Skip to content

সূর্যাপুরী আমের দেশে

Surjopuri-Mango

সামিউল্যাহ সমরাট
এবার উত্তরবঙ্গ ঘুরতে গিয়ে খোঁজ মিলল বিশাল এক আমগাছের। সূর্যাপুরী জাতের সেই আমগাছটি নাকি তিন বিঘা জমিজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পুরনো এক এলাকা হরিণমারী। এখানে আছে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শান্ত ছিমছাম এক গ্রাম মুণ্ডুমালা। এখানকার মুণ্ডুমালা বিজিবি ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশেই চোখে পড়বে বিশাল সেই আমগাছ। তেমন সঠিক কোনো তথ্য না থাকলেও এলাকার লোকজন বলল, বিশালাকার এই গাছটির বয়স আনুমানিক আড়াই শ বছর।

গাছটি দেখাশোনা করছেন শরিফ উদ্দিনের দুই ছেলে—নুর ইসলাম আর সাইদুর রহমান। বাড়ির বাইরে থাকায় সাইদুর রহমানের দেখা পেলাম না। কথা বলেছিলাম নুর ইসলামের সঙ্গেই। তাঁদেরই কোনো এক পূর্বপুরুষ লাগিয়েছিলেন এই গাছ। গাছের পাশেই নুরের চায়ের দোকান। এই গরমে পথের ক্লান্তিতে দুদণ্ড জিরিয়ে নিতে বসে গেলাম তাঁর দোকানে। হয়ে যাক এক পেয়ালা চা। গরম চা হাতে আলাপ জমে উঠতে সময় নিল না। নুর জানালেন, পুরো তিন বিঘা নয়, ৭৪ শতাংশ ভূমিজুড়ে গাছটির ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গাছটির অসংখ্য ডালপালার মধ্যে ১৯টি ডাল কাণ্ড থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে মাটিতে হেলে পড়েছে। সেগুলোও একেকটি আবার আমগাছের মতোই দেখতে। আর এ কারণেই দূর থেকে দেখলে গাছটিকে ছোটখাটো এক আমবাগানের মতো মনে হয়। গাছটিতে এখনো বেশ ফল ধরে। প্রমাণ তো চোখের সামনেই। থোকায় থোকায় আম ঝুলতে দেখলাম। মাটির সঙ্গে লেপটে থাকা ডালের পাতার ফাঁকে ফাঁকে অগণিত আম উঁকি দিচ্ছে। চাইলেই ছুঁয়ে দেখা যায়।

এই গাছের আমের চাহিদাও বেশ। দামও তুলনামূলক বেশি। গাছে মুকুল দেখা দিলেই হাজির হন আম ব্যবসায়ীরা। গাছের সব আম কিনে নেন অগ্রিম, টাকার অঙ্কে যা প্রায় লাখের কাছাকাছি। সূর্যাপুরী জাতের এই গাছটি থেকে মৌসুমে ৮০ থেকে ৯০ মণ আম পাওয়া যায়। আমগুলো দেখতে লম্বাটে। কাঁচা অবস্থায় গাঢ় সবুজ, কিন্তু পেকে গেলে হলদে লাল হয়ে যায়। কাঁচা আম অত্যন্ত টক হলেও পাকা অবস্থায় এর স্বাদ অতুলনীয়।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে নিভৃত পল্লী হলেও যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক দর্শনার্থী আমগাছটি দেখতে আসেন।

আমাদের গল্প চলাকালেই আশপাশে বেশ ভিড় জমে গেল। কেউ গাড়ি রিজার্ভ করে, কেউ বা দল বেঁধে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য গাছের আশপাশে বসার ব্যবস্থাসহ গাড়ি পার্কিং, টয়লেটের বন্দোবস্ত করেছেন আমগাছের মালিক। অবশ্য এসব সুবিধার মূল্যমান ১০ টাকা। গাছটির নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয়। চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়মিত কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেও এই গাছের ব্যাপারে তাঁদের বেশ উচ্ছ্বাস রয়েছে বোঝা গেল। আমাদের ফিরে আসার সময় নুর ইসলাম খানিকটা পথ এগিয়ে দিলেন। তাঁর জন্য দোয়া করতে বললেন, আমৃত্যু যেন এই গাছের দেখাশোনা করতে পারেন।

ফিরে আসার সময় আরেকটি সূর্যাপুরী আমগাছের সন্ধান দিল সঙ্গে থাকা স্থানীয় তরুণ পান্না। এখান থেকে আরো ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে চাড়োল গ্রামের গণেশপাড়ায় এ রকমই একটি গাছের দেখা মিলবে। গায়ে-গতরে নাকি মুণ্ডুমালা গ্রামের সেই আমগাছের মতোই দেখতে। হাতে সময় ছিল। গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম চাড়োলের দিকে।

Surjopuri-Mango2

জাউনিয়া বাজার পার হয়ে বিখ্যাত লাহিড়ি হাট। এই হাটের পশ্চিম দিকে পাড়িয়ায় আছে তেভাগা আন্দোলনের নেতা কম্পরাম সিংয়ের বাড়ি। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে ঘটে যাওয়া জেল হত্যাকাণ্ডে শহীদ হয়েছিলেন কম্পরাম সিং। এই লাহিড়ি হাটেই চল্লিশের দশকে মে দিবসের বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। সেই সভায় উত্তরাঞ্চলের বাঘা বাঘা নেতা উপস্থিত ছিলেন। তথ্যগুলো পেয়েছিলাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী সত্যেন সেনের বইতে।

লাহিড়ি হাট অতিক্রম করে চাড়োলের দিকে এগিয়ে চলেছি। দুই পাশে বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ধানক্ষেত। ধান কাটার মৌসুম এখন। নারী-পুরুষ একসঙ্গে ধান কাটছে। এ দৃশ্য এই অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক। হাটবাজারেও নারীদের উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। গণেশপাড়ায় এসে দেখলাম, এই আমগাছটিও আকৃতিতে বেশ বড়। প্রায় ৫০ শতক জমিতে গাছটির বিস্তার। তবে এই গাছে এবার তেমন একটা আম ধরেনি। গাছটির মালিক তরণী পাল জানালেন, তাঁর দাদা মুক্তিযুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে গাছটি লাগিয়েছেন। হরিণমারীর মতো এখানেও লোকজন গাছটি দেখতে আসে।

পাশেই পাওয়া গেল শতাধিক বছরের পুরনো আরেকটি বিশাল আমবাগান। এই বাগানে সূর্যাপূরী ছাড়াও দেখা মিলল ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি, আশ্বিনীসহ আরো কয়েক জাতের আমগাছের। এ রকম পুরনো আমবাগান আশপাশের কোনো অঞ্চলে নেই।

কথা হলো বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সমিরউদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ বেলাল রব্বানীর সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন। তিনিই জানালেন এই সূর্যাপূরী আমের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা। আমের নামকরণ বা উত্পত্তিস্থল সম্পর্কে একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও জনশ্রুতি আছে, আনুমানিক তিন শ বছর আগে তত্কালীন ভারতবর্ষের দিনাজপুর অঞ্চলে সূর্যপুর পরগনায় এই আমের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। ধারণা করা হয়, ওখান থেকেই সূর্যাপূরী আম এ অঞ্চলে আসে। যেহেতু এই আম অত্যন্ত সুস্বাদু, তাই এর নাম ছড়াতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। দ্রুত আশপাশের এলাকায় আমের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজনও আমের চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে থাকে। ঠাকুরগাঁওয়ের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সূর্যাপুরী আমগাছ পাওয়া যাবে। এখন তো অনেকেই সূর্যাপুরী আমের বাগান গড়ে তুলেছেন।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার শ্যামলী ও গাবতলী থেকে ঠাকুরগাঁওগামী অনেক বাস পাওয়া যায়। ভাড়া এসি ১১০০-১২০০ টাকা, নন-এসি ৬০০-৬৫০ টাকা। এ ছাড়া কমলাপুর থেকে আন্তনগর ট্রেন একতা, দ্রুতযান একপ্রেস দিনাজপুরে আসে। সেখান থেকে বাসে সোজা ঠাকুরগাঁও। ট্রেনের ভাড়া নন-এসি ৩৬৫ থেকে ৪৪০ টাকা, এসি ৭৩০ থেকে ১৩১৫ টাকা। জেলা শহর থেকে বাস বা টেম্পোসদৃশ স্থানীয় বাহন ‘পাগলু’তে চড়ে ৪০ মিনিটে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা। সেখান থেকে ভ্যানগাড়ি বা রিকশায় হরিণমারী বাজার। সেখান থেকে একটু সামনে এগোলেই এই আমগাছের দেখা মিলবে। ফেরার পথে বাজারের ধারে আড়াই শ বছরের পুরনো শিবমন্দিরটিও দেখে আসতে পারেন। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *