Skip to content

সুলাইমান আ.-এর প্রিয় হুদহুদ

ফরিদী নুমান
১১ অক্টোবর ২০১৪। ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার বেগে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে যায় ভারতের ওড়িশা এবং অন্ধ্রের উপকূলে বিশাখাপত্তম থেকে শ্রীকাকুলাম। এ ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়া হয়েছিল হুদহুদ। ফলে হুদহুদ নামটি সহসাই আবার এ অঞ্চলের মানুষের আলোচনায় আসে।

মানুষ হুদহুদ পাখিকে চিনে প্রাচীনকাল থেকে। মানব সভ্যতার বিভিন্ন যুগের সংস্কৃতিতে একে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়। প্রাচীন মিসরে একে পবিত্র জ্ঞান করা হতো। বাইবেল ও কোরআনে এ পাখির উল্লেখ আছে। কোরআনের সুরা নামলের ২০ নং আয়াতে এর কথা বলা হয়েছে। প্রাচীন পারস্যে এই পাখিকে সততার প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। তবে ইউরোপে একে চোর হিসেবে গণ্য করা হতো। এস্তোনিয়ায় একে মৃত্যুর প্রতীকরূপে দেখা হয়। হুদহুদ ইসরায়েলের জাতীয় পাখি।

Hudhudবাংলা সাহিত্যের অমর কথাসাহিত্যিক বনফুল সুন্দর এই পাখিটির নাম দিয়েছেন ‘মোহনচূড়া’। এর অন্য নাম কাঠকুড়ালি। ইংরেজরা বলে Hoopoe. এটি বাংলাদেশের একটি বিরল পাখি। তবে এশিয়া ও ইউরোপে এটি প্রচুর দেখা যায় এবং এটি বিলুপ্তির শংকামুক্ত। এর অনেক উপপ্রজাতি রয়েছে। সেইন্ট হেলেনা প্রজাতিটি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে।

হুদহুদকে নিয়ে হজরত সুলাইমানের (আ.) অনেক গল্প আছে। তিনি ছিলেন বাদশাহ। একজন বাদশাহকে তার রাজ্য ছাড়াও আশপাশের অনেক খবর রাখতে হয়। বাদশাহ সুলাইমান পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন, পুষতেন। আর গোয়েন্দা তথ্যের জন্য হজরত সুলাইমান (আ.) পশুপাখিদের ব্যবহার করতেন। আর তার গোয়েন্দাবাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিল ছোট্ট মিষ্টি পাখি হুদহুদ।

একদিন হুদহুদ বলল, বাদশাহ নামদার! খোঁজ নিয়ে জানলাম, ইয়েমেন দেশটি শাসন করেন একজন নারী; কিন্তু তিনি অগ্নিপূজক। নাম তার বিলকিস বিনতে শারাহিল। সুলাইমান (আ.) খানিক ভেবে একটি চিঠি লিখলেন রানী বিলকিসের কাছে। তাতে লিখলেন- ‘গোমরাহির পথ ছেড়ে দাও, সত্যের পথে ফিরে এসো। অগ্নিপূজা বন্ধ করো, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করো, তার ইবাদত করো।’

হুদহুদ ঠোঁটে করে এই চিঠি বয়ে নিয়ে পৌঁছে গেল রানী বিলকিসের প্রাসাদে। জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ল রানীর ঘরে। ঘুমন্ত রানীর বিছানার পাশে রেখে আবার দে ছুট। এত পাইক-পেয়াদা, সৈন্যসামন্তের কঠোর প্রহরা ভেদ করে কে রেখে গেল এ চিঠি কেউ বলতে পারল না। রানী ভড়কে গেলেন। অনেক ভেবেচিন্তে সুলাইমানকে (আ.) বাগে আনতে দামি দামি উপঢৌকন দিয়ে দূত পাঠালেন। সুলাইমান (আ.) আল্লাহর নবী। তিনি অত সহজে দমবার পাত্র নন। পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, ‘রানী বিলকিস কি এসব উপঢৌকন দিয়ে আমাকে খুশি করতে চায়? আমি সম্পদের কাঙাল নই। তোমাদের রানী এখনো অগ্নিপূজা ছাড়েনি, তাকে গিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলো।’

Hudhud2খবর পেয়ে রানী ছুটে এলেন নবীর দরবারে। রানী কখন আসছেন, কীভাবে আসছেন- এসব হুদহুদ আগেই জানিয়ে দিল সুলাইমানকে (আ.)। হোক না অগ্নি-উপাসক। কিন্তু তিনিও তো একটি দেশের রানী। তারও সম্মান আছে। মর্যাদা আছে। সুলাইমান (আ.) রাজ দরবারকে সুন্দরভাবে সাজালেন। বিলকিসের আসার পথে তৈরি করলেন তোরণ। রানী আসার আগেই জিনের মাধ্যমে সুলাইমান (আ.) সাবা নগরী থেকে রানীর স্বর্ণখচিত ও পাথরে অলঙ্কৃত সিংহাসন নিয়ে এলেন নিজের দরবারে। রানী এলেন। এখানে নিজের সিংহাসন দেখে তিনি ভেবেই পেলেন না কেমন করে এটা সম্ভব! সুলাইমান (আ.) তাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আল্লাহর একত্ববাদের কথা বললেন। সব দেখে-শুনে মুগ্ধ রানী। অগ্নিপূজা ছেড়ে দিয়ে তখনই শামিল হলেন চির শান্তির পতাকাতলে। পবিত্র কোরআন শরিফে সুরা নামলের ২০ থেকে ৪৪ আয়াতে হজরত সুলাইমানের এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।

হুদহুদ, মোহনচূড়া বা কাঠকুড়ালির ভালো ছবি তুলতে কয়েকবার চেষ্টা করেও পারিনি। খুবই চঞ্চল এই পাখি। হয় সে পালিয়েছে, নয়তো এমন পজিশনে গেছে যেখান থেকে সাবজেক্ট হিসেবে তাকে বের করা কঠিন। ২০১৪-এর ডিসেম্বরে গিয়েছিলাম টাঙ্গাইলের অর্জুনায়। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থেকে দুদিনের টানা নৌভ্রমণ করে একরাতের জন্য অবস্থান নিয়েছিলাম সেখানকার নির্মিতব্য হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজে। খুব ভোরে কলেজের সামনেই শিশিরভেজা খড়বিচালির মধ্যে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় খাচ্ছিল হুদহুদটি।

দ্বিতীয় ছবিটি হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের পূর্বপাশে জনমানবহীন চরকবিরা থেকে তোলা। ২০১৫ সালের মার্চে আমরা দলেবলে গিয়েছিলাম নিঝুম দ্বীপে। এখানকার চরকবিরা পাখিদের স্বর্গরাজ্য। হাঁটতে হাঁটতে প্রচুর হুদহুদ পাখি এখানে পেয়েছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *