শাহীদুজ্জামান সাগর
চলন্ত বাস থেমে গেল। আনন্দের যাত্রায় ব্রেক কষায় ফ্যাকাশে হলো মুখের চাহনি। বিদায় জানাতে গিয়ে চোখের কোঠরে জল এলো আরিফ শাকিলের। অজানা ব্যথা অনুভব করলাম বুকে। শেষ না শুরু। বুঝে ওঠার আগেই বাস থেকে নামতে বলা হলো। বিষণ্ণ মনে নামছে সবাই। সব শেষে আমি। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও সিলেট ভ্রমণ শেষে বিদায়বেলায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে অনেকেই।
টানা আট দিন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সাগর ও পাহাড়ের সাথে নীল আকাশে মিতালী উপভোগ করে বিদায়বেলায় এমন চিত্রই ফুটে উঠেছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। কৃষি অনুষদের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফর এটি। এ বছর ছয়টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মোট ২৬৫ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিল।
ওই মিতালী এর আগে অনেকের দেখার সুযোগ হয়নি। আর যারা দেখেছে, সাগর-পাহাড়ের সৌন্দর্য ফের দেখতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। এই সফরের চেয়ে অন্য কোনো সফর মজাদার হয় না। তাই সবার স্বপ্ন থাকে টানা কয়েক দিনের ওই সফরকে ঘিরে। আর সবার স্বপ্নকে এক করে মিতালী দেখার আনন্দটাই মনের মণিকোঠায় হিমালয় ছুঁয়েছে।
সন্ধ্যা। সাগর ও পাহাড়ের সাথে নীল আকাশের মিতালী দেখার আর যেন তর সইছিল না। নির্ধারিত সময়ের আগেই হাজির অনেকেই। বাস এসে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যালিপ্যাডে। আনন্দ আরো বাড়িয়ে দিতে আমাদের সাথে কৃষিতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. এ কে এম মমিনুল ইসলাম ও কৃষি সম্প্রসারণ শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক দেবাশীষ সরকার এসে হাজির।
‘পাহাড় হলো অহঙ্কারী শিখর হিমাদ্রির/সাগর সদা গতিচঞ্চল প্রতীক পৃথিবীর/সইতে জানে, বইতে জানে সারা জগৎময়/সমুদ্র তাই ঐক্যবদ্ধ, পাহাড় ততো নয়’- নির্মলেন্দু গুণের ‘ঐক্যবদ্ধ জল’ কবিতাকে মাথায় রেখে প্রথমে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা। মাঝপথে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত দেখতেও ভুললাম না। এক ভোরে সুগন্ধা সমুদ্রসৈকতে গেলাম। পানিতে নেমে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল সবাই। সাগরের পানিতে গোসল করা দেখে মনে হলো, এর আগে কেউই গোসল করেনি। পরে হিমছড়ি ইকো পার্ক ও ইনানী সি বিচও ঘুরে এলাম।
পরদিন রওনা হলাম মহেশখালীর উদ্দেশে। আমার স্পিডবোটে ওঠা এবারই প্রথম। পাশে মেয়েদের দেখে ভয় পেতেও লজ্জা করছিল। চার দিক অথৈ পানির মধ্যে চলার সৌন্দর্য কতটাই না উপভোগ্য! দেখা হলো অনেক দিনের পুরনো শ্রী শ্রী আদিনাথ মন্দির। আর মহেশখালীর পান খেতে ভোলেনি কে।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমাদের ৩৫ ভ্রমণপিয়াসীর মধ্যে ২১ জন মেয়ে। মেয়েদের ভালো ও সুস্থ থাকার পরিমাণ সুন্দর ভ্রমণের সমানুপাতিক। ভ্রমণের শুরুতেই কথাটা বলে কয়েকজন মেয়ে উল্টো প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু সংখ্যায় কম হওয়ায় আর কথা বাড়াইনি। তবে শেষ পর্যন্ত কেউ অসুস্থ না হওয়ায় অপ্রত্যাশিত আনন্দ পেয়েছিলাম আমরা।
‘অনেক দিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ/কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না/ যদি তার দেখা পেতাম/দামের জন্য আটকাতো না’- ‘পাহাড় চূড়ায়’ কবিতায় আমার মনের কথাটা অনেক আগেই লিখে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সাগর আর নীল আকাশের মিতালী দেখা শেষ। পাহাড় ও নীল আকাশের মিলন দেখতে গেলাম বান্দরবান। শুরুতেই মেঘনার ঝুলন্ত সেতু ও স্বর্ণ-মন্দির। বাদরের মতো ঝুলে নিজেকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করল অনেকেই। এরপর ১৭০০ মিটার উঁচু পাহাড় নীলাচলে উঠলাম। নামটা এমনি এমনি হয়নি। নীল আকাশ পাহাড়টিকে আঁচল দিয়ে ঢেকে আগলে রেখেছে। এত ছোট পাহাড়েও মন ভরল না। যাত্রা চিম্বুক পাহাড় হয়ে ৪০০০ মিটার উঁচু নীলগিরি। মজার ব্যাপার হলো, চান্দের গাড়ি করে নীলগিরির বন্ধুর রাস্তায় সব সৌন্দর্য লুকায়িত। সময় অনুকূল না হওয়ায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে মেঘ দেখার সৌভাগ্য হলো না।
পরে ‘লাল পাহাড়ি দেশে যাবি, হাঁড়ি আর মাদল পাবি/মেয়ে মরদের আদর পাবি রে, ও নাগর ও নাগর/…. লাল পাহাড়ি দেশে যা, রাঙ্গামাটির দেশে যা/ইত্থাক তুকে মানাইছে না রে, ইক্কেবারে মানাইছে না রে’ গান গাইতে গাইতে রাঙ্গামাটিতে চললাম। ঝুলন্ত সেতু ও পাহাড় এবং সুবলং ঝরনার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
এবার পাহাড় ছেড়ে চায়ের দেশে। আসার পথে কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডার দোকানের রসমালাই খাওয়ালেন মমিনুল স্যার। এরপর সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বেশ কিছু চাবাগান দেখা হলো। এর পর্যটকদের পছন্দের মাধবকুণ্ড, পাহাড়-ঝরনা ও পাথরের জাফলং মন কেড়ে নিলো আমাদের। শেষে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও হজরত শাহজালালের মাজার ঘুরে দেখলাম।
এ ছাড়া বাসের মধ্যে আনাড়ি নাচ ও বেসুরে গলার গানে সবাই ছিল মুগ্ধ। সব ক’টি ভ্রমণের জায়গায় কেনাকাটা করেছে আরিফা। নাজমুল এই ভ্রমণে ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পেয়েছে। ক্যাম্পাসে এসে ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘কোন বিরহ নাই, চার দিকে শুধু ভালোবাসা’। বাসে মুক্তাদির যেভাবে ঘুমিয়ে ছিল, দেখে মনে হয়েছিল সে বেডরুমে ঘুমাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক অসাধারণ সময় কেটেছে আমাদের। শিক্ষকদের আন্তরিকতায় শিক্ষা সফরটি আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এটি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মনের মণিকোঠায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করে থাকবে বলে প্রত্যাশা সবার।’ সূত্র : নয়া দিগন্ত।