সাজেদুল ইসলাম শুভ্র
ফেলুদার হাত ধরে শৈশবে সোনার কেল্লার সন্ধান করতে নেমেছিলাম! জাতিস্মর মুকুলের মতো আমাকেও আশ্চর্য্য এক মোহে পেয়ে বসেছিল জাদুকরি সেই কেল্লা। দীর্ঘ ভারত সফর হবে আর প্রিয় সোনার কেল্লা নিজের চোখে দেখবো না, তা তো হয় না। সত্যি বলতে আমিও তোপসের মতো নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, সোনার কেল্লা সোনা দিয়ে তৈরি নয় তো? যাই হোক, আহমেদাবাদ ছিলাম আমরা। রাতে যোধপুর গিয়ে খানিক বিরতি দিয়ে উঠবো জয়সালমীরের ট্রেনে। রাত আটটা নাগাদ যোধপুর পৌঁছালাম। বাংলাদেশের আর সব জেলা শহরের মতো। সেখানের রাস্তায় বাহারি সব খাবারের পসরা, আমাদের ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় যেগুলো চড়া দামে বিক্রি হয়, সেগুলোই সেখানে দিব্যি দশ-পনের রূপিতে মিলছে। পেটপুরে খেয়ে আমরা স্টেশনে এসে হাজির এগারটার মধ্যে, একটু পরেই ট্রেন। বন্ধুদের সতেরজনের দল, গাইড কাজল দা সাথে আছেন। ডেকে সতর্ক করে দিলেন, পৌঁছাতে ভোর হবে, শীতের কাপড় যেন ভালোমতো পেঁচিয়ে নিই।
জয়সালমীর এক্সপ্রেস এলো কিছুটা দেরিতে। সতেরজনের সিট ঠিকঠাক করে আমরা যখন চাদর পেতে কার্ড খেলতে বসেছি তখন কাজলদার সতর্কবাণী টের পেতে শুরু করলাম। মরুভূমির মাঝ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে, হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। শীতের কাপড় গায়ে চাপিয়ে যবুথবু হয়ে সব বসে রইলাম। আমার খুব মনে পড়ছিল সোনার কেল্লার সেই দৃশ্য, তোপসেকে ফেলুদা ট্রেনের দরজায় ডেকে কেল্লা দেখাচ্ছেন। তীব্র শীতের মধ্যে আমিও উঠে দরজার কাছে যাই, ভোরের আলো আর দেখা যায় না। আশঙ্কা ঢুকে যায়, কুয়াশাতে এই দৃশ্য মিস করে যাবো না তো! আল্লাহ মনের ইচ্ছেতে সায় দিলেন, ট্রেনের হুইসেল শুনেই বুঝলাম স্টেশন আসন্ন। দরজা ধরে এগিয়ে যেতেই চোখে এসে লাগলো ভোরের আলো, এর মাঝেই দূর থেকে ওই তো উঁচুতে ঠাই দাঁড়িয়ে সোনার কেল্লা!
ছোট্ট খেলাঘরের মতো এক স্টেশনে এসে দাঁড়ালো আমাদের ট্রেন। ইংরেজি অক্ষরে লেখা জয়সালমীর। তখনকার অনুভূতি সত্যিই লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা স্টেশনে দাঁড়িয়েই গ্রুপ ফটো পর্ব সেরে ফেললাম। ভারতের স্টেশনগুলো সাদামাটা, কিন্তু দারুণ। জয়সালমীরের স্টেশনটা ছোট্ট, কিন্তু সেই সোনালি পাথরে গড়া, খোদাই করে নকশা করা। মনে হলো সোনার কেল্লারই একটা অংশে এসে নামলাম, সে পরম আতিথেয়তায় বরণ করে নিলো। তেমনটা দেখেছিলাম অমৃতসরে, নামতেই স্টেশনে ওই এলাকার সেই বিখ্যাত স্বর্ণ মন্দিরের মডেল বানিয়ে রাখা, আপনা-আপনিই ভালো হয়ে যায় মন।
দুই জীপে লাগেজ চেপে উঠে বসি আমরা। হিন্দিতে খুব দখল নেই বলে ভারতে গিয়ে আমি রীতিমতো বোবা বনে গেছি, ড্রাইভারদের সাথেও তাই আর কথা বলি না। কিন্তু এ যাত্রায় বন্ধুদের মাধ্যমে জিজ্ঞেস করলাম, সোনার কেল্লা কই? তিনি জানালেন পথে যেতেই পড়বে। সেই তখন আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, আমি চলচ্চিত্রটা দেখেছি কি-না। সায় দিতেই বললেন, মুকুল এসেছিল ক’দিন আগে, অনেক বড় হয়ে গেছে, তবু ছেলেটার লাজুক ভাবটা আছে। তিনি তার গাড়ি করেই ঘুরিয়েছেন সত্যজিতের সেই মুকুলকে। কথা বলতে বলতেই কেল্লা চলে এলো। কাজল দা জানালেন, আমরা সকালের নাস্তাটা করে এখানে আসবো। হোটলে পৌঁছে নাস্তা ওখানেই সেরে নিলাম। ছোট্ট দু’তলা হোটেল, সব একইরকম সোনালি পাথরের তৈরি বাড়ি।
ঠিক কেল্লার সামনে এসে আমাদের জীপ থামলো। এ রকম আরও নাকি কয়েকটা বিশাল বিশাল দরজা আছে। ঢুকতেই কেল্লার ভেতরে চলে গেছে ঢালু পথ। বোঝাই যাচ্ছে এ পথে গাড়ি নিয়েও রাজ-রাজড়ারা চলাফেরা করতেন। একজন গাইড নিলাম আমরা, দিব্যি মুখস্থ বলে গেলেন এখানের ইতিহাস। এখন থেকে ৯০০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১১৫৬ সালের দিকে গড়ে ওঠে এই কেল্লাটি। রাজপুত রাও জয়সাল এই ত্রিকূট পাহাড়ে গড়ে তোলেন তার সাম্রাজ্য। তখন থেকেই বংশ পরম্পরায় এখানে বাস করছেন রাজপুতরা, আর আছে স্থানীয় অধিবাসী। কেল্লার অভ্যন্তরে মানুষের নিত্যদিনের গৃহস্থলি চলছে এখানে। সওদাগররা বসেছেন মনোহরি মালপত্তর নিয়ে। এটা-সেটা দেখতে দেখতে আমরা চলছি রাজমহলের দিকে। এই সাম্রাজ্যের রাজাধীরাজরা একসময় এখানেই থাকতেন। রাজবাড়ির উঠোনে এসে বজরং শোনায় দুঃখ জাগানিয়া এক কাহিনি। ‘১৩০০ শতাব্দিতে এই কেল্লা আক্রমণ করেছিলেন আলাউদ্দীন খলজী। কেল্লার তিন স্তর বিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ভেঙে শত্রুরা ঢুকে পড়ে কেল্লায়। বীর রাজপুতদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে এই সোনার পুরী। রাজমহলও আক্রান্ত হয়েছিল। তখন পুরনারীরা বেছে নেন স্বেচ্ছা মৃত্যু। শত্রুদের হাতে অপমানিত হওয়ার আগেই রাজনারীরা একসঙ্গে আত্মহত্যা করেন। নয় বছর পরে কেল্লা আবারও রাজপুতদের হস্তগত হয়। ২০০ বছর পরে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের দ্বারাও আরেক বার আক্রান্ত হয়েছিল এই কেল্লা। তার পরের ইতিহাসের দিকে আর এগুতে মন চাইলো না। হেঁটে হেঁটে দেখলাম ভেতরটা। কী আশ্চর্য্য কারুকাজ করা পুরোটা। ভেতরে একটা মন্দিরও আছে, সেটাও ঘুরে দেখা হলো। উটের চামড়ার সুন্দর সুন্দর সব ব্যাগ, বেল্ট, ক্যাপ। পরদিন আমাদের ট্রেন দুপুরে, ঠিক করে ফেলেছি সকালটা এখানেই থাকবো, কাজেই আজ শুধু ঘুরেই দেখলাম। এই কেল্লার সুউঁচ্চ এক টাওয়ার থেকে পুরো জয়সালমীর শহর দেখা যায় চোখ মেলে। একই বর্ণে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। সূর্যের আলো যখন পড়ে সোনার মতো চকচক করে ওঠে। মুকুল ঠিকই বলেছিল, সোনার কেল্লা! মুকুলের কথা মনে পড়তেই গাইডকে ধরলাম সোনার কেল্লার শুটিং-এর জায়গাগুলো দেখবো। তিনি আমাদের ঘুরে দেখালেন। সত্যজিত্ রায় কোথায় দাঁড়িয়ে ডিরেকশন দিতেন, সেগুলোও তারা দেখাতে দেখাতে মুখস্থ করে ফেলেছেন। ডাক পড়লো, বের হতে হবে। বিকেলে আমরা মরুভূমিতে সূর্যাস্ত দেখবো, পরে যোগ দেবো ডেজার্ট সাফারিতে। স্থানীয় নাচ-গানের জমকালো এক আসর বসে সন্ধ্যায়।
দুপুরে খেয়েই আমরা রওনা হলাম জীপ নিয়ে। আস্তে আস্তে ঘরবাড়ি সব দূরে সরে যাচ্ছে, ধূ ধূ মরুভূমি শুধু। এ রকমই কোনো এক জায়গাতে হটাত্ বৃষ্টির সোনালি প্রান্তরে শুটিং হয়েছে বোঝা যায়। সূর্যকে পেছনে রেখে বেশকিছু ছবিও তোলা হলো। উষ্ণ মরুর বুকে শীতের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আমাদের শীতের কাপড় গায়ে চেপে নিতে হলো। সূর্যাস্তের দৃশ্যটা এখানে সমুদ্রের পাড়ে বসে দেখার চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়। আমার ধারণা এখানে আরও দ্রুত বুঝি প্রকৃতির রং বদলে যায়। গাইড কাজল দা এসে জানালেন, নাচ-গানের অনুষ্ঠান শুরু হবে কিছুক্ষণ পরেই, আমরা সূর্যাস্তের পরপরই যেন রওনা দিয়ে মেইন রোডে চলে আসি। পরদিন দুপুরেই আমাদের জয়পুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। সকালেই গেলাম গাড়িসার লেকে। এতক্ষণ তো চিন্তাই করিনি, এখানে লেক বা পানির সংস্থান কীভাবে হতো? কাজল দা বলছিলেন, এখানে চাইলেই দুধ পাওয়া যেত, তবে পানি না! এখন না হয় প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক কিছু সম্ভব। জানা গেল, গাড়িসার লেকই সেই লেক, স্থানীয় রাজা অনেক আগে খনন করেছিলেন। জাদুকরীভাবে এই পানি দিয়েই তখন স্থানীয়দের মিটে যেত সব চাহিদা। পাড়টাও বাঁধানো দারুণ করে। অনেক শুটিং হয়েছে এখানে চলচ্চিত্রের। এরপর অবশ্য কেনাকাটা আর ঘোরাঘুরির জন্য উন্মুক্ত সময় ছিল। আমি সুযোগ পেয়ে আরেক দফা সোনার কেল্লায় যাই। একা একা ঘুরে দেখেছি কী আশ্চর্য কারুকাজ করে করা প্রতিটি ইঞ্চি। এত বছর আগে, কত আন্তরিকতা নিয়েই তারা এ কাজ করেছেন। মাঝের দোকানগুলো থেকে দর-দাম করে কিনলে কমেই কেনা যায় বেশ ভালো এবং দুর্লভ জিনিস। আমার সম্বল একটাই হিন্দি শব্দ—‘কিত্না?’। তা দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি, দাম যা বলে, নেমে আসি নিউমার্কেটের মতো। তারাও কম যান না, দিব্যি জমে ওঠে। মাঝে হিন্দিতে অনেক কিছুই বলেন, তা আর বুঝি না! দুপুরের দিকে রওনা দিলাম আমরা জয়সালমীর থেকে। এটাই শুরুর স্টেশন, কাজেই ঝক্কি নেই, আরাম করে উঠে বসে সিট নিলাম জানালার ধারে। যাক, সেবার রাত হলেও এবার দিনের আলোতে উপভোগ হবে মরুর মধ্য দিয়ে ট্রেন যাত্রা। যথা সময়েই যাত্রা শুরু, কেন জানি ট্রেন ছেড়ে আসার সময় দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম, চোখ পড়ে সোনার কেল্লাতে! কেন জানি মনে হতে লাগলো, আমি আবার আসবো এখানে, মন খারাপের কিছু নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে যায় ছেলেবেলার সেই জাদুকরি সোনার কেল্লা। জয়সালমীরের ৩৬ ঘণ্টার প্রতি মুহূর্তগুলো এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। উষ্ণ মরুর বুকে প্রকৃতির সে-কি লীলা! সূত্র : ইত্তেফাক