Skip to content

সে এক রূপকথারই দেশ

USA

চিত্রা পাল ও জয়ন্ত পাল
আকাশে সাতটি তারা যখন ফুটে উঠেছে আমি এই ঘাসে বসে আছি— নিউ ইয়র্কের হাই লাইন পার্ক, পৃথিবীর কোনও এক পথ!
মরচে ঘষা স্মৃতির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা পুরনো এক রেলওয়ে ট্র্যাককে বিপণনের জন্যে কেমন করে রূপকথায় পরিণত করতে হয় তা বুঝি আমেরিকানরাই জানে। পার্কের গা ঘেঁষে হাডসন নদী। অতি ধীরে বয়ে চলেছে। আমেরিকানদের মতোই শান্ত, স্থির। তার উপরেই ছোট জাহাজ, স্টিমার ঘাঁটি গেড়েছে। কোথাও দূরে বাচ্চাদের নিয়ে অঙ্কন প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কি অপূর্ব এক মায়া যেন!

বছরভর এই মায়ার টানেই ৫০ লাখ দর্শক পার্ক দেখার জন্য ভিড় জমায়।

আমেরিকায় বেড়াতে এসে ফিরে ফিরেই যেন চমক। নিউ ইয়র্ক শহরের রাত। এক সুবেশা মহিলা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘ট্যাক্সি ট্যাক্সি’ বলে ট্যাক্সি থামানোর চেষ্টা করছেন। এক ঝলকে দেখলে মনে হবে, এ তো সেই কলকাতার রাস্তা!

নিউ ইয়র্কের ফুটপাথ ভর্তি ফুড-স্টল, এমনকী, চাইলে রোলও মিলবে। ঘাড়ে করে জিনিস নিয়ে হকারের দল। হঠাৎই তার মধ্যে থেকে সতর্কবাণী আসে— ‘দাদা, ব্যাগ সামলে।’ চমকে যাই, এখানেও বাঙালি! নুরুল, বাড়ি বাংলাদেশ। রুটির জন্য বাহারি টুপি বিক্রি করে বেড়াচ্ছে নিউ ইয়র্কের পথে।

দূর থেকে আমরা ভাবি আমেরিকানরা এক-কেন্দ্রিক। পরিবার নিয়ে তারা ভাবে না। অথচ ওখানে থেকে দেখেছি, ‘গ্র্যান্ড ফাদার্স ডে’ থেকে ‘মাদার্স ডে’— সব উৎসবই আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। আর সেগুলোর কোনওটাই বাঙালির দুর্গাপুজোর চেয়ে কম নয়।

হঠাৎ এক দিন রাস্তা ভর্তি বুড়োবুড়ির দল…কানাঘুষো শোনা গেল, আজ ‘গ্র্যান্ড ফাদার্স ডে’। বুড়োবুড়ির দল রাস্তা জুড়ে, কেউ বা হুইলচেয়ারে। তাঁদের মুখে চকোলেট। গান শুনে, বিয়ার খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিলেন তাঁরা এই দিন। রাস্তা জুড়ে উৎসব, অথচ কোথাও তার চিহ্ন নেই। ইউরোপের শহরগুলোয় রোম, ইতালিতে বিয়ারের বোতল, চকোলেটের মোড়ক ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু আমেরিকার রাস্তা ঝাঁ চকচকে। সিগারেটের ছাইও যেন সেই মাটিতে পড়তে লজ্জা পায়।

আমেরিকানরা চিহ্ন রাখে না। ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির ইমারত তৈরি করে। আজকের টুইন টাওয়ার দেখলে বোঝা যায় প্রযুক্তির দেওয়ালে কী ভাবে এরা স্মৃতির ঐশ্বর্য নির্মাণ করেছে। সন্ধ্যা নামলেই টুইন টাওয়ারের মোহময় আলো, লেক ঝর্নার জলকেলি দেখে মনে হয় যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ!

USA2

বেলিংহ্যাম বে-তে নয়নাভিরাম এলিজা আইল্যান্ড।

আজও আছে সেই ৯/১১-র ধ্বংসে পুড়ে যাওয়া গাছের ভিত…সে আজও একা সারারাত জাগে!

আমেরিকায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বড়ই দুর্বল। গাড়ি না থাকলে ঘরবন্দি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তবে শহরগুলোর শরীর জুড়ে রেলপথ। যেমন নিউ ইয়র্ক আর নিউ জার্সিকে জুড়ে দিয়েছে এক অভিনব রেলপথ। হঠাৎই মনে হয়, আচ্ছা, আমাদের কলকাতা-হাওড়া গঙ্গানদীর বুক চিরে যদি পাতালরেলে কখনও জুড়ে যেত! নিউ জার্সি থেকে স্টিমারে দিব্যি ‘এলিজা আইল্যান্ডে’ পৌঁছে যাওয়া যেত। ইতিহাসের দেখা মেলে ওই নীরব দ্বীপে। ইমিগ্রেন্টরা জাহাজে আমেরিকা এলে এখানেই আগে নামত। ওখানকার মিউজিয়ামে আজও ইতিহাস কথা বলে চলেছে।

আমেরিকানদের কোথাও কোনও তাড়া নেই, ভিড় নেই। সরকারি অনুদানের জল, ইলেকট্রিসিটি, খাবার, বাড়ি— কোনও কিছুরই অভাবই নেই তাদের। এই সুবিধার জন্য ভারাক্রান্ত হয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে হয় না তাদের। হিসেব করে দেখা গেছে, আমেরিকানরা অফিসে আট ঘণ্টা থাকলেও তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি কাজ করে না। মোদ্দা কথা, ভারতীয়রা যে কাজ একা করতে পারে আমেরিকানরা সে কাজ পাঁচ জন মিলে করে। তবে অনেক সময় এরা একা হয়ে যায়, হতাশায় ভোগে। এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাওয়ার খরচ এতটাই বেশি যে সাধারণ মানুষ আমাদের মতো আজ দিল্লি, কাল মুম্বই করতে পারে না।

নিজের সীমিত গণ্ডির মাঝেই এরা আনন্দটা নিয়ে নিতে জানে। দেখেছি, খেয়াল হল তো ছ’মাসের বাচ্চা নিয়েই বাবা-মা পার্কে সারা দিন কাটিয়ে তাঁবুর মধ্যে আরামে রাত কাটাচ্ছে। অথবা গাড়ির মধ্যেই রান্নার যাবতীয় রসদ নিয়ে রাত কাটিয়ে পরের দিন বাড়ি ফিরছে। আমেরিকায় অজস্র মানুষ গৃহহারা। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গরা ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের পথে পথে। এ-ও দেখেছি, রাস্তায় পাঁচ ডলার পড়ে আছে। লোকে নিজের ভেবে তুলে তো নিচ্ছেই না। বরং বেশির ভাগ পথচলতি মানুষ একে অপরকে দেখে জানতে চাইছেন, এই টাকাটা তাঁর কি না।

USA3

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর গ্রাউন্ড জিরো এখন যেমন।

প্রকৃতিও নিজেকে ঢেলে সাজিয়েছে এই দেশে। জানলার ফাঁক দিয়ে রোদের সোনালি আলো ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবি, এই এত্ত বড় নীল আকাশ আমি কি আগে দেখেছি? আমার দেশে কখনও এমন কেন মনে হয়নি? ওখানেই দেখেছি পাতার রং বদল…মরচে খয়েরি, কমলা বা গাঢ় সবুজ। তুলির টানে থেকে থেকেই ক্যানভাসের রং বদল হয়!তবে আমেরিকায় যা কিছু দেখার, যা কিছু জানার সবই ‘ফেল কড়ি মাখো তেল’-এর ফাঁদে। লস এঞ্জেলসে ফিল্ম স্টুডিও দেখতে লাগে ৮০ ডলার। আসলে জীবনযাত্রা থেকে বিপণন, সবেতেই খুব ডিসিপ্লিনড এখানকার মানুষ। বাড়িতে যিনি সুইপার তিনিও একটা নির্দিষ্ট পোশাকে হাজির হন। রাস্তায় দেখেছি, গ্ল্যামারাস তরুণী শর্টস আর স্নিকার্স পরে সাইকেল চালাচ্ছে। হাতে তার স্টিলেটো। সে হয়তো কোনও পার্টিতেই যাচ্ছে। পার্টিতে তো আর স্নিকার্স চলে না। তাই পার্টিতে ঢোকার সময়ে স্টিলেটো পরে নেবে। আমরা ভুলে গেলেও আমেরিকার রাস্তায় সাইকেল চালানোর চল খুব। এটা দেখতে খুব ভাল লাগে।

কবে কার এক নামহারা পাখি জানলার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে। মনে হয় আর পৃথিবী নেই! সৌজন্যে : আনন্দবাজার পত্রিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *