Skip to content

সুন্দরবনে বাঘের মুখোমুখি

:: রেদোয়ান খান ::
সুন্দরবনে ভ্রমণে যদি কোনো বিষয় সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত হয়ে থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে বাঘের দর্শন! কিন্তু এ সৌভাগ্য খুব কম টিমেরই হয়। এ পর্যন্ত যেসব দলের সেই সৌভাগ্য হয়েছে, এবারের রাসমেলার ট্যুরে আমরাও তাদের অংশ হয়ে গেলাম। আমাদের রুট প্ল্যান ছিল দুবলারচরের রাসমেলার উদ্দেশে রওনা হয়ে পথে দেখব সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়িয়া ও কটকা পয়েন্ট। বাঘের সামনে পড়ার সেই কাঙ্ক্ষিত স্থানটি ছিল আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য হারবাড়িয়া। বাড়ি মংলাতে হওয়ায় সুন্দরবন সম্পর্কে যতটুকু জানি, তাতে এত দিন শুনে এসেছি হারবাড়ীয়ায় একটি বাঘ পরিবারের বাস। বাবা-মা ও দুই সন্তানের পরিবার তাদের। কিন্তু বহুবার গিয়েও তাদের দেখার আক্ষেপ রয়েই গিয়েছিল।

হারবাড়িয়ার লঞ্চ টার্মিনালে নেমে গার্ড প্রথমেই জানালেন, সুন্দরবনের যে কয়টা স্পটে বাঘের বিচরণ সবচেয়ে বেশি, হারবাড়িয়া তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সবার মধ্যেই সেই গা-ছাড়া ভাব। ভাবটা এমন, গার্ডরা তো কত কিছুই বলে! কিন্তু ব্রিজ পার হতেই যখন বাঘের তাজা পায়ের ছাপ চোখে পড়ল, ফুল অ্যাটেনশন হলেন সবাই। সামনে এগোতে এগোতে বনের নীরবতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও বাড়তে লাগল সবার। মাটির রাস্তা শেষে উঠে গেলাম কাঠের ট্রেইলে। গার্ড জানালেন, বাঘের দৃষ্টি থাকে মাটির দিকে, তাই তিন হাত উঁচু করে এই ট্রেইল বানানো হয়েছে। যদিও গার্ড অভয় দিয়েছেন, তবু সুন্দরবন বলে কথা। সুন্দরী কাঠের সেই ট্রেইল ধরে দুরুদুরু বুকে হাঁটছিলাম সবাই।

সবার কথা বন্ধ। কিছু একটার সন্ধানে সবার চোখ শুধু ঘুরছে আশপাশে। কিছুদূর গিয়ে শেষ হলো কাঠের ট্রেইল। গার্ড বললেন, এবার নামতে হবে মাটিতে। শুনে তো সবার অবস্থা খারাপ। তবু বন্ধু-বান্ধবের সামনে ভয় কি আর প্রকাশ করা যাবে! হাজার হলেও এসেছি তো বাঘের দর্শনে! সবাই একবার সবার দিকে তাকিয়ে বনরক্ষীকে সামনে নিয়ে এগিয়ে চললাম কাঁচা রাস্তা ধরে। ট্রেইল না থাকলেও এখানে এসেই যে বিপত্তিটা ঘটবে, কল্পনাও করিনি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গার্ডকে পেছনে ফেলে সুমন সামনে এগিয়ে গেছেন, খেয়াল করিনি। কিছুদূর এগিয়েই হঠাৎ সুমনের চাপা চিৎকার, বাঘ! বাঘ! গা ছমছম করে উঠল আমার, এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেলাম সবাই। গার্ড আগেই বলেছিলেন, মামাকে দেখলে ছোটাছুটি না করে একসঙ্গে জড়ো হয়ে চিৎকার করবেন সবাই। কিন্তু ভয়ে সবাই জড়ো হলেও চিৎকার করার কথা যেন মনেই নেই কারো। একটু সময় কাটতেই বিষয়টা নিয়ে মজা করতে শুরু করলেন কেউ কেউ। অবিশ্বাসের আঙুল সুমনের দিকে। কিন্তু আগেই বলেছি, হারবাড়িয়া সম্পর্কে কিছুটা আইডিয়া ছিল আমার। আর সুমনের চোখ দেখে দুষ্টুমিও মনে হয়নি। বললাম, কোন জায়গাটায় দেখেছ? দেখাল আমাদের ৫০ হাত সামনে দিয়ে রাস্তা ক্রস করেছে সে!

ওর দেখানো পথে অনেকটা দৌড়ে গেলাম সবাই। গিয়ে যা দেখলাম তাতে দুষ্টুমি ভরা মুখগুলো সব চুপসে গেল। সেখানে বাঘের হেঁটে যাওয়ার তাজা ছাপ। এক লাইনে বেশ কয়েকটি থাবার চিহ্ন। পায়ের ছাপ দেখে বনরক্ষী বললেন, দ্রুত সামনে হাঁটেন। হাঁটা শুরু করেছি কেবল, এরই মধ্যে শুরু হলো একটার পর একটা অনবরত হুংকার। বাঘের বিকট সব হুংকারে দিশেহারা টিমের সবাই দৌড়াতে শুরু করলেন যে যেদিকে পারেন। গার্ড সবাইকে ইশারায় সামনের দিকে দেখিয়ে তাকে ফলো করতে বলে দৌড়াতে শুরু করলেন। সামনে গার্ড, মাঝে আমরা, পেছনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন! বনের ভেতর থেকে, থেকে থেকেই চিৎকার করছিল সে। সেদিনই সেই দৌড়ের দৃশ্য কখনই ভোলার নয়। পায়ের নিচে অগণিত ম্যানগ্রোভ মাড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিলাম সবাই। একপর্যায়ে নতুন তৈরি হওয়া ট্রেইল পেয়ে গেলাম সামনে, কিন্তু তাতেও রক্ষে নেই, কংক্রিটের ট্রেইল থেকে পড়ে গেলেন আমাদের গাইড। পায়ের বিশাল অংশ কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছিল অনবরত। উত্তেজনার বশে কখন যে কিলোখানেক জায়গা পাড়ি দিয়ে পুকুরপাড়ে পৌঁছে গেছি, খেয়ালই করিনি। গুনে দেখলাম, দলের মেম্বার সবাই ঠিকই আছে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, বড় করে একটি দম নিলাম। সবার চোখ তখনো পেছনে ফেলে আসা পথের দিকে, আর মনে একটাই প্রার্থনা, এমন পরিস্থিতিতে যেন কেউ না পড়ে! সৌজন্যে: এনটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *