আ ন ম আমিনুর রহমান
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের খোঁজখবর নেওয়া ও নোনাজলের প্রকৃতিতে অবগাহন করার উদ্দেশ্যে সাতজনের একটি দল নিয়ে ২০১৪ সালের ১২ মার্চ ঢাকা থেকে ট্রেনে রওনা হলাম। ১৩ মার্চ ভোরে খুলনা পৌঁছে হোটেলে নাশতা সেরে মাইক্রোবাসে মংলা। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় ছোট্ট লঞ্চ এমভি রাজকন্যায় চেপে সুন্দরবন অভিযান শুরু হলো। পথে ঢাংমারী ফরেস্ট বিট, করমজল কুমির প্রজননকেন্দ্র ও জয়মণিরঘোলে বিরতি। জয়মণিরঘোল থেকে ফরেস্ট গার্ড নিতে তিন-চার ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়ে গেল। যা-ই হোক মংলা নদী থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তা পশুর নদ হয়ে শেলা নদী, শেলা গাঙ পেরিয়ে কটকা ফরেস্ট বিটে পৌঁছাতে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল। পথে জেলেদের মাছ ধরা, বাওয়ালিদের গোলপাতা কেটে নৌকায় তোলা, নোনাপানির কুমিরের সাঁতরানো, সন্ধ্যায় পাখিদের নীড়ে ফেরার দৃশ্য দেখে মনটা ভরে গেল।

এক জোড়া ভোঁদড়। ছবিটি ২০১৪ সালের ১৪ মার্চ সুন্দরবনের কটকার জামতলা খালের পাড় থেকে তোলা। ছবি: লেখক
১৪ মার্চ ভোরে কটকা খালে নোঙর করা রাজকন্যা থেকে ছোট নৌকা নিয়ে জামতলা খালে ঢুকলাম। ভোর সাড়ে ছয়টায় জামতলা খালের ডান পাশের বনে মায়ের সঙ্গে মায়াবী চোখের এক খুদে হরিণশাবককে চরতে দেখলাম। নৌকা চলছে, এমন সময় বাঁ দিকের খালপাড়ে খটখট আওয়াজ শুনে তাকালাম। দুজোড়া বিস্ফারিত চোখ মুহূর্তের মধ্যে যেন আমাদের চোখে আটকে গেল। সংবিৎ ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিরল প্রাণী দুটো বনের দিকে ভোঁদৌড় দিল। এরপর বিরল ও দুর্লভ পাখি-প্রাণীর খোঁজে দুপুর পর্যন্ত জামতলী বিচ ও কটকায় কাটালাম। কটকাকে বিদায় জানিয়ে আন্ধারমানিকের উদ্দেশে যখন রওনা হলাম, তখন সূর্য মাথার ঠিক ওপরে। বিকেল পৌনে পাঁচটায় শেলা নদী থেকে সুন্দরী খালে প্রবেশ করলাম। পানিতে দাপাদাপির শব্দ শুনলাম। আমাদের ছোট্ট রাজকন্যা শব্দের উৎসের কাছাকাছি আসতেই ভোরের সেই প্রাণীদের সঙ্গে আবার দেখা হলো। তবে এবার মা-বাবা ও বাচ্চাসহ সংখ্যায় ওরা চারজন। লঞ্চ কাছে আসতেই ওরা পানি থেকে খালপাড়ে ওঠে মুহূর্তের জন্য আমাদের দিকে তাকাল। এরপর দ্রুত গরান বনের ভেতর হারিয়ে গেল।
এতক্ষণ বিরল যে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কথা বললাম এরা ভোঁদড় বা ছোট উদ (Oriental Small-clawed Otter, Asian Small-clawed Otter or Short-clawed Otter)। উদবিড়াল, ধাইড়া উদ বা ধেড়ে নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে প্রাপ্ত তিন প্রজাতির ভোঁদড়ের মধ্যে এরাই সবচেয়ে ছোট। মাস্টেলিডি পরিবারভুক্ত এই প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম Aonyx cinerea।
ভোঁদড়ের মাথা ছোট, পা খাটো ও লেজ চ্যাপ্টা। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৫-৬১ সেন্টিমিটার ও লেজ ২৫-৩৫ সেন্টিমিটার। ওজন ২.৭-৫.৪ কেজি। লম্বাটে দেহটি খাটো পায়ের ওপর স্থাপিত। সামনের পা দুটো পেছনের পায়ের চেয়েও খাটো। দেহের ওপরের লোমের রং গাঢ় ধূসর-বাদামি। মাথা ও ঘাড়সহ দেহের নিচটা হালকা ক্রিমরঙা।
ভোঁদড় অগভীর স্বাদুপানির জলপ্রবাহ ও নদী, উপকূলীয় অঞ্চল এবং গরান বনের পানিতে বিচরণ করে। বর্তমানে মূলত সুন্দরবনেই দেখা যায়। সাধারণত ছায়াযুক্ত এলাকা পছন্দ করে। একাকী, জোড়ায় ও ছোট পারিবারিক দলে থাকে। পছন্দের খাদ্যতালিকায় রয়েছে কাঁকড়া, খোলসি মাছ, নরম শরীরবিশিষ্ট প্রাণী ও ছোট মাছ। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর; পানির নিচেও ওপরের মতোই সমান দেখে। খাবার গ্রহণের সময় ডাকাডাকি করে। খাবার খোঁজার জন্য হাতই বেশি ব্যবহার করে, যা অন্যান্য প্রজাতির ভোঁদড়ের ক্ষেত্রে তেমন দেখা যায় না।
ভোঁদড় সারা জীবনের জন্য জোড়া বাঁধে। বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করতে পারে। পুরুষ ভোঁদড় বাসা বানানো ও বাচ্চার খাবার জোগাড়ে সাহায্য করে। প্রতি জোড়া ভোঁদড় বছরে দুবার ও প্রতিবার এক থেকে ছয়টি করে বাচ্চা দিতে সক্ষম। তবে সচরাচর দুটি বাচ্চাই জন্ম দেয়। ভোঁদড় বাঁচে ১১ থেকে ১৬ বছর। সূত্র : প্রথম আলো