উত্তম কুমার হাওলাদার
প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি পর্যটনের অমিত সম্ভাবনাময় সোনারচর। পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলার দক্ষিণ সীমানায় বঙ্গোপসাগরের একেবারে কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। এখানে সবুজ প্রকৃতি, বণ্যপ্রাণী, পাখির ঝাঁক, জেলেদের উত্চ্ছ্বাস আর সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি মিলে নয়াভিরাম এক সৌন্দর্যের জগত্ সৃষ্টি হয়েছে। সাগরে যখন জোয়ারের পানি উতলে ওঠে তখন অনন্য এক সৌন্দর্য বিকশিত হয় সোনারচরে। তটরেখায় আছড়ে পড়ে ছোট-বড় ঢেউ। প্রায় ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের যে কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রয়েছে সুযোগ। ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকা জেলে নৌকার বহর, সাগরে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। বিশেষ করে প্রকৃতি প্রেমিদের কাছে এর আবেদন অন্য রকমের।
সোনারচর নামের উৎপত্তি
সোনারচরে সোনা নেই, আছে সোনারঙের বালি। সকাল কিংবা শেষ বিকালের রোদে আলো যখন সোনারচরে বেলাভূমিতে পড়ে, তখন দ্বীপটাকে সোনালি রঙের থালার মতো মনে হয়। বালুর ওপর সূর্যের আলোয় চোখের দৃষ্টি চিক চিক করে ওঠে। ধারণা করা হয় বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই দ্বীপটির নাম রাখা হয়েছে সোনারচর। আবার কারও কারও মতে, এক সময়ে দ্বীপটিতে প্রচুর সোনালি ধান জন্মাতো, সে কারণেই এর নাম সোনারচর।
কীভাবে যাবেন
সোনারচরে বিভিন্ন পথে যাওয়া যায়। তবে সরাসরি সড়ক কিংবা নৌপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি। ঢাকা থেকে আছে বাস ও লঞ্চের ব্যবস্থা। পটুয়াখালী থেকে গলাচিপা হয়ে আগুনমুখা মোহনা, ডিগ্রি, বুড়াগৌরাঙ্গ ও দাঁড়ছিড়া নদী পাড়ি দিয়ে দুই পাশে ঘন ম্যানগ্রোভ গাছের বাগান। ট্রলার ও লঞ্চযোগে আগুনমুখার মোহনা থেকে ঘণ্টা দুয়েক এগুলেই চোখে পড়বে মায়াবী দ্বীপ-চরতাপসী। তাপসীর বাঁকে পৌঁছাতেই সোনারচরের হাতছানি। তাপসী থেকে ৩০ মিনিটের পথ দক্ষিণে এগুলেই সোনারচর। গলাচিপা লঞ্চঘাট থেকে স্পিডবোটে সোনারচর যেতে লাগে মাত্র দেড় ঘণ্টা। আবার কুয়াকাটা থেকেও সোনারচরে যাওয়া যায় সমুদ্রপথে ইঞ্জিলচালিত ট্রলার দিয়ে। সময় লাগবে ঘণ্টা তিনেক। এ ছাড়া স্থানীয় ট্যুর অপারেটর টুরিস্ট গাইড বিডি কলাপাড়ায় যোগাযোগ করতে পারেন।
সূর্যদয়-সূর্যাস্ত অবলোকন
সোনারচরে রয়েছে প্রায় ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের দৈর্ঘ্য বিশাল সমুদ্র সৈকত। সৈকতের যে কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত দেখার রয়েছে সুযোগ। এখানে রয়েছে পাঁচ হাজার বিশাল বনভূমি। সম্ভাবত সুন্দরবনের পরেই আয়তনের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সোনারচর বিশাল বনভূমির মধ্যে ছড়িয়ে আছে দেড় শতাধিক ছোট-বড় খাল। ছোট্ট নৌকা বা ইঞ্জিলচালিত ট্রলার নিয়ে এসব খালে ভেসে ভেসে দেখা যায় বিচিত্র সব পাখ-পাখালির বিচরণ। প্রচুরসংখ্যক হরিণ আর বানর রয়েছে সোনারচরে। বনাঞ্চলের কাছাকাছি গেলে হয়তো সহজেই চোখে পড়বে বন্য গরু ও মোষ।
এখানে রয়েছে শূকর, বানর, মেছো-বাঘসহ আরও বিচিত্র সব বন্যপ্রাণী। আর শীতের এই সময়ে তো সোনারচর পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে থাকে সারাক্ষণ। এ সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয় পুরো দ্বীপ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। সোনারচর বনাঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ম্যানগ্রোভের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের গাছপালার বাগান সৃজন করা হয়েছে।
শীত-শুকনো মৌসুমে এখানে গেলে হাজারো জেলের শুঁটকি পল্লীও ঘুরে দেখা যাবে। দেখা যাবে লাল কাঁকড়ার নৃত্য, সৈকতজুড়ে যেন লাল চাদর বিছিয়ে রেখেছে। মোটকথা, একদিকে দূর আকাশ বিস্তীর্ণ সাগর এবং বনাঞ্চল। দুটিরই স্বাদ মিলবে সোনারচরে। সেই সঙ্গে বন্যপ্রাণী আর পাখির কলরবে প্রকৃতির সৌন্দর্যপিপাসুরা সোনারচরের রূপে মুগ্ধ হবেন। ট্যুর অপারেটর, টুরিস্ট গাইড বিডির সিইও এস এম মাকসুদুল ইসলাম (মাসুম) জানান, অনিন্দ্যসুন্দর এই সোনারচর পর্যটন খাত অপার সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার। এখানে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নের উদ্যোগ নিলে ভ্রমণপিয়াসী দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটবে। সচল হবে অর্থনীতির চাকা।
কোথায় থাকবেন
সোনারচরে রাত কাটানোর মতো নিরাপদ আরামদায়ক কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে প্রশাসনের উদ্যোগে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ছোট্ট তিন কক্ষের একটি বাংলো। ইচ্ছা করলে রাতে সেখানে থাকতে পারেন। এ ছাড়া রয়েছে বন বিভাগের ক্যাম্প, সেখানে কিছুটা কষ্ট হলেও রয়েছে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। চাইলে ইঞ্জিলচালিত নৌকা বা ট্রলারে ৩০ মিনিটে চলে যেতে পারেন চরমোন্তাজে। সেখানে রয়েছে বন বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা স্যাপ বাংলাদেশ ও মহিলা উন্নয়ন সমিতির ব্যবস্থাপনায় রাত যাপনের মতো মোটামুটি সুবিধাসম্পন্ন বাংলো। রয়েছে হোটেল। চরমোন্তাজে রাত কাটিয়ে সোনারচরের পাশেই মৌডুবী, জাহাজমারা, তুফানিয়া ও শিপচরসহ আরও কয়েকটি দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন