সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ৭ মার্চ বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রবাণী শুনিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা জাদুঘর হয়েছে এ উদ্যানে। গত ২৬ মার্চ জাদুঘরটি যাত্রা শুরু করে। জাদুঘরসহ পুরো কমপ্লেক্সের স্থপতিদের একজন মেরিনা তাবাশ্যুম। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আতিফ আতাউর। ছবি তুলেছেন শেখ হাসান ও নাভিদ ইশতিয়াক তরু
১৯৯৭ সালে পাবলিক ওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট (পিডাব্লিউডি) স্বাধীনতা জাদুঘর ও স্বাধীনতা স্তম্ভ কমপ্লেক্স তৈরির একটি নকশা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। অনেক স্থপতি তাতে অংশ নেন। আরবানার মেরিনা তাবাশ্যুম ও কাশেফ মাহবুব চৌধুরীও নকশা জমা দিয়েছিলেন। তখন তাঁরা তরুণ। সদ্য বুয়েট থেকে বেরিয়েছেন। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় মেরিনা-কাশেফের নকশা। তারপর ১৯৯৮ সালে পিডাব্লিউডি স্বাধীনতা জাদুঘর স্তম্ভ নির্মাণের জন্য কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগপত্র দেয় আরবানাকে।
বাস্তবায়ন ভাবনা
ইট-কাঠে দেশের স্বাধীনতা রূপায়ণ সহজ ব্যাপার না। তবে খুশি ছিলেন তরুণ স্থপতিরা। তাঁরা সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে নকশা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করতে থাকেন। স্বাধীনতা স্তম্ভ মানে দেশের প্রতীক—মানে যুগ যুগ ধরে আলো ছড়ানো। বলছিলেন মেরিনা, ‘সে কারণে আমরা আমাদের সততার জায়গাটিতে কোনো রকম ছাড় দিইনি। নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম। এ রকম খোলা জায়গায় একটি স্থাপনা কেমন হয়, তার নমুনা খুঁজতে গিয়ে সংসদ ভবন পেয়ে যাই। ওই ভবনের স্থাপত্যশৈলী ছিল আমাদের প্রেরণা। আমরা চেয়েছিলাম স্তম্ভটি যেন সব সময়কে ধারণ করতে পারে। অতীত গৌরবকে যেমন, ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষাকেও তেমন। সংসদ ভবন কিন্তু তেমনই নমুনা। এর ডিজাইনে টাইমলেসনেস আছে। এতই আধুনিক যে মনে হয় সব সময়ের।’
১৯৯৮ সালে শুরু হয় স্বাধীনতা কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ। নির্দিষ্ট সময়ের ছাপ যেন না লেগে যায় তাই কংক্রিটকেই প্রধান উপকরণ বেছে নিলেন মেরিনা-কাশেফ। মেরিনা বলেন, প্লাজার ওপরের টাওয়ারটা আনন্দ-উল্লাসের প্রতীক। জাদুঘর কিন্তু টাওয়ারের নিচেই। দুটির মধ্যে আমরা সংযোগ তৈরির চেষ্টা করেছি। আমরা সব সময় খেয়াল রেখেছি, স্থাপনাটি যেন উদ্যানটির সৌন্দর্য নষ্ট না করে। উদ্যানের সৌন্দর্য যেন অক্ষুণ্ন থাকে। স্থপতিরা এ ধরনটিকে বলেন, নন-বিল্ডিং অ্যাপ্রোচ।
অনুপ্রেরণা
‘স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আমাদের অন্যতম অনুপ্রেরণা। প্রকল্পটি নিয়ে মাজহার স্যারের অনেক আগ্রহ ছিল। দেশের জন্য তাঁর অনেক মায়া ছিল। সব সময় বলতেন, দেশের জন্য কিছু করা দরকার, দেশটাকে গোছানো দরকার। তিনি আমার দেখা একজন খাঁটি বাঙালি। এ ছাড়া সংসদ ভবন অনেক প্রেরণার উৎস। সে কথা আগেও বলেছি,’ বলছিলেন মেরিনা।
কাজের জন্য পুরো পার্ক
স্বাধীনতা কমপ্লেক্স করার জন্য মেরিনা ও কাশেফের হাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুরো ৬৭ একর জায়গা তুলে দেওয়া হয়। একটি লাইব্রেরি ও একটি গবেষণাগার করার কথাও ভাবা হয়েছিল। সেটি অবশ্য পরে হয়নি। বললেন, ‘কাজের জন্য পুরো পার্কটি আমাদের দেওয়া হলেও আমি মনে করি, এখন যেটুকু জায়গায় কমপ্লেক্সটি করা হয়েছে সেটা যথেষ্ট। আমরা মনে রেখেছিলাম, এটি শুধু পার্ক নয়, একটি ঐতিহাসিক স্থান।’ মিউজিয়াম মাটির নিচে করার পরিকল্পনাও সে কারণে। বলছিলেন, ‘মানুষের ঘুরে বেড়ানোর জায়গা এটি। এখানে এসে সবাই বসবে, গল্প করবে। সে জন্য প্লাজার মতো করেছি। প্রকল্পে এর স্থায়িত্ব ধরা হয়েছে ১০০ বছর। আমরা সে কথাও মনে রেখেছি। আশা করি, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এটি শত বছরের বেশি টিকে থাকবে।’ জাদুঘরের ভেতরের স্ট্রাকচার স্টিলের তৈরি। চীনা বিশেষজ্ঞদের সফরকালে এতে চীনা স্টিল ও গ্লাস স্তম্ভ ব্যবহার করার বিষয়টি অনুমোদন পায়। কিছু স্টিলসামগ্রী জার্মানি থেকেও আনা হয়েছে। জানালেন মেরিনা।
প্লাজা সবিস্তার
প্লাজার দুদিকে ‘ওয়াটারবডি’ রাখার বিষয়টিও সুচিন্তিত। ওই দুই দিক দিয়ে চাইলে কেউ বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠে যেতে পারবে না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে দূর থেকে দেখতে পাবে স্বাধীনতা টাওয়ার। ৭ মার্চের স্মৃতিফলক পেরিয়ে যাওয়ার পর পাবে একটি গোলাকার ফোয়ারা। ফোয়ারার তলদেশে আছে একটি গর্ত, যা দিয়ে পানি যাচ্ছে অন্ধকার গর্তে। এ যেন নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের সে ভয়াবহ দিনগুলো। তবে তখন যে মানুষ আশায় বেঁধেছিল বুক, তার প্রতীক হিসেবে আছে একটি দেয়াল। এ দেয়ালের মাঝখানের প্রবেশপথ দিয়ে নিচে গেলেই জাদুঘর। সেখানে আছে বাঙালির লড়াইয়ের কথা আর বিজয়গাথা।
জাদুঘরের ভেতরে ছোট্ট একটি গোলাকার জায়গায় ওপর থেকে পানি পড়তে দেখা যায়। এই পানি ওই ওপর থেকেই পড়ছে। এখানে এসে পানিটা আত্মত্যাগের নমুনা হয়ে উঠেছে। জাদুঘর দেখা শেষ করে বেরোনোর পথ গিয়ে ঠেকেছে স্বাধীনতা টাওয়ারে। এ ছাড়া জাদুঘরের ভেতরের আলোকসজ্জা নিয়েও ভেবেছেন স্থপতিরা। ভেবেছেন, ছবিগুলো কোন মাপের হবে? ছবিগুলো যে গ্লাসের ফ্রেমে থাকবে, তাও আগে থেকে ভাবনায় ছিল। মিউজিয়ামের দেয়ালে ছবি না রাখার চিন্তাটিও সুচিন্তিত।
জাদুঘরের তিন অংশ
স্বাধীনতা জাদুঘরের তিনটি অংশ। প্রথম অংশে আছে বাংলা ভাষার উত্পত্তি, বাংলার উত্পত্তি ও স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন সময়কার আন্দোলন। এটি শেষ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ছবি দিয়ে।
দ্বিতীয় অংশটি একটি অন্ধকার কুঠুরি। সেখানে একাত্তরের ভয়াবহ দিনগুলোর ছবি—নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদি। এই কুঠুরির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কালো অধ্যায়’। এর বাঁ দিকেই আছে পানির জায়গাটি।
তৃতীয় অংশটি লড়াই-সংগ্রাম ও বিজয়ের—মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অপারেশন, আন্তর্জাতিক সাড়া ইত্যাদি। এটি শেষ হয়েছে বাঙালির বিজয় অর্জনের ছবির মধ্য দিয়ে।
একসঙ্গে অনেক বেশি মানুষ নয়
মেরিনা চান, স্বাধীনতাকে মানুষ অন্তরে ধারণ করুক। স্বাধীনতা দেখার চেয়েও বেশি অনুভব করার বিষয়। তাই একবারে অনেক লোক ভিড় না করুক জাদুঘরের ভেতরে; বরং সময় নিয়ে সবাই ভালো করে দেখুক। বলছিলেন, ‘আমরা হিসাব করেছি ২০ মিনিটে ৫০ জন মানুষ থাকুক জাদুঘরে। প্রতিজন নিজের মতো করে সঙ্গী করুক স্বাধীনতাকে। এটি আসলে মিউজিয়াম অব ফিলিং। সাধারণত জাদুঘরে থাকে বিভিন্ন ডকুমেন্ট। এখানে সে রকম কিছু নেই; বরং রাখা হয়েছে অনুভব। আমরা সে চেষ্টাই করেছি।’
গেছে ষোল বছর
পুরো কমপ্লেক্সের কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে ১৬ বছর। মাঝে অনেক বিপত্তি গেছে। তবে ১৬ বছরেও সবটা শেষ হয়নি। মাঠটি গোছানোর কাজ বাকি রয়ে গেছে। জিয়া শিশু পার্কটিকেও সাজানোর পরিকল্পনা রাখা হয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে। পুলিশ কন্ট্রোল রুম, শাহবাগ থানা, শিশু পার্কসহ পুরো পার্কটিকে নিয়ে আরো পরিকল্পনা আছে। থাকবে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, পাঠাগার ও উন্মুক্ত থিয়েটার। চেষ্টা হচ্ছে, পার্কটিকে ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার, যা সব সময় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে।
মেরিনা তাবাশ্যুম
স্বাধীনতা জাদুঘর এবং স্বাধীনতা স্তম্ভ কমপ্লেক্সের স্থপতি। জন্ম ঢাকায়, ১৯৬৮ সালে। তিন বোন ও এক ভাইয়ের সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে উঠেছেন। হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি করেছেন। স্থাপত্য বিষয়ে পড়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। পড়াশোনায় আন্তরিক ছিলেন। পরীক্ষায়ও ভালো ফল পেয়েছেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ১৯৯৫ সালে তিনি এবং স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী মিলে গড়ে তোলেন ‘আরবানা’। স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং স্বাধীনতা জাদুঘর কমপ্লেক্স তৈরির নকশা আরবানার পক্ষ থেকে দুজনে মিলেই করেছেন। ২০০৪ সালে ‘অনন্যা শীর্ষ দশ’ সম্মাননা লাভ করেন মেরিনা। ২০০৫ সালে গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান মেরিনা তাবাশ্যুম আর্কিটেক্টস। ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করছেন তিনি । কাজ করছেন বেঙ্গল ইনস্টিটিউটে অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর হিসেবে। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ