Skip to content

সেই সব চায়ের দিন

Tea

একজন নাসিম আনোয়ার

সিলেটের চা বাগানগুলোয় মজুরি মান হিসেবে চালু ছিল টি টোকেন। বাজারসদাইও করা যেত এগুলো দিয়ে। টি প্ল্যান্টার নাসিম আনোয়ারের সংগ্রহে আছে এমন কিছু টোকেন। ইয়াহইয়া ফজল আরো যোগ করেছেন প্রথম বাঙালি চা বাগান মালিক সারদাচরণ শ্যামকেও।

Tea5ক্যাডেট কলেজের চৌহদ্দিতে কেটেছে তাঁর ছাত্রজীবন। পড়তেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর। কিন্তু ছেলের স্বপ্ন ছিল আকাশে ডানা মেলার। বাবাকে এক রকম না জানিয়েই ভর্তি হয়েছিলেন বিমান বাহিনীতে। হলেন যুদ্ধ বিমানের বৈমানিক। অথচ সেই পেশাও তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ আঙিনায় পা রাখেন। তারপর কেটে গেছে প্রায় পাঁচ দশক। তিনি নাসিম আনোয়ার। বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকজন সফল টি-প্ল্যানটারের একজন তিনি। দেশের প্রায় সবকটি বহুজাতিক চা কম্পানিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। ব্যবস্থাপক, পরামর্শকসহ নানা ভূমিকায় কাজ করেছেন। ১৯৯১ সালে চাকরিতে ইস্তফা দেন। পরের বছর নিজে প্রতিষ্ঠা করেন প্ল্যানটেশন অ্যাসিসট্যান্স টি এস্টেট (পিএটিই) সার্ভিসেস। এটি একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। দেশের চা ও রাবারশিল্পের অগ্রযাত্রায় এই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের বাইরেও যান পরামর্শ দিতে। অনেক শ্রম আর ঘামের পরেই চায়ের সবুজ পাতা হয়ে ওঠে কালচে-বাদামি। নাসিম আনোয়ার সব ধাপেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর স্ত্রী হেলেন বনি আনোয়ার স্কটিশ বংশোদ্ভূত। তাঁর পরিবার চার পুরুষ ধরে চা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

নাসিম আনোয়ারের জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৪৭ সালে। ২০ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে জেমস ওয়ারেন কম্পানি লিমিটেডে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন। পরিদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন সাও ওয়ালেস ও ডানকান ব্রাদার্সে। তখন তিনি লোরি গ্রুপ প্রাইভেট লিমিটেডে কর্মরত। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থার অধীনে চা বিষয়ে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের চা-শিল্পের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে এ কাজ বিশেষ ভূমিকা রাখে। শুধু চা-শিল্পে নয়, রাবারশিল্পেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। জেমস ফিনলে লিমিটেডের রাবার বাগানেও কাজ করেছেন পরামর্শক হিসেবে।

টি প্ল্যান্টার হিসেবে কাজ করতে করতে রাবার প্ল্যান্টেশনেও তাঁর আগ্রহ জন্মে। ফিনলের একজন প্ল্যান্টারের সঙ্গে তিনি ন্যাচারাল রাবারের ওপর মালয়েশিয়ায় প্রশিক্ষণও নেন। চা বিষয়ে তিনি প্রথমবার আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেন ১৯৯৬ সালে। সিঙ্গাপুরে সে বছর প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান টি সেমিনার। টি অ্যান্ড কফি ম্যাগাজিনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছিল এর আয়োজক। প্ল্যানটেশনের দর্শন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি, বিপণন, উৎপাদন বাড়ানোসহ নানা বিষয় সেমিনারে গুরুত্ব পায়। দেশের বাইরে একাধিক চা বাগান পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছে নাসিম আনোয়ারের। ১৯৮১ সালে দক্ষিণ ভারতের প্ল্যান্টেশন দেখতে যান তিনি। সেই সফরের অভিজ্ঞতা বললেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে ভারতে কোনো পতিত জমি নেই। এক হেক্টর খালি জায়গা থাকলে সেখানেও তারা চা চাষ করে। আমাদের মতো অর্ধেক খালি ফেলে রাখে না, যে কারণে কম খরচে তারা অধিক উৎপাদন করতে পারে।’ দেশের অনেক সফল চা ও রাবার বাগানের এগিয়ে যাওয়ার নেপথ্য মূল ভূমিকা রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে ‘কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট’-এর সফলতাকে বড় অর্জন বলে মনে করেন তিনি। বললেন, ‘কাজী অ্যান্ড কাজী একটি মানসম্মত প্লান্টেশন মডেল। এটি দেশের প্রথম সফল অর্গানিক টি এস্টেট।’ ১০-১২ বছর ধরে তারা চা নিলামে সর্বোচ্চ মূল্য হাঁকছে। তাদের চায়ের মান এতই ভালো যে তা ‘হেরডস’ দ্বারা স্বীকৃত।

একজন সফল প্ল্যান্টার হতে হলে কিছু গুণ থাকা জরুরি বলে মনে করেন নাসিম আনোয়ার। বললেন, ‘প্ল্যান্টার হতে হলে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হবে। শ্রমিকদের সঠিক ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা, কৃষি, উৎপাদন ও শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগসহ সব বিভাগকে একসূত্রে গাঁথার যোগ্যতা থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতা থাকতে হবে।’ তবে কাজ করতে করতেও এসব বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠা যায় বলে তিনি মনে করেন।

নাসিম আনোয়ার বলেন, ‘পরিচালক ও শেয়ার হোল্ডারদের একেকজনের একেক দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে থাকে। কিন্তু একটা জায়গায় তাঁরা সবাই এক। আর তা হলো ধারাবাহিক মুনাফা অর্জন প্রশ্নে।’ যোগ করলেন, অধিক মুনাফা তখনই আসবে, যখন অধিক পরিমাণে মানসম্পন্ন চা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

চা-শিল্পে নাসিম আনোয়ারের পাঁচ দশকের পথচলা কণ্টকমুক্ত ছিল না। এ সময়ের মধ্যে নিজে তো বটেই, জাতিও ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। সেসব কথা স্মরণ করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বড় দুর্যোগের মুখে পড়েছিল দেশের চা-শিল্প। এ সময় অনেক চা শ্রমিক শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যায়। যুদ্ধ-পরবর্তী সময় তাই বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায় চা বাগানগুলো। চা শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা, কাজের পরিবেশ তৈরি করা, বিধ্বস্ত চা-শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে সে সময় কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল তরুণ প্ল্যান্টার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।’ তাঁদের একজন হতে পারায় নিজেকে নিয়ে আজ গর্ব করেন নাসিম আনোয়ার। দেশের চা-শিল্পকে আমূলে বদলে দিতে ভূমিকা রাখতে চান এই চা বিশারদ। বললেন, ‘সবার আগে আমাদের গতানুগতিক প্ল্যান্টেশন থেকে সরে আসতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে। এটাই চা-শিল্পকে টিকিয়ে রাখার এবং এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র উপায়।’ এই দীর্ঘ সময় নানা প্রজাতির চা প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করেছেন তিনি। সবচেয়ে মূল্যবান ও মজাদার চায়ের তালিকায় প্রথমেই রাখেন রুয়ান্ডার ‘কিতাবি’ চা বাগানের চাকে। নাসিম বলেন, ‘আমার এক সেনা বন্ধু সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন শেষে দেশে ফেরার সময় আমার জন্য এই চা নিয়ে এসেছিল। যুদ্ধে বাগানটি তখন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেই সংকট তারা এখন কাটিয়ে উঠেছে।’ আরেকটি ব্যতিক্রমী তথ্য দিলেন নাসিম। বললেন, ‘ব্রিটিশ আমলে এ দেশের বাগানগুলোতে একধরনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। এসব ধাতব মুদ্রা উনবিংশ শতাব্দীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন চা বাগানগুলোর চা শ্রমিকদের জীবনের সমকালীন জীবন্ত দলিল।’ তাঁর কাছে বেশ কিছু মুদ্রার সংগ্রহ আছে বলেও তিনি জানান।

নাসিম আনোয়ারের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ও আনন্দদায়ক ঘটনাটিও ঘটেছে চা-কে ঘিরে। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘একজন মহানুভব স্কটিশ ম্যানেজারের অধীনে চা-শিল্পে আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। আলেকজান্ডার হেন্ডারসন নামের সেই ভদ্রলোক আমাকে এ পেশায় এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। সবচেয়ে মজার ঘটনা হলো, তাঁর বড় মেয়ে হেলেন বনি আনোয়ারই আমার জীবনসঙ্গিনী। ১৯৭৫ সালে আমরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হই। মধুচন্দ্রিমা উদ্‌যাপনে আমরা মোটরসাইকেলে চেপে শিলং ও গোহাটিতে গিয়েছিলাম। ৪০ বছর পর এখন সে আমার দুই ছেলের মা এবং দুই নাতনি ও এক নাতির দাদি।’

টি টোকেন : নাসিম আনোয়ার
——————————-
গত শতকের তিরিশের দশক পর্যন্ত অনেক চা বাগানে শ্রমিকদের মজুরি বাবদ টোকেন দেওয়া হতো। এগুলো ছিল দস্তার অথবা টিনের। কোনোটার মূল্যমান ছিল পুরো দিনের, কোনোটার অর্ধেক দিনের, কোনোটা তিন বেলার। এগুলোকে বলা হতো হাজরি। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে শ্রমিকরা টোকেন দেখিয়ে টাকা নিতে পারত। এ প্রথাই বেশি জনপ্রিয় ছিল বাগানগুলোয়। টোকেন দেওয়ার দায়িত্বে থাকতেন সাধারণত সরদাররা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাগানবাবুরা।

Tea2

সুরমা উপত্যকা মানে সিলেটের বাগানগুলোয় সকালে গুনতি শুরু হওয়ার সময়ই আগের দিনের টোকেন দিয়ে দেওয়া হতো। শ্রমিকরা মুদির দোকানে টোকেন জমা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কিনতে পারত।

ভারতবর্ষে চা চাষের শুরুর দিকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা এসে জড়ো হচ্ছিল অনেক সংখ্যায়। বাজারে প্রচলিত সব মুদ্রা সবাই চিনতও না, তখন আর খুচরা টাকাও পাওয়া যেত না বেশি। তাই প্রায় একই সময়ে আসামের কাছার আর সিলেটে টোকেন সিস্টেম চালু হয়। এই টোকেন দিয়ে বাগানের বাজারে তো বটেই; কাছাকাছি অন্যান্য বাজার থেকেও সদাইপাতি কিনতে পারত শ্রমিকরা। এজেন্টরা কলকাতা থেকে এসব টোকেন এনে দিত। আর হিটন অ্যান্ড সন্স পরবর্তী সময়ে দ্য মিন্ট বার্মিংহাম লিমিটেড এসব মুদ্রা তৈরি করত।

টোকেনগুলোর মুদ্রামান ছিল তিন আনা, দুই আনা বা ৯ পয়সা। উল্লেখ্য, ১৬ আনায় এক টাকা হতো আর ১২ পয়সায় হতো এক আনা। টোকেনের গায়ে বড়জোর বাগানের নাম থাকত। তা সত্ত্বেও বাগানের সবাই মুদ্রাগুলোর মূল্যমান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত ছিল।

টোকেনের চল ডুয়ার্স, দার্জিলিং বা তেরাইয়ের গার্ডেনে ছিল না। হরেক গড়ন আর আকারের মুদ্রা ছিল যেমন-গোল, তিনকোণা বা বর্গাকার। তবে সবগুলোরই মাঝখানে ছিদ্র থাকত। এখন এর বেশির ভাগই বিলুপ্ত আর সম্ভবত উপমহাদেশের বাইরে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। সাধারনত বড় বড় কম্পানির বাগানে টোকেনের চল ছিল।

আসামের বাগানগুলোয় একেবারে শুরুতে শ্রমিক পাওয়াই যাচ্ছিল না। আদিবাসী বা বাঙালিরা কাজ বুঝত না। তাই ভারতের অন্য অঞ্চল যেমন-বিহার, নাগপুর, মাদ্রাজ, ওড়িষা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হচ্ছিল। প্রলোভন দেখিয়ে এমনকি জোর করেও শ্রমিকদের নিয়ে আসত কম্পানির দালাল বা সরদাররা। অন্য বাগান থেকে দক্ষ শ্রমিক ভাগিয়ে আনাকে সরদারদের কৃতিত্ব হিসেবে দেখা হতো। কঠোর পরিশ্রম, কঠিন জীবনযাপন আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য শ্রমিক প্রায়ই ভেগে যেত। টোকেন পদ্ধতি চালুর পেছনে এটাও কারণ ছিল যে এগুলো দিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটা যেত না। এসব টোকেন সরকার স্বীকৃত ছিল না, তবে সরকার বাগান মালিকদের প্রতি সদয় ছিল।

১৮৭০ সালে প্রথম ধাতব টি টোকেনের প্রচলন ঘটে। শেষ টোকেন লট অর্ডার করা হয়েছিল ১৯৩০ সালে। ১৯৫০ পর্যন্ত প্রথাটি টিকে ছিল। দেশ ভাগের পর সরকারি পয়সার ব্যাপক প্রচলনে এটি ভেঙে যেতে থাকে। সিলেটের লুয়াইনি, উচাইল, রবি, শমশেরনগর, চাঁদপুর ও মুনু বাগানে টি টোকেনের প্রচলন নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের টোকেন এজেন্টের নাম ছিল অক্টাভিয়াস স্টিল অ্যান্ড কোং। ২৮টি বাগানে তারা টোকেন সরবরাহ করত। সিলেটের লস্করপুরে ১৮৯০ সালে পাঁচটি নামি বাগান ছিল-চাঁদপুর, চুণ্ডিছেড়া, আমো, লস্করপুর ও লালচাঁদ। তারা ১৮৭৮ সালে টোকেন অর্ডার দিয়েছিল ইউকে মিন্টকে। আরো খবর পাওয়া যায়, কলকাতা মিন্ট থেকে লস্করপুর টোকেন সরবরাহ পেয়েছিল ১৯২৩ সালে। (মূল ইংরেজি থেকে বাংলা করেছেন বুশরা নাজরীন; সংক্ষেপিত ও অভিযোজিত)

এবং একজন ধ্রুবজ্যোতি
————————–
টিনশেডের বাংলো ধাঁচের খোলামেলা একতলা বাড়ি। বনেদিয়ানা আছে ইট-সুরকির তোড়নটায়। বাড়িটায় বাস করেন ধ্রুবজ্যোতি শ্যাম। সিলেটে প্রথম বাঙালি মালিকানাধীন চা বাগান যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই সারদাচরণ শ্যামের বংশধর তিনি।

Tea3

ধ্রুবজ্যোতি পেশায় আইনজীবী। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে এ পেশায় যুক্ত। কিভাবে শুরু হলো বাঙালিদের প্রথম চা বাগান? একটু থমকে যান। কিছুক্ষণ আনমনে তাকিয়ে থাকেন। বুঝি পূর্বপুরুষের ইতিহাসে ডুব দিলেন। এ সময় মুখের রংও বদলায়। বিষাদ ভর করে মুহূর্তের জন্য। তারপর ধ্রুবজ্যোতি বলে যান সে ইতিহাস।

১৮৬০ সালে জমিদার পরিবারে সারদাচরণের জন্ম। তৎকালীন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, রাজনগর ও বালাগঞ্জ থানার অংশবিশেষজুড়ে তাঁদের জমিদারি ছিল। সারদাচরণ ছোটবেলা থেকেই অন্য রকম ছিলেন। জমিদারিতে নিজেকে আটকে রাখতে চাননি। লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলেন। পরিসংখ্যান ও ইংরেজি-দুটি বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সে সময় পুরো জেলায় দুটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আর কারো ছিল না। লেখাপড়ার পাট শেষে সারদাচরণ সিলেট জেলা বারে আইন পেশায় নাম লেখান। কিছুদিন পর মুনসেফ হয়ে মৌলভীবাজারে চলে যান। সেখানেও খুব বেশি দিন থাকেননি। ইংরেজির অধ্যাপক হয়ে এবার যোগ দেন বিহারের কটক কলেজে। শিক্ষকতার পেশাও তাঁকে জড়িয়ে রাখতে পারেনি। সিলেট জেলা বারে ফিরে আবার আইন পেশায় মন দেন। সিলেট জেলা বারের সভাপতি নির্বাচিত হন পাঁচবার। মনে হলো, এবার বুঝি থিতু হলেন। কিন্তু ১৮৮৮ সালের দিকে নতুন এক চিন্তা তাঁকে অস্থির করে তোলে। তাঁর ভাবনায় এলো, নিজে চা বাগান করবেন। কেন সব বিদেশিরাই করবে?

পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবকে সঙ্গী করে ১৮৯৬ সালে প্রায় চার হাজার ৫০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তুললেন ইন্দেশ্বর টি অ্যান্ড ট্রেডিং কম্পানি। এটি শুধু বাঙালিদের প্রথম চা বাগানই নয়, সে সময়ে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চা বাগান ছিল। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। সিলেট জেলার রাজনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ থানায় নিজেদের জমিদারির কিছু জায়গায় প্রতিষ্ঠা করলেন উত্তরবাগ চা বাগান। সারদা পরিবারের বাইরে যারা এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন, তারাও তখন কিছু জমিজমা দান করেছিলেন বাগানের জন্য। এভাবেই গড়ে ওঠে বাঙালিদের মালিকানাধীন প্রথম চা বাগান।

সারদাচরণ শ্যামের দক্ষ পরিচালনা বাগানকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। ১৯১৬ সালে ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ভাইয়ের ছেলে বিমলাচরণ শ্যাম। তিনিও চাচার মতো আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। বিমলাচরণের হাতে ব্যবসা আরো প্রসারিত হয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠান অকটোভিয়াস স্টিলের কাছ থেকে তিনি কিনে নেন ফেঞ্চুগঞ্জের ইন্দানগর চা বাগান। দুটি বাগানকে একীভূত করে নাম দেন উত্তরভাগ ও ইন্দানগর চা বাগান। বিমলাচরণ শ্যামের পর চা বাগানের দায়িত্ব পান তাঁর ছেলে নরেশচন্দ্র শ্যাম। তিনি পূর্বসূরিদের মতোই দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৫৮ সালে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা প্রতিষ্ঠার সময় বাগানের পক্ষ থেকে ১২৫ একর জমি দান করে সারদা পরিবার। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বাগানের দায়িত্বে ছিলেন নরেশচন্দ্র শ্যাম। এ সময় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেলে তাঁদের বাগানকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে সরকার। আর তখন বাগানটি সারদা পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যায়। ধ্রুবজ্যোতি শ্যামের তাই এ পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাননি। সূত্র : কালের কণ্ঠ

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *