এম এ হান্নান
পড়ন্ত বিকেলে ছুটন্ত মোটরবাইকটা গিয়ে থামল বিজয়পুর মৃৎশিল্পের একেবারে দোরগোড়ায়। উঠানজুড়ে কাদামাটির স্তূপ, দুই পাশে দুটি লম্বাটে টিনের ঘর। একটির বারান্দায় চলছে মাটির মণ্ড তৈরির কাজ। তৈরি করা মণ্ড যন্ত্রের ছাঁচে কিংবা হাতের নিখুঁত নকশায় রূপান্তরিত হতে থাকে দৃষ্টিনন্দন মাটির শিল্পকর্মে। শুকানো মৃৎপণ্য আগুনে পুড়ে পোড়ামাটির রূপ নেয়। কতগুলোতে আবার ওঠে চকচকে রংতুলির আঁচড়, দেখে মনেই হয় না যে মাটির তৈরি! আরেকটি ঘরে পণ্য সব থরে থরে সাজিয়ে রাখা। বাজারে ছাড়ার অপেক্ষা। দেশ তো বটেই, দেশের বাইরে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও জাপানে যাচ্ছে মাটির তৈরি এসব পণ্য। মাটির শৈল্পিক পণ্য তৈরির এই জায়গাটি হচ্ছে কুমিল্লার বিজয়পুর। বেচাকেনার পাশাপাশি যে কেউ এখানে গিয়ে সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন। ক্যামেরা হাতে এক বিদেশিনীকে দেখা গেল বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তাঁকে ‘হাই’ জানিয়ে আমরা দেখতে থাকলাম বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের সূতিকাগার।

নারী–পুরুষ মিলেই কাজ করেন বিজয়পুর মৃৎশিল্পে। তাঁরা শুধু শ্রমিকই নন, শিল্পীও বটে! ছবি: এ এম এম সাইদুর রশীদ ও সাইফুল ইসলাম
যেভাবে শুরু
১৯৬০ সালে ব্রাহ্মণদের হাত দিয়ে কুমিল্লায় প্রথম গড়ে ওঠে ‘প্রগতি যুব সংগঠন, ঠাকুরপাড়া’ নামে এক সমবায় সমিতি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান শিল্পভিত্তিক সমবায় সমিতি গড়ার প্রতি জোর দেন। এর ফলে ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল কুমার ও পালদের সাতটি গ্রাম—উত্তর বিজয়পুর, দক্ষিণ বিজয়পুর, নোয়াপাড়া, গাঙকুল, টেগুরিয়াপাড়া, দুর্গাপুর ও বরোপাড়া নিয়ে গঠিত ‘প্রগতি যুব সংগঠন’ নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি’ হিসেবে।

চলছে বিরামহীন কাজ, পেছনে ছবি তোলায় মগ্ন এক শ্রীলঙ্কান দর্শনার্থী
প্রতিষ্ঠালগ্নে এর সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ জন। আমানত হিসেবে জনপ্রতি আট আনা করে মোট ৭ টাকা ৫০ পয়সা জমা করেন। শেয়ারে জনপ্রতি ১০ টাকা করে মোট ১৫০ টাকা ওঠে। মোট ১৫৭ টাকা ৫০ পয়সা মূলধন দিয়ে বিজয়পুর মৃৎশিল্পের যাত্রা শুরু হয়।
এই সমবায় সমিতির সদস্য গোবিন্দ পাল বলছিলেন তখনকার কথা: ‘আমাদের প্রথম বাজার ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস। আমাদের তৈরি পণ্য দেখতে বাইরে থেকে মানুষজন আসতেন। অনেকে তাঁদের পরিবার নিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে বিকেলে বেড়াতে আসতেন বিজয়পুরে। দেখে মুগ্ধ হতেন, কিনে নিতেন। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের যেমন প্রসার ঘটতে থাকে।’
১৯৬৪-তে ঢাকার একটি সংস্থা আরআইএস (রুরাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি) প্রথম তাঁদের ১২ হাজার টাকা ঋণ ও একটি কয়লার চুলা দেয়। তাতে উত্পাদন এগিয়ে চলল পুরোদমে।

গত বছর বিজয়পুর মৃৎশিল্প ঘুরে গেছেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা
যুদ্ধে ছারখার, পরে আবার শুরু
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী সব পুড়িয়ে দেয়। গোবিন্দ পাল বলছিলেন, ‘এমন অবস্থায় নিরুপায় হয়ে ত্রিপুরা শরণার্থী শিবিরে গিয়ে জান বাঁচাই। নয় মাস পর যখন দেশে ফিরলাম, দেখি তখন কিছুই নাই। সর্বত্র কাঁটা-ঝোপ-জঙ্গলে ছেয়ে আছে। নিজেরা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে আবারও মন দিলাম মৃৎশিল্পের কাজে।’
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ইংল্যান্ড ও ভারত হয়ে দেশে ফিরে কুমিল্লায় আসেন। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে কুমিল্লার অভয়াশ্রমে তখন বিশাল এক জনসভার আয়োজন করা হয়। সেই সময়ে ‘ইন্দিরা-মুজিব’ একটি যৌথ ক্যালেন্ডার ছিল প্রায় সর্বত্র। তখন সেই ক্যালেন্ডার দেখে বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সদস্যরা একটি ত্রিমাত্রিক মডেল বানালেন প্লাস্টার দিয়ে। তা ওই জনসভায় সমিতির পক্ষ থেকে সম্মাননা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁদের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে ৭৫ হাজার টাকা অনুদান দেন ও স্থানীয় প্রশাসনকে বললেন সহযোগিতা করতে। স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় কাঠ, সিমেন্ট আর টিনের ব্যবস্থা করে দিল। আর অবকাঠামোগত কাজে এগিয়ে এসেছিলেন প্রকৌশলী আতাউর রহমান। ফলে ওই ৭৫ হাজার টাকা আর সরঞ্জামাদি দিয়ে একটি ঘর তুলে সমিতির শিল্প চালানোর মতো একটা পরিবেশের সৃষ্টি হলো তখন।

বিক্রয়কেন্দ্রে সাজানো পণ্য
ক্রমে ক্রমে উন্নতি
১৯৭৫ সাল। শেখ মুজিবুর রহমান তখন রাষ্ট্রপতি। জুন-জুলাইয়ের দিকে রাষ্ট্রপতির বিশেষ তহবিল থেকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে (বিসিক) সাড়ে চার লাখ টাকা দেওয়া হয় এখানে বৈদ্যুতিক চুলা বসানোর জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সেই চুলা আর বসানো হলো না। বিসিক সেই বৈদ্যুতিক চুলা বসাল ১৯৮২ সালে। কিন্তু কয়েলে ত্রুটি ছিল বলে সেই চুলা কাজে এল না। পরে ১৯৯১ সালে বিসিক আরেকটি চুলা বসায় ফার্নেস অয়েলের, যা এখনো বর্তমান।
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৯৪ সালে সাড়ে আট কিলোমিটার দূর থেকে গ্যাস-সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর থেকে উত্পাদিত পণ্য নষ্ট হওয়ার পরিমাণ কমতে থাকে। ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ থেকে কমে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে পণ্য নষ্ট হওয়ার হার। আর বার্ষিক নিট লাভের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় আট থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা। সেই টাকা দিয়ে তখন ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ জায়গাও কেনা হলো এই শিল্পের জন্য। উত্পাদন বাড়াতে ১৯৯৭-৯৮ সালে সমিতির সদস্যরা ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি কয়লার চুল্লি কেনেন। ২০১০ সালে বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি সমবায় অধিদপ্তর প্রকল্পের নজরে আসে। সেই প্রকল্পের সুবাদে সমিতি পেল সাড়ে ২২ লাখ টাকা মূল্যের আরও একটি বড় চুলা।
শুরুর সেই ১৫ জন থেকে সমিতির সদস্যসংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৯ জনে। তাঁদের মধ্যে ১৪২ জন পুরুষ ও ৬৭ জন নারী সদস্য। গোবিন্দ পাল জানালেন, ১৫৭ টাকা ৫০ পয়সা দিয়ে শুরু করে সমিতির মূলধন এখন দাঁড়িয়েছে সাত-আট কোটি টাকায়।

চলছে মাটির ল্যাম্পশেড
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্রের পাশেই আছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মৃৎশিল্প সমিতির সদস্যরা তাঁদের কাজের দক্ষতা ও পরিধি বাড়ান। শুধু তা-ই নয়, প্রতি তিন-চার মাস অন্তর ৫ থেকে ১৫ দিন মেয়াদে দেশের নানা প্রান্তের মৃৎশিল্পীরা এসে এখানে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পান।

মাটির তৈরি রঙিন ফুলদানি
ক্রেতা-দর্শনার্থী
বিজয়পুর মৃৎশিল্পের বিজয় এখন বিশ্বজোড়া। রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবকটি দেশে।
১৩টি দেশের ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে বিজয়পুর মৃৎশিল্পে। বার্ডের কল্যাণে বিদেশি দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। এই প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের দিনও পাওয়া গেল জাপান, ভারত, তাইওয়ান, ইরান, মিসর, ঘানা ও আরও কয়েকটি দেশ থেকে আসা ১৬ জনকে। ঘানা থেকে আসা কিপো জানালেন, তিনি পছন্দের কিছু পণ্য ঘানায় নিয়ে যেতে চান। চকচকে রং করা মসৃণ মাটির পণ্য দেখে মিসরের ক্রেতা তো বিশ্বাসই করতে পারছেন না এ যে শুধু মাটির তৈরি।
বিজয়পুর মৃৎশিল্প এলাকা খোলা থাকে রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। সৌজন্যে : প্রথম আলো