Skip to content

সেন্টমার্টিনের বিপন্ন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

ফৌজিয়া আহমেদ
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্থানীয়দের কাছে দ্বীপটি নারিকেল জিঞ্জিরা বা জিঞ্জিরা নামে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দক্ষিণাংশের মূল ভূখণ্ড বদর মোকাম থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে দ্বীপটির অবস্থান। দ্বীপটির উপকূলীয় জলরাশিতে রয়েছে প্রবাল ও শৈবালের সুন্দর সমন্বয় যা দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না। দ্বীপটিতে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, স্থলজ গুপ্তবীজি উদ্ভিদ, শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়া, প্রজাপতি, মাছ, উভচর ও সরীসৃপ দেখা যায়। এছাড়া স্থানীয় পাখি, পরিযায়ী পাখিসহ স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে দ্বীপটিতে। আরও রয়েছে চুনাপাথর, জীবাশ্মযুক্ত বেলেপাথর, খোলসযুক্ত চুনাপাথর, বালুচর ও ঝিনুক পাহাড়। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে স্পঞ্জ, পাথরি কাঁকড়া, সন্ন্যাসী কাঁকড়া, শামুক, লবস্টার, ঝিনুক ও সমুদ্র শসা দেখা যায়।

St.Martinসেন্টমার্টিনে রয়েছে প্রবাল প্রাচীর যা গঠিত হয়েছে এক ধরনের প্রাণীর শরীর থেকে। এসব প্রবাল প্রাচীর সামুদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা করে উপকূলবাসীদের। সুনামি কিংবা জলোচ্ছ্বাসের বিপরীতে প্রাকৃতিক দেয়ালের মতো কাজ করে। সেন্টমার্টিনের প্রবাল প্রাচীর আজ হুমকির মুখে। এর প্রধান কারণ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত মানুষের পদচারণা। প্রতি বছর সেন্টমার্টিনে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক আসা-যাওয়া করে। পর্যটকদের থাকার জন্য দ্বীপটিতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮৮টি হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। এসব রিসোর্টের কোনো সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। সেই সঙ্গে দ্বীপটিতে বাড়ছে বসতি স্থাপন। ১৯৭২ সালে যেখানে ১১২টি বসতি ছিল বর্তমানে সেখানে দেড় হাজার পরিবারের প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ বসবাস করছে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোই নেই। ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এছাড়া পর্যটকদের নিয়ে আসা পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি সেন্টমার্টিনকে করে তুলছে আরও দূষিত।

প্রতি বছর প্রজনন ঋতুতে সেন্টমার্টিন সৈকতে ডিম পাড়তে আসা কাছিম জেলেদের জালে আটকে প্রাণ হারায়। এছাড়া রাতেরবেলা হোটেল-মোটেলের আলো এবং পর্যটকদের জ্বালানো আগুনের জন্য সামুদ্রিক কাছিমের ডিম দেয়ার পরিবেশ গত পাঁচ বছরে নষ্ট হয়ে গেছে, যা সামুদ্রিক কাছিমের বংশ বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনও বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রবালসমৃদ্ধ এই দ্বীপটিকে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের পানিও উষ্ণ হয়ে উঠছে যা প্রবাল জমার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া পর্যটকবাহী জাহাজ থেকে নির্গত তেলের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে প্রবাল। স্থানীয় বাসিন্দারা বেআইনিভাবে সাগর থেকে প্রবাল সংগ্রহ করে বিক্রি করছে পর্যটকদের কাছে। পাশাপাশি ছেঁড়াদিয়া দ্বীপে এখনও কিছু প্রবাল-শৈবাল থাকলেও অবাধ আহরণের কারণে শিগগিরই তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উপকূলীয় ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে পরিবেশ অধিদফতর ১৯৯৫ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকত ও সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুসারে সংকটাপন্ন ওই এলাকায় প্রবাল, শামুক, ঝিনুক সংগ্রহ ও বিক্রি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ করা হয়েছে মাছ, কচ্ছপ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয় এমন ধরনের কাজ, পাথুরে ও প্রবাল শিলা আহরণ, যে কোনো নির্মাণ কাজে পাথুরে ও প্রবাল শিলার ব্যবহার। এ আদেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয়দণ্ডে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না।

সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের গর্ব। সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর দূরদর্শিতার অভাবে দ্বীপটি হারাতে বসেছে তার গৌরব। ইকোটুরিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব, তেমনিভাবে পর্যটনশিল্পেরও প্রসার ঘটানো সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন দ্বীপের বাসিন্দা, পর্যটক ও নীতিনির্ধারকদের সচেতনতা। প্রকৃতির এই বিস্ময়কর দানকে আমাদের নিজেদেরই সংরক্ষণ করতে হবে এবং এখনই তার উপযুক্ত সময়।
লেখক : শিক্ষার্থী, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র : যুগান্তর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *