রকিবুল হক রকি
সায়েদাবাদ পৌঁছলাম সন্ধ্যা ৬টায়। ঢাকায় যে রকম ট্রাফিক জ্যাম আশা করেছিলাম, তেমনটা হয়নি দেখে মনটা বেশ ভালো। যাক, যাত্রার আগে এরকম শুভ ইঙ্গিত পেলে মন তো ভালো লাগবেই। সঙ্গে আছেন প্রিয় বন্ধুপ্রতিম রিয়াজ ভাই। আমরা দু’জনে মিলে যাব সুন্দরবনে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেশে। তাই সব কাজের চাপ শেষ করে এই সায়েদাবাদে এসে বসে থাকা।
আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য বাগেরহাট জেলার রায়েন্দা। সেখান থেকেই যেতে হবে সুন্দরবন। তবে জেনে রাখা ভালো, সুন্দরবন যেতে হলে আগে যেতে হবে খুলনার মংলায়, সেখান থেকে ট্রলার বা জালি বোট নিয়ে বন দর্শন। কিন্তু আমাদের যেতে হবে শরণখোলার রায়েন্দা দিয়েই, কারণ আমরা সুন্দরবন দেখার পাশাপাশি আরও দেখব সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট আয়োজিত ভিটিআরটি রোডশো ২০১১। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ-এর সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট আয়োজিত এই রোডশো হবে খুলনা-সাতক্ষীরা-শরণখোলা-চাঁদপাই রেঞ্জের সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামগুলোতে। আমরা টাইগার প্রজেক্টের সঙ্গেই থাকব, গ্রামে গ্রামে ঘুরব আর বোনাস হিসেবে থাকবে সুন্দরবন।
১০ ঘণ্টার লম্বা জার্নি শেষ করে নামলাম রায়েন্দা বাসস্ট্যান্ডে। মাঝে মাওয়া ফেরি করে প্রমত্তা-পদ্মা পাড়ি দিতে হয়েছিল, সময় লেগেছিল প্রায় ঘণ্টা তিনেক। সেখানেই হাঁটাহাঁটি, টাটকা ইলিশ দিয়ে ভাত। পুরো শরীরের হাড়গোড় ব্যথা করলেও আমাদের গন্তব্যে এখনও পৌঁছাইনি। এখান থেকে যেতে হবে রসুলপুর। যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে ছাল-বাকল ওঠা মোটরসাইকেল। একটা বাইক ঠিক করে তাতে চড়ে বসলাম। ভাঙা রাস্তা, পিচ্ছিল কাদা—সব পেরিয়ে ড্রাইভার সাঁইসাঁই করে বাইক চালাতে লাগল। বাইক ছুটছে, তার থেকেও বেশি চলছে তার মুখ। এলাকার নানা বিবরণ দিতে থাকল সে, বেশিরভাগই হচ্ছে সিডর আর আইলা নিয়ে, কীভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই এলাকাটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সেই করুন কাহিনী।
রসুলপুরে ভোর ৬টায় পৌঁছে দেখি, খালের পানিতে ভাসছে টাইগার প্রজেক্টের বোট ‘কদমতলা রানী’। সেখানে মুখে হাসি আর চোখে ঘুম নিয়ে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন টাইগার প্রজেক্টের কমিউনিকেশন এবং প্রোগ্রাম অফিসার রাকিব কিশোর। জানালেন গতকালকে রসুলপুরে রোডশো’র আয়োজন হয়েছিল। একটা সফল প্রোগ্রাম করতে গিয়ে পুরো টিমকেই করতে হয়েছে হাড়ভাঙা খাটুনি। এরকম দশটা রোডশো করতে হবে, যার মধ্যে চারটা এরই মধ্যে হয়ে গেছে। আরও ছয়টা বাকি, পরবর্তী স্থান হচ্ছে রাজাপুর, আমরা সেই রোডশোটাই দেখব। সে কথায় একটু পরেই আসছি।
‘কদমতলা রানী’-তে রান্নাবান্না, ফ্রিজ, টয়লেট, ঘুমানোর জন্য কেবিন, গোসলের সবরকম ব্যবস্থাই আছে। আরও আছেন অতি সজ্জন খোকন ভাই ওরফে সবার ‘আব্বাজান’, বোটের পাইলট মিজান ভাই—যিনি পুরো দিনে মাত্র দুই-তিনটা কথা বলেন আর সেটা শুনে সবাই হাসতে হাসতে শেষ, আরও আছেন সাদাসিধা সাতক্ষীরার মোস্তফা ভাই, লাজুক আলম ভাই, পণ্ডিত চেহারার ফেরদৌস ভাই আর নব্যরোমিও সাগর। সবার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরে আমি আর রিয়াজ ভাই দিলাম এক ঘুম।
ঘুম শেষ করে দেখি দুপুর। খাবার রেডি। বোটের ছাদে উঠে দেখি, কখন যে সেটা খাল থেকে বেরিয়ে বলেশ্বর নদীতে চলে এসেছে, টেরই পাইনি। একপাশে গ্রাম, আরেকপাশে সুন্দরবন। খাবার দাবার বাদ দিয়ে অবাক চোখে সুন্দরবনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ভ্রমণের প্রথম দিনটা কেটে গেল টাইগার টিমের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরেই। নদীর একপাশে গ্রাম, আরেকপাশে সুন্দরবন। গ্রামের মানুষগুলো বেশ সহজ-সরল, বেশ খাতির করলেন আমাদের। সন্ধ্যায় আবার ফিরে গেলাম কদমতলা রানীতে। ইচ্ছা ছিল নদীতে নেমে গোসল করব, কিন্তু কুমির আছে শুনে আর ভয়ে নামলাম না। রাতে খোকন ভাইয়ের হাতে রান্না করা ‘অমৃত’ খেয়ে একঘুম।
পরেরদিন ঠিক করা হলো আমরা কটকা ঘুরতে যাব। কিন্তু বাদ সাধল জোয়ার-ভাটার খেলা। শরণখোলা থেকে কটকা বোটে করে যেতে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা লাগবে, ফলে সেদিন আর ফেরা যাবে না। থেকে যেতে হবে। আর থেকে গেলে পরেরদিনের রোডশো’র কাজ আর হবে না। কটকা যাওয়া হলো না। মনটা একটু খারাপ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু রাকিব কিশোর সেটা হতে দিল না। সে চট করে একটা ট্রলার ভাড়া করে ফেলল। সেটা নিয়েই আমরা নদী পেরিয়ে খালের ভেতর দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে যাব। শুনলাম খালগুলো খুবই ছোট ছোট, বাঘ চাইলে এক লাফেই পার হতে পারবে। বাঘ নিয়ে উদ্বেগ, চিন্তার কি আছে, গ্রামের এত কাছে কি আর বাঘ আসবে? কিন্তু ট্রলারের মাঝি বলল, গতকালকেই সে আর তার ছেলে ওই খালের একেবারে ভেতরে একটা বাঘকে সাঁতরাতে দেখেছে।
শুধু সে না, আরও অনেকেই দেখেছে। তাদের ধারণা, বাঘটা বুড়ো, বয়স হওয়াতে জোয়ান বাঘ সেটাকে ‘থাবড়া’ দিয়ে বের করে দিয়েছে। বুঝলাম বাঘের টেরিটোরিয়াল ফাইটের কথাই বলছে। খাবার কম থাকায় বাঘেরা সব সময় নিজেদের জায়গা নিয়ে সন্দিহান থাকে, অন্য কোনো বাঘকে সেখানে ঢুকতেই দেয় না। ঢুকে পড়লেই বাধে লড়াই। লড়াইয়ে হেরে যাওয়া বাঘ হয় খেতে না পেয়ে মারা যায়, নয়তো গ্রামে বা লোকালয়ে এসে হানা দেয়।
আস্তে আস্তে ট্রলার যখন খাল দিয়ে একেবারে ভেতরে ঢুকতে লাগল, সেটা আরও ছোট হতে লাগল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি বুড়ো বাঘটা লাফিয়ে পড়ল। প্রায় আধঘণ্টা যাওয়ার পরে ট্রলার আটকে গেল কচুরিপানায়। আর যাওয়া যাবে না। মাঝি যখন ট্রলার ঘোরাতে ব্যস্ত, আমরা তখন ব্যস্ত ‘ছইলা’ গাছের ফল খাওয়া নিয়ে। এটা সাধারণত বানরের খাদ্য, মজা পেয়ে আমরাও খাওয়া ধরলাম।
খালের অ্যাডভেঞ্চার বাদ দিয়ে এবার আমরা গেলাম নদী ঘুরে আরেক জায়গা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকতে। সেখানে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। যাওয়ার পথে দেখলাম একটা ছিপ নৌকায় ইলিশ ধরা হচ্ছে, সেখান থেকে দুটো বড় বড় ইলিশ মাত্র দু’শ’ টাকা দিয়ে কেনা হলো। সেগুলো ছিল আমাদের দুপুরের খাবার, আহা, টাটকা ইলিশের সেকি স্বাদ!!
সুন্দরবনের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করা বেশ কষ্টের। পুরো মাটিতে ছেয়ে আছে হোগলার কাঁটা, সুন্দরী আর কেওড়াগাছের শ্বাসমূল। তার সঙ্গে কাদা তো আছেই। ভাবছিলাম এখান দিয়ে তো হাঁটাই দুষ্কর, এখন যদি বাঘমামা এসে দেখা দেয়, তাহলে দৌড় দেব কেমনে? এই ভয় যখন পাচ্ছিলাম তখনই নাকে এলো বাঘের ভয়াবহ বোঁটকা গন্ধ। আলম ভাই জানালেন, এক মাইলের ভেতরেই মামা ঘাপটি মেরে বসে আছেন। সুতরাং সামনে না যাওয়াই ভালো। আমরাও সুবোধ বালকের মতো ফিরে এলাম।
পরেরদিন টাইগার টিমের রোডশো রাজাপুর হাইস্কুলের মাঠে। বেচারা টাইগার টিমের রাশিটাই খারাপ, যেদিন প্রোগ্রাম হবে, সেদিনই বৃষ্টি নামে। এই নিয়মে আজও বৃষ্টি হলো। মাঠ পানি আর কাদায় ভরে গেল। টানা তিনঘণ্টা পানি সেচে বালু ফেলে মাঠ ঠিকঠাক করা হলো। সন্ধ্যায় রোডশো হলো বেশ জমজমাট। রোডশো’র প্রথমেই থাকল বাঘবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির আলোচনা। ভিটিআরটি রোডশো’র মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ই হচ্ছে ‘আমার বাঘ আমার অহঙ্কার—বাঘ-হরিণের সুন্দরবন, ভালোবাসি আজীবন’। প্রায় হাজার দশেক দর্শকের সমাগমে আলোচনায়, গানে, গেমশোতে বেশ সফল একটা প্রোগ্রাম শেষ করা গেল। গভীর রাতে আমরা ফিরলাম কদমতলা রানীতে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। কারণ আগামীকাল যেতে হবে আন্ধারমানিক আর হাড়বাড়িয়া রিজার্ভ ফরেস্টে, সুন্দরবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশে।
সময়স্বল্পতার কারণে আন্ধারমানিকে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না, চলে গেলাম হাড়বাড়িয়ায়। এখানের গহীন বনের ভেতরে আছে বার্কিং ডিয়ার, গুঁইসাপ, বানর, পাখি- আর কপাল ভালো (নাকি খারাপ?) হলে বাঘ মামার সামনে পড়তে হবে। বনে হাঁটার কোনো উপায় নেই, জোয়ারের পানির কারণে মাটি একেবারে কাদা হয়ে গেছে। তবে একটা অনেক লম্বা ব্রিজ আছে, যেটা দিয়ে হেঁটে অনেকদূর যাওয়া যায়। ফরেস্ট অফিসের লোকজন বারবার মানা করে দিয়েছেন, তাই আমরা ব্রিজ থেকে নামলাম না। তবে ব্রিজে করে হেঁটেই বনের যে সৌন্দর্য দেখলাম, তা এক কথায় বর্ণনাতীত।
দু’পাশের দৃষ্টি আটকে যায় ঘন বনে। চারপাশে সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতা, বাইন, বাওয়ালি গাছের সমারোহ। খুব ভালো লাগছিল। মন চাচ্ছিল আরও হাঁটি। আমার সঙ্গের সবারই একই অবস্থা, কারও মুখে কোনো কথা নেই—সবাইকে যেন হাড়বাড়িয়ার জঙ্গল সম্মোহিত করে রাখল পরের দুটো ঘণ্টা।
জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একটা জিনিস টের পেলাম, সেটা হচ্ছে আমাদের সবার খিদে বেশ বেড়ে গেছে। আমাদের এই ব্যাপারটা টের পেয়েছেন বোটের রাঁধুনী এবং সর্বেসর্বা খোকন ‘আব্বাজান’। হেঁটে এসে দেখি তিনি কাঁকড়া ভেজে রেডি করে রেখেছেন। জিভে জল আনা সেই স্বাদ ভোলার নয়।
একটা রাত হাড়বাড়িয়ার ঘাটেই বোটে থাকতে হবে। জায়গাটা নাকি নিরাপদ নয়। সেটা টের পেলাম একটু পরেই। বোটের গা ঘেঁষে বিশাল এক সাপ দেখে সবাই চিল্লাচিল্লি করা শুরু করল। পাইলট মিজান ভাই বোটটা নিয়ে গেলেন নদীর মাঝখানে। সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলেও আমার ঘুম আসছিল না। আমার সঙ্গী হলো রাকিব কিশোর। হঠাত্ পানিতে শব্দ! কি নামল এত রাতে পানিতে? বাঘ, নাকি কুমির? কয়েকটা হরিণ নদীতীরে ডাকাডাকি করছিল, সেগুলোও ভয়ে এক দৌড়ে পগারপাড়। বাকি রাত ভয়ের চোটে আর না ঘুমিয়ে টর্চ জ্বেলে জেগেই কাটালাম।
সকালে আমরা চলে আসার প্রস্তুতি নিলাম। সুন্দরবনের পুরো প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে কদমতলা রানীর মানুষগুলোও খুব আপন হয়ে গিয়েছিল। সবার কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে রওনা দিলাম। তবে এখনই ঢাকার গাড়িতে উঠব না। এখান থেকে যাব চাঁদপাই, সেখান থেকে ভটভটি করে মংলা। মংলায় আছে সুন্দরবনের বিখ্যাত অংশ করমজল।
মংলা থেকে সাতশ’ টাকা দিয়ে একটা সাম্পান ভাড়া করে চলে গেলাম করমজলে। হাড়বাড়িয়ার সঙ্গে এই জায়গারও অনেক মিল। কিন্তু করমজলের সৌন্দর্য হাড়বাড়িয়াকে ছাড়াতে পারল না। অতিরিক্ত পর্যটক, নোংরা, আর জঙ্গল অনেক হালকা বলেই এরকমটা হয়েছে বলে মনে হলো।
মংলায় ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এখান থেকে যাব খুলনায়, সেখান থেকে ধরতে হবে ঢাকার গাড়ি। ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম, পেছনে ফেলে এলাম সুন্দরীর দেশ আর সেখানকার বাসিন্দাদের।