Skip to content

সেতু যেন সাগরের বুকে বিশাল এক ড্রাগন!

:: এজাজ মাহমুদ ::
ছয় লেনের প্রশস্ত সেতু-সড়ক। মাইলের পর মাইল। মধ্যম গতিতে চলছে বাস। যতই এগোচ্ছে রোমাঞ্চকর অনুভূতি আর বিস্ময় মিলেমিশে একাকার। সেই পারদ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের সহযাত্রীদের মধ্যেও। সামনে, ডানে-বামে ঘুরছে সবার দৃষ্টি। অস্ফুট স্বরে ঝরে পড়ছে কারও কারও বিস্ময়—এত্ত বিশাল!

রোমাঞ্চকর অনুভূতি হবেই না কেন? পুরো সড়ক-সেতুটি যে উত্তাল সাগরের ওপর। নদ-নদী, সমতল এমনকি দুর্গম পাহাড়ের ওপর সেতু তো অহরহ দেখা যায়। কিন্তু সাগরের বুক চিরে সেতু, তা-ও আবার সাড়ে ৩২ কিলোমিটার লম্বা! বিস্ময়করই বটেই।

পূর্ব চীন সাগরের হ্যাংজহু উপসাগরের ওপর দঙ্গাই সেতু। ছবি: লেখক

দঙ্গাই সেতু। আরেক নাম পূর্ব সাগর সেতু। এটি চীনের সেতুবিপ্লব ইতিহাসের মাইলফলক। ১৩ বছর আগে সাগরের চোখরাঙানি বশে এনে এই সেতু বানিয়ে সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয় চীন।

রূঢ় পরিবেশ, বিশাল ঢেউ, টাইফুন আর লবণাক্ততার মতো প্রতিকূলতার মুখে সাগরের ওপর দীর্ঘ সেতু বানানোর ‘অসাধ্যসাধন’ করে চীন এই দঙ্গাই দিয়েই। সে সময় এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র-সেতু। বাইরের গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এখন চারটি সমুদ্রসেতুসহ বিশ্বের দীর্ঘতম ১১টি সেতুর রেকর্ডও চীনের দখলে।

পূর্ব চীন সাগরের হ্যাংজহু উপসাগরের ওপরে এই দঙ্গাই সেতু। এটি পেরিয়েই চীনের আরেক বিস্ময় ইয়াংশান গভীর সমুদ্রবন্দর। সেতুটি এই বন্দরের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক রাজধানী সাংহাইকে যুক্ত করেছে। স্থলভূমি থেকে গভীর সমুদ্রবন্দরে পণ্য পরিবহন হয় এই সেতুটি দিয়ে। ২০০৫ সালে সেতুর সঙ্গেই চালু হয়েছিল বন্দরটি।

গত সেপ্টেম্বরে গিয়েছিলাম সাংহাই। দলে ছিলেন ২৮ জন। সবাই চট্টগ্রামের। বুলেট ট্রেনে রাজধানী বেইজিং থেকে সাংহাই আসার সময় ১ হাজার ৩১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম দানইয়াং-কুনশান গ্র্যান্ড সেতু (১৬৪ কিলোমিটার) ও দ্বিতীয় দীর্ঘতম তিয়ানজিন সেতুসহ (১১৪ কিলোমিটার) কয়েকটি দীর্ঘতম সেতু। ট্রেনের ৩০০ কিলোমিটারের দ্রুতগতিতে মজাটা তেমন নিতে পারিনি। তাই দঙ্গাই ছিল শেষ ভরসা। সফরের শেষ দিনে রোমাঞ্চকর সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

ভ্রমণ গাইডের বর্ণনা আর ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, তারে বাঁধা প্রধান স্প্যানসহ বিম কাঠামোর দঙ্গাই সেতুর নির্মাণ শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে। ৬ হাজারের বিশাল কর্মীবাহিনী মাত্র তিন বছরেই বানিয়ে ফেলেন বিশাল এই স্থাপত্য। খরচ হয় ১ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ‘এস’ আকৃতির নকশায় বানানো এই সেতু টিকে থাকবে ১০০ বছর। সাংহাই শহরের পুডং হারবার থেকে সেতুর শুরু। শেষ ইয়াংশান দ্বীপে।

নির্ধারিত গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। আমাদের দেখার সুবিধায় বাস চলছে কম গতিতে। কিছু দূর এগোতে চোখে পড়ল সেতুর দুপাশে সাগরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা উইন্ড মিলের (বায়ু বিদ্যুতের পাখা) সারি। বাতাসে ঘুরছে বিশাল পাখা। এর ছন্দের সঙ্গেই যেন চলছে আমাদের বাস। সে এক দারুণ অনুভূতি। মনোযোগী হলাম আমাদের গাইড সুদর্শন জেফরির বর্ণনায়। একেবারে চোস্ত ইংরেজিতে জানিয়ে দিলেন বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুম্বক অংশ।

বাতাসকে ধরে উৎপন্ন হচ্ছে বিদ্যুৎ। নাম দঙ্গাই সেতু বায়ু খামার। চীনের প্রথম বাণিজ্যিক অফশোর বায়ু খামার। চালু হয় ২০১০ সালে। সাগরের ১৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসানো ৩৪টি টারবাইনের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১০২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে মূল ভূখণ্ড সাংহাইয়ের ২ লাখ পরিবারকে। উৎপাদন বাড়াতে নাকি আরও টারবাইন বসানোর কাজ চলছে।

একপর্যায়ে পথ বাঁক নিতে শুরু করে। বেশ ঘোরানো। বুঝলাম ‘এস’ আকৃতিতে ঢুকেছি। সমুদ্রসেতু প্রকৌশলবিষয়ক গবেষণা থেকে জানতে পারি, এই নকশা গড়ার ক্ষেত্রে নান্দনিক সৌন্দর্যের চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে নিরাপত্তার বিষয়টি। সহজ কারণ, সোজা কাঠামোতে সামুদ্রিক ঢেউয়ের ধাক্কা অনেক জোরে এসে লাগে। আর দীর্ঘ সোজা পথে যাতায়াতে চালকদের চোখের ক্লান্তিতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। বাঁকানো আকৃতিতে সেই ঝুঁকি কম। তা ছাড়া এই আকৃতি সেতুর পাশ দিয়ে জাহাজের নিরাপদ চলাচলও নিশ্চিত করে।

বাঁক শেষে আবার সোজা পথ। কিছু পরই ওপরের দিকে উঠতে থাকে বাস। চোখে পড়ল দূরে মাথা উঁচু করা তারে বাঁধা বিশাল পিলার। সেতুর প্রধান স্প্যান। পাঁচ কিলোমিটার ব্যবধানে ওয়াই আকৃতির বড় দুটি পাইলনে (থাম) মোটা ইস্পাত তারের গুচ্ছে আটকা। এর নিচ দিয়ে পার হয় সমুদ্রগামী বড় বড় জাহাজ। চ্যানেলটি ৪২০ মিটার চওড়া ও ৪০ মিটার উঁচু বলে জানালেন গাইড।

প্রধান স্প্যান পার হয়েই আবার ঢুকে পড়ি ‘এস’ আকৃতির শেষ বাঁকে। এবার নজর পড়ল সেতুর রূপ-লাবণ্যে। এই সাগরের রং বাদামি। গভীর জলের প্রাকৃতিক রঙের মধ্যে সেতুর গাঢ় ধূসর রূপটি বেশ সুন্দর লাগে। রাতে আলোকসজ্জায় নাকি আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। নীল রঙের বাতিতে আলোকিত থাকে প্রধান স্প্যান ও দুটি পাইলন। সঙ্গে সেতু সড়কের মাঝখানে দুই সারি ল্যাম্প পোস্টের আলো। দূরে থেকে ডঙ্গাই সেতুকে মনে হবে সাগরে ভাসমান একটি ড্রাগন, বললেন গাইড।

দঙ্গাই সেতুর আরেক নাম পূর্ব সাগর সেতু। ছবি: লেখক

এরপর সোজা ঢুকে পড়ি ইয়াংশন গভীর সমুদ্রবন্দর এলাকায়। সে এক এলাহী কারবার। যেদিকে চোখ যায়—মাথা উঁচু করা বিশাল বিশাল গ্যান্ট্রি ক্রেন। নোঙর করা বড় বড় জাহাজ আর হাজার হাজার কনটেইনারের স্তূপ। বিশ্বের ব্যস্ততম ও বৃহত্তম এই গভীর সমুদ্রবন্দরটির বর্ণনা দিতে গেলে আরেকটি ভ্রমণ গল্প হয়ে যাবে। অল্প কথায় বলা যায়, সাংহাই বন্দরের অংশ ইয়াংশন গভীর সমুদ্রবন্দরে ১৫ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারে। গত বছরের ডিসেম্বরে এখানে বিশ্বের বৃহত্তম স্বয়ংক্রিয় কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে সাংহাই বন্দরের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডেলিং ক্ষমতা ৪০ মিলিয়ন টিইইউস অতিক্রম করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে বলে ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম নিউজ বলছে।

ফেরার পথে আরেক মজা। হঠাৎ বৃষ্টির সঙ্গে সামুদ্রিক ঝড়। দুশ্চিন্তা হলো। টাইফুনে পড়লাম নাকি? চীন সাগর টাইফুনপ্রবণ অঞ্চল। প্রায় বয়ে যায় শক্তিশালী টাইফুন। গাইডের আশ্বাসে শঙ্কা কাটল। আরও নিশ্চিন্ত হলাম এটা জেনে যে, সাগরের বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকতে টাইফুন ও উচ্চ তরঙ্গপ্রতিরোধী শক্তি দিয়েই সেতুটি গড়া। ১২ বল শক্তির টাইফুন আর ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে এই সেতু। সামলাতে পারবে টাইফুন বা অন্য কোনো কারণে ধেয়ে আসা বড় জাহাজের ধাক্কাও।

ঝড়ের কারণে সেতুর দুপাশের সাগর ঢেকে যায় ঘন কুয়াশায়। তবে সেতুর পথ মোটামুটি পরিষ্কার। বৃষ্টির ঝাপটা কাটিয়ে সামনে এগোতে তেমন সমস্যা হচ্ছিল না চালকের। হবে কীভাবে? সেতু খুলে দেওয়ার আগে কয়েক মাস চালকদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় ঘন কুয়াশা ও প্রচণ্ড বাতাসের মধ্যে গাড়ি চালানো যায় কি না, জানালেন চালক।

প্রয়োজনে বানানো বলে সেতুতে দর্শনার্থী সমাবেশের তেমন সুযোগ রাখা হয়নি। পথের মাঝে গাড়ি থামানো একেবারেই নিষেধ। তাই রোমাঞ্চকর স্মৃতির স্থিরচিত্র তোলা যায়নি। সন্তুষ্ট থাকতে হলো বাস থেকে তোলা ভিডিওতে।

সেতুর পাশে সাগরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা উইন্ড মিলের সারি। ছবি: লেখক

চালুর পর ৩ বছর ডঙ্গাই ছিল ‘বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসেতু’। ২০০৮ সালে একই উপসাগরে গড়া ৩৬ কিলোমিটারের হ্যাংজহু বে সেতু সেই মর্যাদা কেড়ে নেয়। তবে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। ২০১১ সালে খেতাব দখল করে নেয় ৪২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কিংদাও হাওয়ান সেতু। গিনেস বুকের রেকর্ড অনুযায়ী, জিয়াওঝু উপসাগরের ওপর ৮ লেনের সেতুটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র–সেতু। তবে আগামী জুলাই মাসে চালু হলে ৫৫ কিলোমিটার লম্বা হংকং-ঝুহাই-ম্যাকাউ সেতু গড়বে নতুন রেকর্ড। সেতুতে ব্যবহার করা ৪ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন ইস্পাত দিয়ে নাকি ৬০টি আইফেল টাওয়ার বানানো সম্ভব—এমন তথ্য চীনের সরকারি বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার।

রেকর্ড ভাঙা-গড়ার মধ্যে চীনের প্রথম সমুদ্র–সেতুর মর্যাদাটি কিন্তু দঙ্গাইয়েরই রয়ে গেছে! সৌজন্যে: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *