্রাম স্টেশনে। কাচের ওপাশে প্লাটফর্মে দুই বগির ট্রামগুলো ট্যুরিস্টদের জন্য অপেক্ষমাণ। আমরা ট্রামে উঠে যে যার পছন্দমতো আসন গ্রহণ করলাম। ট্রাম ছাড়ল। দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে গাছপালা ঘেরা পথ বেয়ে আমাদের ট্রাম ছুটে চলল। মাঝে মাঝে ট্রাম লাইনের সমান্তরালে পাকা পিচঢালা পথও রয়েছে। দুপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় এসে পড়লাম শ্লোস ড্রেচেনবুর্গ স্টেশনে। চমৎকার সাজানো গোছানো সবকিছু। জার্মানিরা প্রকৃতিকে ক্ষতি না করে পথ-ঘাট, বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি করেছে যে প্রকৃতি আর স্থাপনা যেন পরস্পরের পরিপূরক।

ট্রাম থেকে নেমে দলবেঁধে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম শ্লোস ড্রেচেনবুর্গ অর্থাৎ ‘ড্রাগন ক্যাসল’ এর দিকে। পথের দুপাশে বড় বড় গাছ ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে আমাদের ওপর। দূর থেকেই চোখে পড়লো পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ১৮৮৩ সালে নির্মিত ব্যারোনে স্টিফেন ভন শর্টার এর ‘ড্রাগন ক্যাসল’। বন শহরের কাছাকাছি রাইন নদীর তীর ঘেঁষে ড্রেচেনফেলস পাহাড়ের ওপর নির্মিত এই প্রাসাদটি। রাইন নদীর তীরে অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রাসাদ। সাত পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ সুন্দর এই গ্রাম। রাইন নদীর জলে মিশে আছে হাজার বছরের ইতিহাস।

সিঁড়ি বেয়ে উঠবার আগে দূর থেকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে প্রাসাদটির সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এই প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি আমার দেখা অন্যান্য প্রাসাদের মতো ছড়ানো নয় কম্প্যাক্ট। আয়তনে এটা ছোট বলে মনে হলো। তবে প্রাসাদটির মূল সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে কারুকাজময় ঘড়ি টাওয়ার, গম্বুজ ও বুরুজগুলোর উর্দ্ধমুখীতার জন্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেয়াল, জানালা, দরজার সূক্ষ্ম কারুকাজ ও রঙের ব্যবহার। শিশুদের রূপকথার বইতে পরীর প্রাসাদের যেমন রঙিন ইলাস্ট্রেশন থাকে এই প্রাসাদটিও ঠিক যেনো সেরকম।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই ড্রেচেনবুর্গ প্রাসাদটিতে উঠবার অনেকগুলো পথ রয়েছে। আমি প্রাসাদের ডান পাশের নিরিবিলি পথ বেয়ে ওপরে উঠলাম। প্রাসাদের চত্বরে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো অনতিদূরে প্রাসাদে ওঠার মূল সিঁড়ির দুপাশে শিংওয়ালা বল্গাহরিণের দুটি সোনালী ভাস্কর্য। প্রাসাদের চারিদিকে অসাধারণ সবুজের সঙ্গে ফুলেল শোভা। অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য৷ অদ্ভুত এক শীতল বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল পাহাড়ে ওঠার সমস্ত ক্লান্তি৷সূর্যের তীর্যক আলো প্রাসাদটিকে দিয়েছে এক অপরূপ মহিমা। এমন সময় চোখ গেল একটি জটলার দিকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা-গাইড বর্ণনা করছেন এই প্রাসাদ সম্পর্কে। জানতে পারলাম বর্তমানে এই প্রাসাদটি উত্তর রাইন ওয়েস্টফালিয়া স্টেট ফাউন্ডেশন দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে। একসময় তিনি আমন্ত্রণ জানালেন প্রাসাদে প্রবেশের। আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম।

প্রবেশের মুখেই আমাদের চোখে পড়ল এই প্রাসাদের মালিক ব্যারোনে স্টিফেন ভন শর্টার এর ব্যবহৃত ঊনিশ শতকের একটি গাড়ির ওপর। এত পুরনো গাড়ি এর আগে আমার কখনো দেখা হয়নি। দেখলাম গাড়ির শরীরে বয়সের ছাপ পড়েছে। এরপর আমরা এগিয়ে গেলাম উন্মুক্ত ছাদ চত্বরে। ছাদ থেকে রাইন নদীর অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ল। রাইন নদীর ওপর দিয়ে বয়ে আসা নির্মল বাতাস রোদের তীব্রতাকে কমিয়ে দিল। আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ছবি তুলতে। যেদিকে তাকাই ছবি তোলার এক আদর্শ স্থান। প্রাসাদের বুরুজ, ব্যালকনির রেলিং ও দেয়ালের সূক্ষ্ম কারুকাজ এক কথায় অসাধারণ! পাথর কেটে কেটে যেসব চিত্র, ভাস্কর্য, মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাতে নাম না জানা সেসব শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। একসময় আমাদের ডাক পড়ল নাস্তা গ্রহণের। দেখলাম, ছাদের এক পাশে বিশাল ছাতার নিচে লম্বা টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো বার্গার, স্যান্ডউইচ, চা, কফি। যে যার মতো কিছু খেয়ে উঠে পড়লাম। এবার আমরা মূল কক্ষগুলোতে প্রবেশ করলাম। সেখানে আমার জন্য এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল! কী নিপুণভাবে সাজানো প্রতিটি কক্ষ। অসাধারণ সব দেয়ালচিত্র, যেন গল্পের চিত্ররূপ! ছাদের কারুকাজ থেকে মেঝের মোজাইক পর্যন্ত সবটার মধ্যে রাজকীয় রুচিশীলতার ছাপ। আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ পর্দা সবই পরিপাটি করে সাজানো। বেডরুম, কনফারেন্স রুম, বিলিয়ার্ড রুম, রিডিং রুম, ডাইনিং হল প্রতিটি কক্ষ নিপুণ পরিপাটি করে সাজানো। প্রতিটি ঘর দামি অ্যান্টিকসে ঠাসা। প্রাচীন আমলের অর্গান দেখলাম একটি ঘরে। ছাদ থেকে নেমে এসেছে ঝাড়বাতি। কোনো কোনো ঘরের দেয়াল ও ছাদ কাঠের কারুকাজ করা। কারুকাজের ওপর হাত বুলিয়ে স্মরণ করলাম সেই সব নাম না জানা শিল্পীদেরকে। যাঁদের নাম হয়তো কোনো দিনই জানা যাবে না। ঘরের জানালাগুলো প্রায় ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। জানালার কাছে না দাঁড়ালে বোঝা যাবে না কত অপূর্ব মনোরম এই দৃশ্য। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম দূরে দাঁড়ানো পাহাড়গুলো।

মেঘেরা মিশে গেছে পাহাড়ের সঙ্গে। যেন মেঘের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলে যাওয়া যাবে অনায়াসে। আর সেই পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে রাইন নদী বয়ে চলছে। অপূর্ব নৈসর্গিক স্থানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। মনে হলো যেন ছবির ক্যানভাসে চোখ রেখেছি।

এসব দেখতে দেখতে কখন যে দলছুট হয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। এঘর ওঘর করতে করতে চোখে পড়লো সবাই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। আমিও তাদের সঙ্গে সিঁড়িতে পা রাখলাম। এবারে আমরা এসে দাঁড়ালাম ঘড়ি টাওয়ারে। আমাদের গাইড মহিলা হাত-পা নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে কী যেন বলছেন। আর আমরা জানালার পাশে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি। আমি আর টাবাস গ্রোট একটা জানালার পাশে বসলাম। সেখান থেকে চোখ রাখলাম বাইরে। সে এক অপরূপ চোখ জুড়ানো দৃশ্য! দূরের পাহাড় ঢাকা পড়েছে ঘন সবুজ অরণ্যে।

আর এ অরণ্যের মাঝে উঁকি দিচ্ছে দোচালা ঘর। পাশে বহতা রাইন নদী। তার পাশ ঘেঁষে চলে গিয়েছে মেঠোপথ। আমরা রয়েছি ড্রেচেনফেলস পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত ড্রাগন ক্যাসেলের মধ্যে। নিজেকে একটি রূপকথার চরিত্র বলে মনে হলো। আমি দৃষ্টি আরও ছড়িয়ে দিলাম সামনে যতদূর যায়। সবুজ সুন্দর পাহাড় মন জুড়িয়ে যায়। মেঘপাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করলাম মানুষকে প্রকৃতির কাছে ফিরে আসতেই হবে। প্রকৃতিই মানুষের প্রকৃত বন্ধু আর কেউ নয়। অনুলিখন : সৈয়দ সাবাব আলী আরজু। সৌজন্যে : আরটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *