Skip to content

সৌরশক্তিচালিত উড়োজাহাজের বিশ্বভ্রমণ

Planeরাইট ভাইয়েরা উড়োজাহাজ তৈরি করার পর শত বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। মানুষ চাঁদে গেছে, কিছু দিনের মধ্যে মঙ্গলে যাবে। আমাদের জীবদ্দশাতেই হয়তো সেটা দেখে যেতে পারব। বিজ্ঞানের কল্যাণে আমাদের দৃষ্টি এই সৌরমণ্ডল ও গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে মহাশূন্যের গভীর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মানুষের অগ্রযাত্রা থেমে নেই। উড়ে যাওয়ার এই অগ্রযাত্রায় নতুন সংযোজন সৌরশক্তিচালিত উড়োজাহাজ। অবশেষে বিশ্বভ্রমণের লক্ষ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি থেকে গত ৯ মার্চ যাত্রা শুরু করেছে সৌরশক্তিচালিত উড়োজাহাজ সোলার ইম্পালস-২। বিস্তারিত নিয়ে লিখেছেন নাজমুল হোসেন

সোলার ইম্পালস-২ প্রথম সফল পদক্ষেপ হিসেবে আবুধাবি থেকে ওমানের রাজধানী মাসকটে পৌঁছেছে। ৪০০ কিলোমিটার দূরের প্রথম এই গন্তব্যে ১২ ঘণ্টায় পৌঁছতে পেরেছে ইম্পালস-২।

একটি গাড়ির সমান ওজনের ওই উড়োজাহাজের ডানা জাম্বো জেট উড়োজাহাজের চেয়েও কিছুটা বড়। পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়াসহ এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ ঘুরবে এটি। উড়োজাহাজটি ৩৫ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে।

এক আসনের সৌরচালিত এ বিমানের পাইলট হলেন আন্দ্রে বর্সবার্গ। তিনি আরেক পাইলট বার্ট্রান্ড পিকার্ডের সাথে ভাগাভাগি করে এ দায়িত্ব পালন করবেন। বিশ্বভ্রমণকালে উড়োজাহাজটি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যাত্রাবিরতি করবে। মাসকটসহ মোট ২৫টি স্থানে এটি যাত্রাবিরতি করবে। আরব সাগর পার হয়ে পরে সেটি ভারতে পৌঁছবে। এরপর মিয়ানমার, চীন ও হাওয়াই হয়ে নিউ ইয়র্কে পৌঁছবে।

জ্বালানিবিহীন উড়োজাহাজ

ভাবতে অবাক লাগলেও সত্যিই এখন বিমান উড়ছে সৌরশক্তির সাহায্যে। চলতি মাস থেকে উড়তে শুরু করেছে অতি হালকা ওজনের সম্পূর্ণ জ্বালানিবিহীন এবং সৌরশক্তিচালিত উড়োজাহাজ। আপাতত যাত্রী বহনের আশা করতে পারছেন না বিমানটির প্রস্তুতকারকেরা। এটিই হচ্ছে বিশ্বের প্রথম সৌরশক্তিচালিত বিমান। প্রথম সৌর বিমান সম্পূর্ণ সৌরশক্তিচালিত বিমানটির বডি তৈরি করা হয়েছে কার্বন ফাইবার দিয়ে। ৭৪৭ জেটলাইনারের মতো পাখা, এর ওজন একটি স্টেশন ওয়াগনের সমান।

এটি চলতে লাগবে স্কুটারের চাহিদার সমপরিমাণ শক্তি। বিমানটির পাখার সাথে সোলার প্যানেল যুক্ত থাকবে। ভেতরে থাকবে লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারি। বিমানটি দিনে সূর্য থেকে শক্তি নেবে আর রাতের জন্য শক্তি সঞ্চয় থাকবে ব্যাটারিতে। বিমানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে এমন সৃষ্টিশীল প্রকৌশল, যা সূর্য ডুবে গেলেও সৌরশক্তি গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। বিশ্বভ্রমণ করার জন্য প্রস্তুত সোলার ইম্পালস-২ নিরবচ্ছিন্ন ১২০ ঘণ্টা আকাশে উড়তে সক্ষম।

সোলার ইম্পালস-২-এর নির্মাতা

২০০৩ সালের ২৮ নভেম্বর সুইজারল্যান্ডের বার্ট্রান্ড পিকার্ড আর আন্দ্রে বর্সবার্গ এক স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন একফোঁটা তেল না পুড়িয়ে সৌর উড়োজাহাজ দিয়ে তারা বিশ্বভ্রমণ করবেন। সেই লক্ষ্যে কাজ করে তৈরি করেন সম্পূর্ণ সৌরশক্তিচালিত প্রথম উড়োজাহাজ সোলার ইম্পালস-১। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম সোলার ইম্পালস আকাশে ওড়ে। তার পরের গল্প ভবিষ্যতের তেলবিহীন পরিবেশবান্ধব বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ নিয়ে আমাদের আরো বেশি আশান্বিত করেছে। প্রথম ওড়ার পর ২০১০ সালের জুলাই মাসে সোলার ইম্পালস-১ একজন পাইলট নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ২৬ ঘণ্টা আকাশে ২৮ হাজার ৫০০ ফুট ওপর দিয়ে উড়তে সক্ষম হয়। তারপর সুইজারল্যান্ড থেকে স্পেন, মরক্কো, ফ্রান্স এমনকি ২০১৩ সালে আমেরিকা সফর করে।

২০১১ সালের ১৩ মে সোলার ইম্পালস-১ তার প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শেষ করে সুইজারল্যান্ড থেকে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ৬৩০ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে। এ যাত্রায় এসআই-১ গড়ে ৬০০০ ফুট ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার বেগে উড়ে যায়। একই বছরের ১৬ জুন এটি ফ্রান্স যায়। ২০১২ সালের জুনে এসআই-১ তার প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় সফর সম্পন্ন করে স্পেন থেকে মরক্কো পর্যন্ত।

সোলার ইম্পালস-১ এর অত্যাধুনিক সংস্করণ সোলার ইম্পালস-২ গত বছরের এপ্রিলে প্রথম গণমাধ্যমের সামনে উন্মুক্ত করা হয়। এর উদ্দেশ্য ২০১৫ সালের কোনো একসময় মূল মধ্যরেখা বরাবর ২০ থেকে ২৫ দিনে পৃথিবী ভ্রমণ করা। দিন-রাত লাগাতার চলতে সক্ষম এই বিমানে একফোঁটা জ্বালানি দরকার হয় না। ২৩০০ কেজি ওজনের সম্পূর্ণ সৌরশক্তিচালিত এর এক একটি পাখার দৈর্ঘ্য ২৩৬ ফুট। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অ৩৮০ বিমানের প্রায় সমান। পাখাসহ বিমানের মূল কাঠামোর ওপরের দিকে ১৭ হাজার মনোক্রিস্টালাইন সেল দিয়ে তৈরি প্যানেল লাগানো আছে। সোলার সেলগুলোর সাহায্যে বিমানটি দিনে মাটিতে কিংবা আকাশে ওড়ার সময় সূর্যের আলো থেকে শক্তি সংগ্রহ করে চারটি রিচার্জেবল লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারিকে চার্জ করে। তবে বিমানটি দিনে আকাশে ওড়ার সময় ব্যাটারিগুলোকে ভালোভাবে চার্জ করার জন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৭৮৮৭ ফুট ওপরে উঠে যায় এবং চার্জ শেষ হয়ে গেলে আবার পাঁচ হাজার ফুট ওপরে চলে আসে। উড়তে উড়তেই এই পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে যায়। ব্যাটারিগুলোর সম্মিলিত ভর ৬৩৩ কেজি, যা ১৩ কিলোওয়াট বা ১৭.৫ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি মোটরকে শক্তি জোগায়। এগুলোর সাহায্যে বিমানটি ঘণ্টায় ১৪৩ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। মূল কাঠামো হালকা কিন্তু প্রচণ্ড শক্ত কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি। ১৩৪ কিউবিক ফুটের ককপিটে আন্তঃমহাদেশীয় ফ্লাইট কিংবা মহাসাগরের ওপর দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলার জন্য অটোপাইলট, অক্সিজেনসহ সব আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা আছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এই বিমান ৩৯ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়তে সক্ষম।

সোলার ইম্পালস-২

গত বছরের জুন মাসে সোলার ইম্পালস-২ প্রথম আকাশে ওড়ে। বিমানটি সুইজারল্যান্ডের একটি বিমানবন্দর থেকে গিনেস মিন টাইম সাড়ে ৩টার একটু পরই উড্ডয়ন করে। দুই ঘণ্টা পর আবার বিমানবন্দরে ফিরে আসে এটি। মারকাস স্কারডেল নামে একজন প্রথম ফ্লাইটে বিমানটির ককপিটে পাইলট হিসেবে ছিলেন। তিনি বিমানটি নিয়ে ছয় হাজার ফুটের কিছু ওপর দিয়ে উড়ে যান। বিমানটির ককপিটে মাত্র একজন পাইলট বসার জায়গা আছে। উড্ডয়নের পর প্রথম দিকে কয়েকটি ঝাঁকুনির ঘটনা ঘটলেও বিমানটির উড্ডয়নের ফলাফল বেশ ইতিবাচক ছিল।

পাঁচ মাসে বিশ্ব ঘুরবে

আগামী পাঁচ মাস ধরে বিমানটি এক উপমহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাবে। প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেবে। ‘সিঙ্গেল সিটার’ বিমানটি পরিচালনা করবেন এর নির্মাণকারক আন্দ্রে বর্সবার্গ। তাকে সহযোগিতা করবে সুইস পাইলট বার্ট্রান্ড পিকার্ড।

সৌরশক্তিচালিত বিমানটি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অবতরণ করবে। মানুষের মধ্যে পুরনো প্রযুক্তি বর্জন করে নতুন ও ব্যয় সঙ্কুচিত, পরিষ্কার প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য সচেতনার বার্তা পৌঁছে দিতেই এ অভিযান।

পরিবেশগত সুবিধা

প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আমাদের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। একই সাথে এই স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মক রকমে। অক্টোবর ২০১৪ সালে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০০ পিপিএমের মতো। ৬০ বছর আগে যা ছিল ৩১০ পিপিএম। এই ছয় দশকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৮৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সারা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এর প্রভাবে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অসময়ে বন্যা, খরা, নদীভাঙন, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গিয়ে নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে বহু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। সবকিছুর জন্য একমাত্র দায়ী করা হয় কার্বন ডাই-অক্সাইডের বেড়ে যাওয়াকে। কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া চালু থাকলে চলতি শতাব্দীতে তাপমাত্রা বাড়বে আরো ১ থেকে ৩ ডিগ্রি। সব তথ্য-উপাত্ত এক করে দেখা গেছে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির জন্য ৯১ ভাগ দায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল, গ্যাস), বাকি ৯ ভাগের জন্য দায়ী বনাঞ্চল ধ্বংস। বিদ্যুতের চাহিদা আগামী বছরগুলোতে আরো বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চাপও তার সাথে বেড়ে চলছে। আমাদের এমন কোনো সমাধান দরকার যা দিয়ে বর্ধিত বিদ্যুতের এই চাহিদাও মিটবে আবার পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সব সমস্যার সমাধান এক উপায়ে হবে না।

৯১ শতাংশ দূষণের ব্যবস্থা করা যায় নিরাপদ নবায়নযোগ্য শক্তির সাহায্যে। প্রধানত বায়ু এবং সৌর বিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার আমাদের জলবায়ু এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে আবার ১৮৫০ বা ১৮৬০ সালের মতো অবস্থানে নিতে পারে। গবেষকদের মতে, যা নিরাপদ মাত্রা হিসেবে বিবেচিত। এ মুহূর্তে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যেসব প্রযুক্তি আছে তা দিয়ে সহজেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বহুতল ভবন এবং শিল্প কলকারখানা চালানো সম্ভব। কিন্তু স্বীকার করতে হবে এর ব্যয় সাধারণের নাগালের বাইরে। একই সাথে যাদের সক্ষমতা আছে তাদের বেশির ভাগেরই এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব। ফলে দরকার সব নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং গ্রাহকপর্যায়ে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা।

সোলার ইম্পালসের সহকারী প্রতিষ্ঠাতা বার্ট্রান্ড পিকার্ডের উদ্দেশ্য হলো, আকাশে বিমান নিয়ে আশ্চর্যজনক কিছু দেখানো নয়। সৌর বিদ্যুতের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের চিন্তায়, আত্মবিশ্বাসে বিপ্লব ঘটানো এবং বাসযোগ্য একটি পৃথিবী নির্মাণে পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *