আশীষ-উর-রহমান ও সারোয়ার মোর্শেদ
সাড়ে চার হাজার কলাগাছ আর দুই হাজার বাঁশ জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ৭৫০ ফুট লম্বা, ৩৬ ফুট চওড়া এক ভেলা। সোনাকাদর বিলের পূর্ব পাড়ে ভেলাটি মৃদুমন্দ দুলছে ঢেউয়ের দোলায়। শারদীয় বিকেলের ঝিরঝিরে হাওয়ায় উড়ছে ভেলার চারপাশে বাঁশের খুঁটির মাথায় টাঙানো রঙিন নিশান। নির্মাতাদের দাবি, এই ভেলাটিই দেশে নির্মিত কলাগাছের সর্ববৃহৎ ভেলা।

সাড়ে চার হাজার কলাগাছ আর দুই হাজার বাঁশের তৈরি বিশাল ভেলা। ভাসছে ভাঙ্গুড়া উপজেলার হাটগ্রামের সোনাকাদর বিলের সোনালি সৈকতে।
পাবনা জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গুড়া উপজেলার পার ভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের হাটগ্রাম। গ্রামের শেষ প্রান্ত দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা পথ। পূর্ব দিকে ভরাভাদরে সোনাকাদর বিলের থই থই জলরাশি। দূর দিগন্তে কালচে সবুজ গ্রামের রেখা। মাঝে মাঝে জনবসতিহীন দু-একটি জংলা ভিটে সবুজ দ্বীপের মতো মাথা উঁচু করে আছে। প্রতিবছর বর্ষায় পদ্মা আর সোনাকাদর বিল একাকার হয়ে যায়। যত দূর দৃষ্টি যায় পানি আর পানি। বাতাসের ঝাপটায় বিলের পানিতে ওঠে আলোড়ন। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সড়কের কংক্রিটে বাঁধা পাড়ে। মাথার ওপর নীল আকাশের পটভূমিতে ভেসে যায় শরতের মেঘমালা। এলাকার মানুষ জায়গাটির নাম দিয়েছেন ‘সোনালি সৈকত’। দেশের সর্ববৃহৎ হোক বা না হোক, বৃহৎ এই কলাগাছের ভেলাটি ভাসছে সোনালি সৈকতে।
প্রতিদিন দুপুরের পর থেকেই চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া, পাবনা শহর, এমনকি ঈশ্বরদী থেকেও অনেক লোক এখন এই বিপুল জলরাশির সামনে বসে প্রকৃতির মনোরম শোভা দেখতে আসে। স্বামী-স্ত্রী, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী লোকের সমাগমে সন্ধ্যা অবধি প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই সোনালি সৈকত বেশ জমজমাট হয়ে থাকে। পাড়ে বাঁধা ইঞ্জিনচালিত নৌকার সারি। অনেকে নৌকায় উঠে বিলের ভেতরে চক্কর দেয়। পাবনা শহর ও আশপাশের কয়েক উপজেলার লোকের বিকেল কাটানোর চমৎকার একটি গন্তব্যে পরিণত হয়েছে এই স্থানটি। কেউ কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসেন, কেউ মোটরসাইকেলে। এ ছাড়া সরাসরি ইজিবাইক ও ভটভটি সার্ভিস চালু হয়েছে সোনালি সৈকত পর্যন্ত। অনেক লোক আসে বলে গত বছর সোলার প্যানেলযুক্ত পাঁচটি কংক্রিটের খুঁটি বসিয়ে আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। ইউনিয়ন পরিষদ একটি পাকা ‘ঘাট কাম ছাউনি’ করে দিয়েছে হঠাৎ বৃষ্টি এলে মাথা গোঁজার জন্য। মাঝে মাঝেই টহল দিতে আসে পুলিশ।
পাবনা শহরের রাধানগর থেকে ইজিবাইক ভাড়া করে স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে গত শুক্রবার বিকেলে এসেছিলেন ব্যবসায়ী পাঞ্জাব আলী খান। এখানকার পরিবেশ দেখে মুগ্ধ তিনি। তবে কয়েকটি শৌচাগার করে দেওয়া হলে লোকের সুবিধা হয় বলে মন্তব্য করলেন। ভাঙ্গুড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুল আলমও শুক্রবার সপরিবারে সোনালি সৈকতে এসেছিলেন বেড়াতে। তিনি জানালেন, শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁদেরও বিবেচনায় আছে। গত বছর আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। লোকজন প্রতিবছরই যেমন করে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে বিলের পাড় দিয়ে কংক্রিটের বেঞ্চ তৈরি, শৌচাগার ও অন্তত আরও একটি ছাউনি তৈরির পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে।
সোনালি সৈকতের ঘাটে এদিন বিকেলে পার ভাঙ্গুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমকেও পাওয়া গেল। ১৯ বছর ধরে আছেন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। ভেলার ইতিবৃত্ত শোনালেন তিনি। গত ২০০০ সাল থেকে সড়কটি পাকা হওয়ার পর থেকেই এখানে লোকজন বর্ষা-শরতে বেড়াতে আসছে। কিন্তু সেভাবে কোনো প্রচার নেই। নতুন কিছু একটা করার জন্য তাঁরা গত বছর এলাকার উৎসাহী লোকদের নিয়ে ২০০ কলাগাছের একটি ভেলা বানিয়েছিলেন। বেড়াতে আসা মানুষ খুবই আগ্রহ নিয়ে ভেলায় উঠেছিল। সেটা দেখে এবার তাঁরা আরও বৃহৎ ভেলা নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেন। আশপাশের কয়েক গ্রাম থেকে অধিকাংশ কলাগাছ ও বাঁশ স্বেচ্ছায় দিয়েছে মানুষ।
ভেলার ওপর তৈরি করা হয়েছে একটি হালকা খাবারের দোকান। বসার জন্য পেতে রাখা হয়েছে বেঞ্চ। ইউপি চেয়ারম্যান জানালেন, একসঙ্গে প্রায় চার হাজার লোক উঠতে পরে এই ভেলায়। ভেলাটি ভাসানো হয়েছে গত ২২ জুলাই। বিলের পানির ওপর নির্ভর করে অন্তত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ভেলাটি রাখা যাবে। এ ছাড়া বিনোদনের জন্য প্রতি সোমবার হচ্ছে নৌকাবাইচ। আগামী বৃহস্পতিবার হবে বাইচের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। অংশ নিচ্ছে ১২টি নৌকা।
গ্রামের লোকদের কিছু আয়ের ব্যবস্থাও হয়েছে। প্রায় ৪০টি নৌকা আছে ঘাটে। মাঝি আবদুস সাত্তার জানালেন, প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। গড়ে উঠেছে বেশ কিছু টং দোকান। তবে সোনালি সৈকতটিকে তাঁরা যথেষ্ট যত্ন নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেছেন। আর বেড়াতে আসা লোকেরা যেন কোনো অপ্রিয় পরিস্থিতিতে না পড়ে, সে জন্য কড়া তদারকিও করছেন নিজেরাই। কেবল বৃহৎ একটি ভেলা নির্মাণই নয়, নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের পরিবেশটাও যে সোনালি করে তোলা যায়, সেই দৃষ্টান্তও রেখেছেন সোনাকাদর বিলপারের লোকেরা। সূত্র : প্রথম আলো