চেরাপুঞ্জি অর্থ কমলালেবুর দ্বীপ। ভারতের মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,৮৬৯ ফুট উচ্চতার এ অঞ্চলটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের জন্যও পরিচিত। কমলালেবুর দ্বীপ ঘুরে এসে লিখেছেন- মিডিয়া কাউন্সিল ফর ট্যুরিজম বাংলাদেশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী মুনছুর আজিজ।
পাশাপাশি সাতটি ঝরনা। সেজন্য এর নাম সেভেন সিস্টার ঝরনা। কেউ কেউ বলেন, ভারতের সাতটি রাজ্যের পানি এসে মিশেছে এ ঝরনার সঙ্গে। তাই এর নাম সেভেন সিস্টার। অনন্য সুন্দর এ ঝরনা দেখি মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে। ঝরনার অবস্থান পৃথিবীতে বিরল। তবে শীতকালে বৃষ্টি কম থাকায় এখন ঝরনার প্রবাহ কিছুটা কম। তথাপি দূর পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এ ঝরনা দেখার অনুভূতি লেখার বা শোনার নয়, এ শুধুই দেখার।
সেভেন সিস্টার ঝরনায় আসি মেঘালয় ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। শিলংয়ের পুলিশ বাজার থেকে মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের বাসে উঠি সকাল ৮টায়। উদ্দেশ্য চেরাপুঞ্জি। আগের দিন বিকেলেই ৩৫০ রুপি দিয়ে এ বাসের টিকিট সংগ্রহ করি। বাসে অন্য যাত্রীর সঙ্গে আমরা আছি বাংলাদেশী ১০ জনের একটি দল। অবশ্য ঢাকা থেকে যে যার মতো এলেও শিলংয়ে নেমে ১০ জন এক হই। দলের অন্যরা হলেন-সাব্বির, পাশা, সুমন, আবিদ, মাসুদ, বেলাল, সারা, অভি ও মিজান।
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির দূরত্ব প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৪,৮৬৯ ফুট। এটি পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার অংশ। চেরাপুঞ্জির আগের নাম ছিল সোহরা। স্থানীয় ভাষায় সোহরা অর্থ চূড়া। কারণ এলাকাটির অবস্থান পাহাড়ের চূড়ায়। পরে নাম রাখা হয় চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জি অর্থ কমলালেবুর দ্বীপ। কারণ এখানে কমলালেবুর চাষ বেশি হয়। কমলা ছাড়া এখানে পান-সুপারিও চাষ হয়। অবশ্য চেরাপুঞ্জি বেশি পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের অঞ্চল হিসেবে। চেরাপুঞ্জি একসময় মেঘালয়ের রাজধানী ছিল। ১৮৬৪ সালে চেরাপুঞ্জি থেকে শিলংয়ে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়।
সেভেন সিস্টারের আগে চা-বিরতির জন্য বাস থামে মকডক সেতুর কাছে। দুই পাহাড়ের মাঝে ঝুলন্ত এ সেতু। সেতুর গোড়ায় চায়ের দোকান। আর চারপাশে উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়। সে পাহাড়ের মাথায় সাদামেঘ উড়ছে। যেন ইচ্ছে হলেই সে মেঘ ধরা যায়। দৃশ্যগুলো সত্যিই চোখ জুড়ানোর মতো। চা খেয়ে আবার ছুট।
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ ধরে বাস চলে এগিয়ে। অনেক পথ পাহাড় ঘেঁষেই। উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা পথে অনেকটা দুলতে দুলতেই বাস এসে থামে মজমাই নংথাইমাই (mawsmai nongthymmai) ইকো পার্কের গেটে। প্রবেশ মূল্য ১০ রুপি। ২০০৪ সালে উদ্বোধন হয় পার্কটি। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এ পার্কটি মূলত সেভেন সিস্টার ঝরনারই পাহাড়। এ পাহাড়ের মাঝ দিয়েই সেভেন সিস্টার ঝরনার পানি গড়িয়ে নিচে পড়ছে। অবশ্য পার্ক থেকে ঝরনাগুলো দেখা যায় না। সেজন্য এ ঝরনা দেখতে হয় অন্য পাহাড় থেকে। তবে পার্কের কোনায় দাঁড়িয়ে আশপাশের পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা তুলোর মতো সাদামেঘ, আর নিচে দুই পাহাড়ের মাঝের খাদ দেখতে অন্যরকম।
কিছুক্ষণ পার্কে থেকে বাসে উঠি। অল্প সময় পর আসি মজমাই গুহা। প্রবেশ মূল্য ২০ রুপি। ক্যামেরা সঙ্গে থাকলে অতিরিক্ত আরও ২০ রুপি। প্রায় গোলাকার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এ গুহাটির দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। গুহায় কৃত্রিম আলো জ্বলছে। তবু অন্ধকার ভাবটা যায়নি। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পথেই হাঁটি। গুহাটি কোথাও চিকন, কোথাও সুপরিসর। কোথাও মাথা নিচু করে কিংবা হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। গুহার কোথাও পাথর ঘেমে পানি ঝরছে। সব মিলিয়ে গা-ছমছম ভাব। অ্যাডভেঞ্চারময় এ গুহার একমুখ দিয়ে প্রবেশ করে অন্যমুখ দিয়ে বের হতে সময় লাগলো প্রায় ১০ মিনিট।
গুহা দেখে আবার বাসে। এবার আসি সেভেন সিস্টার ঝরনার ভিউ পয়েন্টে। এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সাত ঝরনা। এক পাহাড়ে পাশাপাশি সাত ঝরনা সত্যিই দারুণ। তবে মনটা একটু খারাপ, কারণ এখন বৃষ্টি কম থাকায় ঝরনার আসল রূপটি দেখা হল না। তবে চারপাশের সবুজ পাহাড় আর সাদামেঘের মেলবন্ধন মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
সেভেন সিস্টার বা সাতবোনকে দেখে আসি নিজের দেশকে দেখতে। অর্থাৎ এখান থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। এ স্থানটির নাম টপভিউ (khoh ramham or maw trop)। এ ভিউতে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেশকে দেখে নিই অপলক চোখে। এখানে একটি খাঁড়া পাহাড় আছে। যা অন্য পাহাড়গুলো থেকে আলাদা।
খাঁড়া পাহাড় থেকে আসি থ্যাংখ্যারং (thangkharang) পার্কে। প্রবেশ মূল্য ১০ রুপি, ক্যামেরা ২০ রুপি। বন বিভাগের এ পার্কে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। এখান থেকেও বাংলাদেশ দেখার সুযোগ পেলাম আরেকবার। পার্ক থেকে দূরে একটি ঝরনাও দেখা হল। এ পার্ক থেকে দূরে যে সবুজ পাহাড়গুলো দেখা যায়, সে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যে রাস্তাগুলো আছে, সেগুলোকে মনে হয় কোনো সবুজ দেয়ালে সাদারঙের মোটাদাগ।
তারপর আসি রামকৃষ্ণ মিশন। ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ মিশনে আছে বিদ্যালয়, মন্দির এবং আদিবাসী সাংস্কৃতিক জাদুঘর। দুই গ্যলারির এ জাদুঘরে আছে খাসিয়া, মনিপুরিসহ স্থানীয় আদিবাসীদের পোশাক, গহনা, থালা-বাটি, হাঁড়ি-পাতিল, কৃষি সরঞ্জাম, অস্ত্রসহ তাদের জীবনযাপনের বিভিন্ন নিদর্শন। আরও আছে স্থানীয়দের উৎসব-পার্বন, পোশাক-আশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রীর আলোকচিত্র।
দিনের শেষ গন্তব্য নোহকালিকাই (noh kalikai) ঝরনা। ১১৭০ ফুট উচ্চতার এ ঝরনা ভারতের বৃহত্তম ঝরনাগুলোর অন্যতম। খাঁড়া পাহাড় থেকে সোজাসুজি পড়ছে এ ঝরনার পানি। তাই পানি পড়ার স্থানটি দেখতে নীল রঙের পুকুরের মতো। এখানেও প্রবেশ মূল্য ২০ রুপি। ঝরনা দেখে এখানকার রেস্টুরেন্টে খেলাম দুপুরের খাবার। তখন প্রায় বিকেল। শুনেছি কোনো নোটিশ ছাড়াই যখন-তখন চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়। তাই শখ ছিল চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি গায়ে মাখব। কিন্তু আফসোস, এ যাত্রায় বৃষ্টির দেখা পাইনি। তবে পাহাড়ি রাস্তার দুইপাশের গ্রামগুলোতে ছোট-বড় গির্জা চোখে পড়ে। কমলালেবুর বাগানও দেখি। ভালো লাগলো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়াদের ছোট্ট কিন্তু গোছানো বাড়িঘর দেখে। এ ভালোলাগা নিয়েই বিকেলে রওনা হই শিলংয়ের পথে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
শিলং যাওয়ার জন্য মেঘালয়ের ডাউকি বর্ডার সহজ পথ। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পার হলেই ডাউকি বর্ডার। ডাউকি থেকে ট্যাক্সি পাওয়া যায় শিলং বা চেরাপুঞ্জির। এ ট্যাক্সিতে শিলং বা চেরাপুঞ্জি যেতে পারবেন বা বেড়াতে পারবেন। অথবা মেঘালয় ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডের বাসেও ঘুরতে পারবেন মেঘলায়ের দর্শনীয় স্থান। থাকার জন্য শিলং পুলিশ বাজারে অনেক হোটেল আছে। ভাড়া ডবল রুম ১০০০ রুপি থেকে ৭০০০ পর্যন্ত। এছাড়ও কমবেশি মানের হোটেল আছে। খাওয়ার জন্য অনেক হোটেল আছে। বাঙালি হোটেলও পাবেন। ১০০ রুপি থেকে ৩০০ রুপিতে ভাত-মাছ-মাংস-রুটি সবই পাবেন। শিলং যেতে চাইলে ভিসার আবেদনে ডাউকি বর্ডার উল্লেখ করুন। যাওয়ার আগে সোনালী ব্যাংকে ৫০০ টাকা ভ্রমণ কর দিয়ে নিন। সৌজন্যে : যুগান্তর
Pingback: শিলং-চেরাপুঞ্জির ভ্রমণ খরচ কমলো স্পট বাড়লো | Dhaka Tourist Club
Pingback: ১৫ ডিসেম্বর শিলং-চেরাপুঞ্জি-গৌহাটি ট্যুর | Dhaka Tourist Club
Pingback: ২ ফেব্রুয়ারি শিলং-চেরাপুঞ্জি-শ্নোনেংপেডেং ফেমিলি ট্যুর | Dhaka Tourist Club
Pingback: শিলং-চেরাপুঞ্জি-জৈন্তা হিলস ঈদ ট্যুর | Dhaka Tourist Club
Pingback: এবারের চেরাপুঞ্জি ট্যুর ভরা বর্ষায় | Dhaka Tourist Club
Pingback: চেরাপুঞ্জি-শিলং ঈদ ট্যুরে থাকছে নতুন ও আকর্ষণীয় অনেক কিছু | Dhaka Tourist Club
Pingback: Dhaka Tourist Club
Pingback: ঈদে চলুন শিলং-চেরাপুঞ্জি ঢাকা ট্যুরিস্টের সাথে | Dhaka Tourist Club
Pingback: বিশেষ গ্রুপ ট্যুরে শিলং-চেরাপুঞ্জি চলুন নভেম্বরের ১ তারিখে | Dhaka Tourist Club